Advertisment

নির্বাচনে এবার জাতীয় নিরাপত্তা, না কৃষি সমস্যা?

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা যে সময়ে ঘটছে, সেটাও লক্ষনীয়। অতীতে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক গুরুতর সমস্যাগুলি যখন দেখা দিয়েছিল, তার সময়কাল কখনওই নির্বাচনের দোরগোড়ায় ছিল না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
general elections 2019

চিত্রাঙ্কন: শুভজিৎ দে

ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বর্তমানে যে উত্তেজনার আঁচ, তার কতটা প্রভাব পড়তে পারে দেশের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে? ভোটারদের মানসিকতা কী কী কারণে প্রভাবিত হয়, তাই দিয়েই আলোচনাটা শুরু করা যাক। আমজনতার রাজনীতি আর 'এলিট' ক্লাসের উচ্চকোটির রাজনীতির ফারাকটা এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে দেখলে, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি 'এলিট' শ্রেণীভুক্ত ভোটারদের কাছে চিরদিনই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু আমজনতাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করতে পারেনি।সাধারণ ভারতীয় ভোটারদের কাছে বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে ধর্ম এবং জাতপাত, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এবং দারিদ্র্য।

Advertisment

ভারতের ৬৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন। গ্রামই আমজনতার রাজনীতির মূল ভরকেন্দ্র। অকগ্রামীণ রাজনীতি মূলত জাতপাতের (ধর্মের চেয়েও বেশি) অঙ্কের দ্বারা প্রভাবিত। গ্রামীণ অর্থনীতির দুরবস্থাজনিত কৃষক বিক্ষোভ অনেকটাই প্রভাব ফেলে সাধারণ ভোটারের রাজনৈতিক ধ্যানধারণায়। জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যতই উথালপাথাল চলুক সংবাদপত্রে বা টিভি চ্যানেলে, তার অভিঘাত মূলত শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমায়িত থাকে। নিরাপত্তা-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যাশলে টেলিস এই বিষয়ে তাঁর বহুচর্চিত গবেষণায় বলেছিলেন, ভারত চিরদিনই নিজেকে উন্নয়নমুখী দেশ হিসাবে ভেবে এসেছে এবং সেভাবে গুরুত্বই দেয়নি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি। বরং ভেবে এসেছে, নিরাপত্তার সমস্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিটে যাবে ক্রমে। বাস্তবে তা হয়নি, মেটে নি নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্যাসমূহ। তবু নিরাপত্তার গুরুত্বের বিষয়টিকে আমজনতার চিন্তাস্রোতে বইয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। টেলিসের যুক্তি অনুযায়ী, যতদিন না ভারত আরও বেশি শহুরে হয়ে ওঠে, যতদিন না আর্থিকভাবে আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিকই থাকবে।

আরও পড়ুন: "ধর্মের পরে দেশপ্রেম": একটি জাতীয় বিশ্বাস

টেলিসের এই যুক্তি কি আজকের ভারতেও প্রযোজ্য? এই যুক্তির সারবত্তাকে প্রশ্ন করার তিনটি কারণ রয়েছে চোখের সামনেই। জনসংখ্যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিস্তার, ভারত-পাকিস্তানের চলতি দ্বন্দ্বের 'টাইমিং' বা সময়কাল, এবং দিল্লিতে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের চরিত্র।

বর্তমানে দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষই মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত। প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে 'অনলাইন'। কান্দাহার-কাণ্ডের (১৯৯৯) প্রভাব সীমিতই ছিল আমজনতার মননে-মানসে, ২০০৮-এ মুম্বইয়ে হামলার আঁচও গ্রামীণ ভোটদাতাদের চেতনায় নির্ণায়ক ছাপ ফেলতে পারেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনার পরিসরটি আজকের ভারতে তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত।শহুরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। গ্রাম যদি নিরাপত্তা বিষয়ে উদাসীনও থাকে, শহুরে ভোটারদের মতামত নির্ণায়ক হয়ে উঠতেই পারে। ২০১৭-র ডিসেম্বরে গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনের কথা ভাবুন। কংগ্রেস গ্রামীণ আসনগুলি সহজেই জিতেছিল, কিন্তু শহরাঞ্চলে বিজেপি-র চমকপ্রদ ফল কংগ্রেসকে ক্ষমতা দখল করতে দেয়নি।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা যে সময়ে ঘটছে, সেটাও লক্ষনীয়। অতীতে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক গুরুতর সমস্যাগুলি যখন দেখা দিয়েছিল, তার সময়কাল কখনওই নির্বাচনের দোরগোড়ায় ছিল না। ১৯৬২-র ভারত-চিন সংঘাত দেশের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস পরে ঘটেছিল। ১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধও ঘটেছিল চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের দুই বছর আগে। ১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ ঘটেছিল পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস পরে। কান্দাহার-কাণ্ড ঘটে ১৯৯৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে। ২০০১ সালে লোকসভায় সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গেও নির্বাচনী নির্ঘন্টের দূরতম সম্পর্ক ছিল না। মুম্বই-হামলাও ঘটেছিল ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে।

কার্গিলের ব্যাপারটা অবশ্য ভিন্ন ছিল, ঘটেছিল ১৯৯৯-এর সাধারণ নির্বাচনের দুই-তিন মাস আগে। তখন শহুরে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল অনেক কম, দেশজুড়ে সেলফোন এবং ইন্টারনেটের এত ব্যাপক বিস্তারও ঘটেনি। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপে সমস্যা মিটে যায় জুলাইতে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি সীমান্তে চলতেই থাকে গুলিবোমার লড়াই, নির্বাচনে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আরও পড়ুন: সেনাবাহিনী, নাগরিক নিদ্রাভ্যাস ও সমাজবন্ধুদের আর একটা মিছিল

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হল দিল্লিতে ক্ষমতাসীন শাসক দলের চরিত্র। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে চিরদিনই কংগ্রেসের তুলনায় কড়া অবস্থান নিয়ে এসেছে। এবং কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আঞ্চলিক দলগুলির রাজনীতি মূলত জাতিগত এবং অঞ্চলগত অস্তিত্বকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এমন এক সংগঠনের ভাবধারায় এবং আদর্শে বড় হয়ে উঠেছেন, যার মূল কথাই হল, "লাথো কে ভূত বাতো সে নেহি মানতে" (কিছু মানুষ আলোচনার ভাষা বোঝে না, শুধু বলপ্রয়োগের ভাষাই বোঝে)। হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে একমাত্র অটলবিহারী বাজপেয়ীই এই আদর্শ থেকে সরে শান্তির পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। লোকসভায় জৈশ-এ-মহম্মদের হামলার পনেরো মাসের মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে খেলতে পাঠিয়েছিলেন পাকিস্তানে। বলেছিলেন, "খেল ভি জিতো অওর দিল ভি" (খেলায় জেতার পাশাপাশি হৃদয়ও জিতে এসো)। কিন্তু মোদী তো আর বাজপেয়ী নন।

পুলওয়ামা-কান্ডের পরেও ভারতের কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সংযত থাকা উচিত ছিল, তা কিন্তু নয়। প্রতিক্রিয়া দেখানো প্রয়োজন ছিল। পাকিস্তান যে ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে নিজেদের দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীদের মদত দেয় না, এমনও নয়। পাকিস্তান এই কুকর্মটা করেই। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সবাই একটা বিষয়ে একমত। পাকিস্তানে দুই গোত্রের সন্ত্রাসবাদী আছে। এক, যারা পাকিস্তানের বিপক্ষে, এবং যাদের কড়া হাতে দমন করে পাক সেনাবাহিনী। দুই, যারা ভারতবিরোধী এবং যাদের মদত জোগায় এবং সম্পদ হিসাবে রক্ষা করে পাক সেনা।

পুলওয়ামা-কাণ্ড হিন্দু জাতীয়তাবাদী কাঠিন্য প্রদর্শনের সুযোগ এনে দিয়েছে মোদীকে। আসন্ন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে মোদীকে কড়া প্রত্যুত্তর দিতেই হতো। কড়া হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না মোদীর। যদিও এই কড়া মনোভাবে সমস্যা আদৌ মিটবে কিনা, সেটা নিশ্চিত নয়।

এই প্রেক্ষিতে ফের আবির্ভাব ঘটবে বহু আলোচিত সেই ঐতিহাসিক তত্ত্বের: কাশ্মীরে অস্থিরতা বাড়লে পাকিস্তান ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়ে এবং ভারত-পাকিস্তান যত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, ততই কাশ্মীরিদের প্রকৃত সমস্যাগুলি পিছনের সারিতে চলে যায়। আগ্রাসন এবং দমনপীড়নকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে মোদী সরকার কাশ্মীরিদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এবং এই ইস্যুতে বাজপেয়ী-মনমোহনের সদর্থক রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলি মূল্যহীন করে দিয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে দিল্লির ব্যর্থতা এখন আর ততটা আলোচিত হবে না। কারণ, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি চলে এসেছে পাদপ্রদীপের আলোয়।

সম্ভবত এই প্রথম ভারত মুখোমুখি হতে চলেছে এমন এক সাধারণ নির্বাচনের, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিই থাকবে নির্বাচনী পাটিগণিতের কেন্দ্রে। বেকার সমস্যা এবং কৃষকদের দুরবস্থার সঙ্গে নির্বাচনী ইস্যু হিসাবে পাল্লা দেবে জাতীয় নিরাপত্তা। এবং এমনটাও সম্ভব, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার প্রেক্ষিতে দেশের অর্থনীতির বিষয়টিও হয়তো গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে নির্বাচনে। পাকিস্তান যদি সামরিক প্রত্যাঘাতের রাস্তায় যায়, যদি তাতে ক্ষয়ক্ষতি হয় ভারতের, যে মোদীকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই রাজনৈতিক ভাবে নড়বড়ে দেখাচ্ছিল, সেই মোদীই নির্বাচনী জয় একরকম উপহার হিসাবেই পেয়ে যাবেন পাকিস্তানের থেকে।

ভারতের বিরোধী দলগুলিও ঘটনার ঘনঘটায় পড়ে গিয়েছে সমস্যায়। নির্বাচনের আগে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি যাতে মাত্রাতিরিক্ত প্রাধান্য না পায়, সেটা নিশ্চিত করাই এখন বিরোধীদের কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

pakistan indian air force Surgical Strike
Advertisment