Advertisment

কোথায় গেল সেই মাছ, যার নামে 'তোপসিয়া'?

কলকাতার সঙ্গে তোপসিয়ার যোগ আজকের নয়। ফিরে যেতে হবে সেই ১৭১৭ সালে, যখন মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়ারের কাছ থেকে কলকাতার আশেপাশে ৩৮টি গ্রামের ইজারা নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata history topsia

মা ফ্লাইওভার থেকে তোপসিয়া। ছবি: শশী ঘোষ

একসময় যে চামড়ার কারখানায় নাভিশ্বাস উঠত তোপসিয়ার গলিঘুঁজিতে, সেইসব কারখানা আজ ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের এক দশক হয়ে গেলেও কলকাতার পূর্ব প্রান্তে এই এলাকা এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি সেসব দিনের স্মৃতি, যদিও চামড়ার কারখানার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অতি পরিচিত সেই দুর্গন্ধ - কারখানার ধোঁয়া এবং বর্জ্য পদার্থ, খোলা নর্দমা, এবং কাছাকাছি ধাপার মাঠের জঞ্জালের গন্ধের অদ্ভুত মিশ্রণ - অনেকদিন আগেই পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেছে।

Advertisment

শহরের পরিবেশ রক্ষায় পূর্ব কলকাতার জলাজমির অসীম গুরুত্ব সত্ত্বেও এলাকায় গড়ে উঠেছে একের পর এক পাড়া, এবং কয়েক দশক ধরে পরিবেশের গুরুতর ক্ষতিসাধন করে গেছে চামড়ার কারখানাগুলি। ১৯৯৬ সালে কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, শহরের সীমানার বাইরে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে সমস্ত কারখানা, যদিও সেই নির্দেশ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করতে লেগে যায় প্রায় দশ বছর। ধীরে ধীরে ট্যাংরা, তোপসিয়া, তিলজলার বিভিন্ন এলাকা ছেড়ে চলে যায় সব চামড়ার কারখানা, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তাদের জায়গা নেয় একাধিক নির্মাণ সংস্থা, যারা ঝাঁপিয়ে পরে ভরাট করতে থাকে জলাভূমি। উদ্দেশ্য, অফিস বা বাড়ি তৈরি।

উল্লেখ্য, ২০০২ সালে র‍্যামসার সাইট (Ramsar site) ঘোষিত হয় এই এলাকা। সারা পৃথিবীতে রয়েছে একাধিক র‍্যামসার সাইট, যেগুলি র‍্যামসার কনভেনশনের অন্তর্ভুক্ত। এই কনভেনশনের আওতায় পড়ে পৃথিবীর সেইসব জলাভূমি, যেগুলির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করা হয়, বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিদের অস্থায়ী বাসস্থান হিসেবে। তবে র‍্যামসার সাইট ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও রেহাই পায় নি তোপসিয়ার জলাভূমি।

kolkata street names ছবি: শশী ঘোষ

কলকাতার সঙ্গে তোপসিয়ার যোগ আজকের নয়। ফিরে যেতে হবে সেই ১৭১৭ সালে, যখন মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়ারের কাছ থেকে কলকাতার আশেপাশে ৩৮টি গ্রামের ইজারা নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। শেষমেশ ১৭৫৮ সালে নবাব মীর জাফরের কাছ থেকে মোট ৫৫টি গ্রাম কিনেই নেয় কোম্পানি, আগের ইজারা নেওয়া ৩৮ টি গ্রাম সমেত। এইসব গ্রাম হয়ে যায় বাড়তে থাকা কলকাতা শহরের প্রান্তিক অঞ্চল।

সবকটি গ্রাম মিলিয়ে এলাকার নাম হয় 'ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম', যার অবস্থান ছিল মারাঠা খাতের (Maratha Ditch) বাইরে। অনেকেই জানেন, এই মারাঠা ডিচ পাঁচ কিমি চওড়া একটি খাত, যা কলকাতাকে ঘিরে নির্মাণ করা হয় ১৭৪২ সালে, সম্ভাব্য মারাঠা দস্যুদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে। সেই আক্রমণ অবশ্য আসে নি কোনোদিন। এবং ব্রিটিশদের সুরক্ষার জন্য এই খালের খরচ সম্পূর্ণভাবে আসে ভারতীয়দের দেওয়া খাজনা থেকে।

যে সমস্ত গ্রাম মিলে ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম, সেইসব গ্রাম কিন্তু কলকাতা শহরের অংশ হওয়া সত্ত্বেও মারাঠা খাতের পরিধির বাইরে পড়ে যায়। মারাঠা খাত যে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, সেই উপলব্ধি হওয়ার পর সেটিকে ১৭৯৯ সালে আংশিকভাবে, এবং ১৮৯৩ সালে সম্পূর্ণভাবে বুজিয়ে দেওয়া হয়। এবং খাত যত ভরাট করা হয়, ততই বাস্তবে কলকাতার অংশ হয়ে ওঠে ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম।

ব্যারিস্টার, ইতিহাসবিদ, এবং তৎকালীন কলকাতাবাসী হ্যারি এভান অগস্ট কটন তাঁর 'ক্যালকাটা ওল্ড অ্যান্ড নিউ' বইতে লিখেছেন, ওই ৫৫টি গ্রাম ছিল কলকাতার "শহরতলি", যা "২৪ পরগণা" থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়, এবং মীর জাফর কর্তৃক ১৭৫৭ সালে কলকাতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। কটন লেখেন, "রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে এগুলি কলকাতার অংশ ছিল, কিন্তু তাদের আইনি অস্তিত্ব ছিল পৃথক এবং সুনির্দিষ্ট।"

ডিহি পঞ্চান্নগ্রামের সদস্য হিসেবে তোপসিয়া ১৭৮৪ সালে উড সাহেব প্রণীত কলকাতার মানচিত্রে নিজের জায়গা করে নেয়, এবং ১৭৯৪ সালে এ আপজনের (A. Upjohn) মানচিত্রেও। আজও এই এলাকাকে বলা হয় পঞ্চান্নগ্রাম, যদিও 'ডিহি' কথাটা কয়েক শতাব্দীর উথালপাথালে আজ বিলুপ্ত।

kolkata street names তোপসিয়ার পুরোনো পাম্পিং স্টেশন। ছবি: শশী ঘোষ

ঐতিহাসিক নথিপত্রে পাওয়া যায়, তোপসিয়ার আশেপাশে জলাভূমির অস্তিত্ব থাকায় মাছ ধরা ছিল গ্রামের অনেকেরই প্রধান জীবিকা। গ্রামের নামকরণও সম্ভবত হয় এই পেশা থেকেই। কলকাতার কিংবদন্তি ঐতিহাসিক পি থাঙ্কপ্পন নায়ারের মতে, 'তোপসিয়া' নামটা সম্ভবত আসে দুই বাংলা এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বহু জায়গায় প্রাপ্ত 'তোপসে' মাছ থেকেই, 'Polynemus paradiseus' যার বৈজ্ঞানিক নাম। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি নির্মাণ বাহিনীর খপ্পরে পড়ার আগে সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যেত এই মাছ, এবং আশেপাশের গ্রামবাসীদের অন্যতম প্রধান খাদ্যও ছিল এটি।

কালের নিয়মে যত বাড়তে থাকে কলকাতা, কাছাকাছি শহর বা রাজ্য থেকে তত বাড়ে কাজ খুঁজতে আসা মানুষের সংখ্যা। জলাভূমিতে গড়ে ওঠে অসংখ্য চামড়ার কারখানা, যেহেতু তখনও শহরতলি হিসেবেই দেখা হতো এই অঞ্চলকে। বহু অভিবাসী শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয় এইসব ট্যানারি বা চামড়ার কারখানায়, যেখানে পরিশ্রম ছিল হাড়ভাঙ্গা, পারিশ্রমিক নামমাত্র। কোনোরকমে নিজেদের মাথা গোঁজার স্থানটুকু তৈরি করে নেন এই কর্মীরা, এবং তাঁদের চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর এইসব বাসস্থান, বা তাঁদের কর্মক্ষেত্রের কোনোরকম উন্নতি করতে এগিয়ে আসে নি কোনও সরকার।

kolkata street names বিরল এই মানচিত্র কলকাতার 'মারাঠা ডিচ'-এর অস্তিত্ব নথিভুক্ত করে যে সামান্য কয়েকটি প্রামাণ্য দলিল, তারই একটি। এই মানচিত্রের প্রণেতা টমাস কিচিন, এবং এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৬৩ সালে। লক্ষ্য করুন, এখানে মারাঠা ডিচের বানান লেখা হয়েছে ‘Morratoe Ditch’

চামড়ার কারখানাগুলি যে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছড়াচ্ছে, এবং সেগুলি থেকে উদ্ভূত বর্জ্য পদার্থের যে যথাযথ নিষ্কাশন হচ্ছে না, সেকথা দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেলেও ২০০৮ সালে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে প্রশাসন, এবং শুরু হয় ট্যানারি (অধিকাংশই অবৈধ) হঠাও অভিযান। গত ৩০ বছরের দ্রুত বিবর্তনের ফলে এই এলাকা এখন পুরোপুরি শহর কলকাতার অংশ, এবং সল্টলেক, রাজারহাট, এবং এয়ারপোর্টের সঙ্গে কলকাতার যোগসূত্রও বটে।

ঘিঞ্জি বস্তি, কিছু এলোপাথাড়ি বাসভবন, এবং বিলাসবহুল হোটেলের অদ্ভুত সংমিশ্রণ তোপসিয়া, যেখানে পরিবেশ রক্ষা কর্মীদের বহু প্রতিবাদ সত্ত্বেও আজও পুরোদমে চলছে জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণের কাজ। আজকাল কলকাতার বাজারে তোপসে মাছ আসে বাইরে থেকে। কারণ তাদের একসময়ের বিচরণক্ষেত্রে আজ আর তাদের খুঁজেও পাওয়া যায় না।

kolkata news heritage
Advertisment