হুগলি জেলার বলাগড় ও সোমড়াবাজারের মাঝামাঝি শান্ত এক গ্রাম। বাংলার মন্দিরের কয়েকটি অভাবনীয় নিদর্শন বুকে নিয়ে সেইখানে আজও শায়িত এক প্রাচীন জমিদারবাড়ির অবশিষ্ট ভগ্নস্তুপ। সে গ্রামের পাশ দিয়ে একদা বহমান হুগলী নদী তার গতিপথ পালটে ফেলেছে। আর তেমনই, মানুষও যেন ইতিহাসের এই অধ্যায় থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে অবহেলায়। অথচ এখানেই রয়েছে বাংলার মন্দির রীতির নিখুঁত উদাহরণ। সুখারিয়া। মিত্র মুস্তাফি পরিবারের বসতবাটি।
সুদূর অতীতে কনৌজ থেকে বাংলায় এসেছিলেন পাঁচ কায়স্থ, কালিদাস মিত্র তাঁদের অন্যতম। তিনিই এই বংশের আদি পুরুষ। তাঁরই উনিশতম প্রজন্মের বংশধর, রামেশ্বর মিত্র ছিলেন উলা বীরনগরের সুবিখ্যাত জমিদার। উলা বীরনগর ও শ্রীপুর অঞ্চলে এই পরিবার দেওয়ান বংশ নামে সুপরিচিত ছিল, কারণ তাঁদের প্রায় সকলেই রাজস্ব বিভাগের নানা পদে আসীন ছিলেন। রামেশ্বর মিত্র মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে দিল্লী যান। হিসাবনিকাশে তাঁর দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট তাঁকে ‘মুস্তাউফি’ নামক রাজকীয় খেতাব দেন এবং সাথে দেন সোনার ‘পাঞ্জা’ অর্থাৎ রাজার হাতের ছাপ বা সীলমোহর। তখন থেকেই এঁরা মিত্র মুস্তাফি উপাধি ব্যবহার করে আসছেন, এবং তাঁদের পারিবারিক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ঐ সোনার পাঞ্জা।
পরবর্তীকালে রামেশ্বরের ছেলে অনন্তরাম উলা বীরনগর ছেড়ে সুখারিয়াতে বসবাস শুরু করেন। এই পরিবারের বীরেশ্বর মুস্তাফি ১৮১৩ সালে সুখারিয়া গ্রামের সবচেয়ে অভিনব মন্দির, আনন্দভৈরবী মন্দির স্থাপন করেন। পঁচিশ রত্ন বিশিষ্ট এই মন্দিরের নিদর্শন বাংলায় আর মাত্র চারটি আছে, তিনটি বর্ধমানের কালনায়, একটি বাঁকুড়ার সোনামুখিতে। ১৮৯৭ সালের প্রবল ভূমিকম্পে এর সবচেয়ে ওপরের পাঁচটি রত্ন ধ্বংস হয়ে যায়, তা আবার নির্মাণ করা হয়েছে। মূল মন্দির চারতলা। মন্দিরে কালী আনন্দময়ী কালী রূপে পূজিতা।
মূল মন্দিরের বাইরে দুই দিকে দুসারিতে ছটি করে মোট বারোটি মন্দির। এই বারোটি মন্দিরের প্রথম দুটি পঞ্চরত্ন বিশিষ্ট। বাকি দশটি আটচালা ধারায় তৈরি। একটি পঞ্চরত্ন মন্দিরে গনেশ পূজিত হয়, বাকিগুলিতে শিবলিঙ্গের অবস্থান। একটি আটচালা মন্দির বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়েছে। আনন্দভৈরবী মন্দির প্রাঙ্গনের বাইরে একটি প্রশস্ত দীঘিতে মন্দিরগুলির প্রতিফলনের দৃশ্য মুগ্ধ করে।
মূল মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার প্যানেল ও পংখের কাজ। কিন্তু ঢালাও রং করে ফেলার কারণে অপূর্ব প্যানেলগুলি অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। রেড অক্সাইডের প্রলেপে ঢাকা পড়ে গেছে পোড়া মাটির কাজ। তবু যেটুকু দেখা যায়, তার অন্যতম হলো কৃষ্ণের বাল্যলীলার আদলে চারজন সখীসহ দুর্গা গণেশকে লালন করছেন। একটি প্যানেলে চিত্রিত হয়েছে গঙ্গাবতরণের দৃশ্য। কালী, জগদ্ধাত্রী প্রমুখ ঠাকুর দেবতা ছাড়াও অভিজাত সমাজের নানা চিত্র ও চরিত্র দেখা যায় এখানে। শিবরাত্রি ও দীপাবলিতে মন্দির চত্বরে বড় উৎসব হয়।
এর ঠিক পাশে রাধাকুঞ্জ। শম্ভুরাম মিত্র মুস্তাফির প্রপৌত্র রাধাজীবন মিত্র মুস্তাফি এই প্রাসাদোপম বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন, বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তা। সুউচ্চ থাম, প্লাস্টারের কারুকার্য, লোহার রেলিং-এর ডিজাইন, খড়খড়ি দেওয়া জানলা ও বারান্দার আচ্ছাদন, কড়িবরগা, দরজার ওপরের আর্চ, অতীতের জমিদার বাড়ির স্থাপত্যরীতিকেই মনে করিয়ে দেয়। বাড়ির সামনের অংশের থামগুলি দ্বিতল উচ্চতা বিশিষ্ট।
ভিতরে প্রবেশ করলে প্রশস্ত প্রাঙ্গন, তিনপাশে উঁচু দালান ও ঘরগুলি। আর একদিকে ঠাকুর দালান। সেখানে সংযুক্ত কলামের ওপর ত্রিস্তরীয় খিলান নজর কাড়ে। অন্য তিন দিকের দালানের কলামগুলি পাশাপাশি দুটি করে সজ্জিত। মূল সিঁড়ি ছাড়াও খোলা উঠোনের একদিক দিয়ে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি উঠে যাচ্ছে ভগ্নপ্রায় দোতলায়।
বাড়িটিতে প্রবেশ করলেই ডানদিকে রাখা রথ ও ঠাকুর দালানে নির্মীয়মাণ দুর্গামূর্তি বুঝিয়ে দেয়, মিত্র মুস্তাফি পরিবারের সদস্যরা এখন নানা দিকে ছড়িয়ে পড়লেও পারিবারিক ঐতিহ্যের বাতি টিমটিম করে হলেও জ্বলছে। উঠোনের মাঝখানে একটি উঁচু পৃথক অংশ, যেটি নাটমন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হত। অতীতে যাত্রাপালা, কবিগান, থিয়েটারের আসর বসত এখানে। চারপাশে স্বল্প উচ্চতার থামের ওপর লাগানো লোহার বাঁকানো রডগুলিতে তখন ঝুলত হ্যাজাকের আলো।
এই রাধাকুঞ্জেই মৃণাল সেন তাঁর অন্যতম ছবি, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, স্মিতা পাতিল, শ্রীলা মজুমদার অভিনীত ‘আকালের সন্ধানে’র শুটিং করেছিলেন। ১৯৭৯-৮০ তে এক মাস ধরে মন্দির চত্বর, এই বাড়ি ও সংলগ্ন গ্রামে পুরো ইউনিট নিয়ে কাজ করেছিলেন তিনি।
গ্রামের আরেক দিকে হরসুন্দরী কালীমন্দির। মূল মন্দিরটি নবরত্ন বিশিষ্ট, বারো চালার। চাল তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। প্রথম স্তরে বারোটি রত্ন, দ্বিতীয় স্তরে আটটি রত্ন, তৃতীয় স্তরে চারটি রত্ন এবং সবার ওপরে বৃহত্তম রত্ন বা শিখর। এই মন্দিরটির বাইরেও আবার দুপাশে দু সারিতে সাতটি করে মোট চোদ্দটি মন্দির। তার মধ্যে মূল মন্দিরের ঠিক পাশের দুটি পঞ্চরত্ন সম্বলিত, আর বাকি বারোটি আটচালা মন্দির। প্রবেশপথের তিনটি আর্চ ও পংখের কাজ দৃষ্টিনন্দন। ১৮১৩ সালে দেওয়ান রামনিধি মিত্র মুস্তাফি এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করান। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এর সামনে দ্বিতলবিশিষ্ট প্রবেশপথটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
শোনা যায়, এই গেটের দ্বিতল থেকেই অতিথিদের সম্মানে ডঙ্কা বাজানো হত। ১৯৬৮ সালে এই মন্দিরগুলির সংস্কার সাধন হয়েছে। তবে অতীতে এদের গায়েও টেরাকোটার কাজ ছিল সম্ভবত, সংস্কার সাধনের নামে যা ঢাকা পড়ে গেছে। মন্দিরের কাছে একটি শ্বেতপাথরের ফলকে মিত্র মুস্তাফি পরিবারের বংশলতিকা দেওয়া আছে। আর বর্তমানে আগাছার জঙ্গল দেখলে এদের প্রতি অবহেলার পরিমাণ অনুমান করা যায়। এই মন্দিরের পাশের পুকুরের ধার ঘেঁষে হাটলে লক্ষ্মীদাস মিত্র মুস্তাফির ঠাকুর দালানের ভগ্নাবশেষ চোখে পড়ে। ইওরোপিয়ান ধাঁচে নির্মিত সুউচ্চ কিছু কলাম, আর্চ আর তাতে প্লাস্টারের কাজ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এর অদূরে নিস্তারিণী কালী মন্দির। দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটিও নবরত্ন মন্দির। ১৮৪৭ সালে কাশীগতি মিত্র মুস্তাফি এটি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এটিরও সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরের সম্মুখভাগের আটটি দীর্ঘ কলাম ও টালির আচ্ছাদন অভিনবত্বের দাবী রাখে। কলোনিয়াল স্থাপত্যের প্রভাব এর গঠনে সুস্পষ্ট। মন্দিরটি আসলে একটি কলোনিয়াল স্থাপত্যের বাড়ির ওপর রত্নের সমাবেশ। গাছপালার মধ্যে জাগ্রত এর রত্ন ও শিখর। দূর থেকে দেখলে এটিকে ইওরোপিয়ান দুর্গ মনে হয়। এই মন্দিরটির ক্ষেত্রেও একই ইতিহাস, কেবলমাত্র মূল মন্দিরটিই টিকে আছে। চার কোণের চারটি থাম ছাড়া নাটমন্দিরের আজ আর কোনো চিহ্ন নেই।
গ্রামের পাশ দিয়ে একদা গঙ্গা প্রবাহিত হতো, বর্তমানে তার গতিপথ বদলে নদী বহু দূরে সরে গিয়েছে। পড়ে আছে শুধু দিগন্ত বিস্তৃত নদীখাত, কিছু নৌকার অবশেষ ও নদীর ধারে এক প্রকাণ্ড বটগাছের ছায়ায় সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। ১৭৮৫ সালে এর নির্মাণ। এটি সুখারিয়ার প্রাচীনতম মন্দির হলেও তার অবয়বে কোথাও সেই ছাপ নেই। এক শিখর বিশিষ্ট সমতল ছাদের এই মন্দির। অন্য মন্দিরগুলির সাথে এর কোনো সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। অনবরত সংস্কারের ফলে চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পূর্ণ হারিয়েছে। চত্বরে তুলসি মঞ্চ নজরে আসে।
অতীতে এ গ্রামে আরো কিছু শিবমন্দির, রাস মঞ্চ ও দোল মঞ্চও ছিল, কালের গর্ভে তা আজ সবই বিলীন হয়ে গেছে। পুরো এলাকার মালিকানা একদা ছিল মিত্র মুস্তাফিদের হাতে। এখনো যেটুকু সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়, তা তাঁদের উদ্যোগেই। সরকারি কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। একটি অনাথ আশ্রম, একটি দাতব্য চিকিৎসালয় এই পরিবারের অনুদানে আজও সচল।
মিত্র মুস্তাফি পরিবারের কেউই এখানে আর বসবাস করেন না। কিন্তু দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে তাঁরা ফিরে আসেন ভদ্রাসনের টানে। রাধাকুঞ্জের যেকটি ঘর এখনো কোনোমতে টিকে আছে, সেগুলি জনসমাগমে মুখর হয়ে ওঠে। তারপর আবার যে কে সেই, নিঝুম গ্রাম, পাখির ডাক, মন্দিরে ছাগলছানার অবাধ বিচরণ, গ্রামের ঘরে ঘরে হস্তচালিত তাঁতের শব্দ। সেসব নিয়েই সুখারিয়া গ্রাম আকাল নয়, সুকালের সন্ধানেই জেগে থাক।