পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২ আগস্ট নবান্নে এক সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেন যে রাজ্য আরও ৭ টা নতুন জেলা পেতে চলেছে। দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া ও বাঁকুড়ার সঙ্গে ভাগ হতে চলেছে শতাব্দী প্রাচীন বাঙালি জাতির ঐতিহ্য বহনকারী জেলা মুর্শিদাবাদ। এই নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন, আবার কেউ এর বিরোধিতা করেছেন। তবে তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক না কেন বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে এই জেলার ঐতিহ্য যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না।
এই জেলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেবের সময়ে। রাজা শশাঙ্ক খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়ের অধিপতি ছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। এর অবস্থান ছিল বর্তমানের মুর্শিদাবাদ জেলায় বহরমপুরের কাছে। বিশ এবং একুশ শতকের বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বহরমপুরের কাছে কয়েকটা জায়গায় খননকার্য চালান। এই জায়গাগুলো হল রাজবাড়িডাঙা, রাক্ষসীডাঙা ও নীলকুঠি। প্রায় প্রত্যেকবারই এই তিনটে জায়গা থেকে উদ্ধার হয়েছে সেই পুরনো সময়ের বিভিন্ন মূর্তি, মুদ্রা, সিলমোহর, ফলক ইত্যাদি। এসবের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল কর্ণসুবর্ণ মহাবিহারের (বিশ্ববিদ্যালয়) আবিষ্কার। ২০১০ সালে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যৌথভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে রাক্ষসীডাঙ্গার দক্ষিণদিকে খননকার্য চালায় এবং এই মহাবিহারের ধ্বংসস্তূপ আবিস্কার করে। বলা বাহুল্য ঐতিহাসিক চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে এই মহাবিহারের উল্লেখ করেছিলেন।
গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের পরে আসে পালবংশের কাল। পাল বংশের রাজা দেবপালের পরে সফলভাবে তৎকালীন বঙ্গকে শাসন করেন রাজা মহীপাল (প্রথম মহীপাল)। তিনি তাঁর রাজধানী তৈরি করেন এই মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি অঞ্চলে। এরপর বাঙালির ইতিহাসে মুর্শিদাবাদের যে উল্লেখযোগ্য ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় তার জন্য পাল বংশের পরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ভারতের মোগল সাম্রাজ্য আমলের কাছে।
আরও পড়ুন নকশাকথা: বহুবার পাল্টায় নকশা, জাতীয় পতাকার বিবর্তনের ইতিহাস অবাক করার মতো
ভারতে মোগল সাম্রাজ্য শুরু হওয়ার কিছু আগে তৎকালীন গৌড়ের অধিপতি ছিলেন সুলতান হুসেন শাহ। কিছু ঐতিহাসিকের মতে সেসময়ে গুরু নানকের একজন ভক্ত এই শহর তৈরি করেছিলেন যার নাম ছিল মখ্সুদন দাস বা মুখ্সুদন দাস। তিনি এই শহর তৈরি করে তার নাম দিয়েছিলেন মখ্সুদাবাদ (বা আকাঙ্খার শহর)। পরে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার দেওয়ান কর্তলব খান তাঁর রাজস্ব আদায়ের কার্যালয় ঢাকা থেকে এখানে স্থানান্তরিত করেন। হুসেন শাহ এনার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হন এবং এনাকে নতুন নাম উপহার দিয়ে ভূষিত করেন। তারপর থেকে কর্তলব খান ইতিহাসে পরিচিত হন মুর্শিদ কুলি খান নামে এবং তাঁর নামেই মখ্সুদাবাদ নামটা পাল্টে হয়ে যায় মুর্শিদাবাদ।
এরপর মুর্শিদাবাদ ধীরে ধীরে বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। শুরু হয় বাংলার নবাবী শাসনের স্বর্ণযুগ। মুর্শিদ কুলি খানের পর বাংলার ইতিহাসে উঠে আসে এক একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, নবাব আলীবর্দি খান, নবাব সিরাজদ্দৌল্লা, মীরজাফর, মিরকাশিম, আজিমউন্নিসা বেগম, ঘসেটি বেগম প্রমুখ। যারা বাংলার মসনদে বসেছেন, বাংলা শাসন করেছেন অথবা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য ইতিহাসে সুনাম বা দুর্নাম কুড়িয়েছেন। তবে তথ্য ও পুঁথিবদ্ধ এই নিরস ইতিহাসের পাশাপাশি সেখানকার নানা স্থাপত্য এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে সমানভাবে। বলা বাহুল্য, মুর্শিদাবাদ বলতেই আমাদের মাথায় যে দর্শনীয় স্থানের চিত্রগুলো ভেসে ওঠে সেগুলো হল হাজারদুয়ারি প্রাসাদ, ইমামবাড়া, কাটরা মসজিদ, মোতিঝিল, পলাশী, কাঠগোলা বাগান, নশিপুর রাজবাড়ি ইত্যাদি। স্থাপত্যগুলো আজকের বাঙালির কাছে তাদের ইতিহাসে হাতছানি দেওয়ার সূত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আরও কয়েকটা দিক থেকে মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। তা হল বিদেশীদের আগমন। একসময় বাংলার এই অঞ্চল যে ভারতের একটা অন্যতম রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে আগত বিভিন্ন বিদেশী জাতির ইতিহাস দেখলে। ব্রিটিশদের পাশাপাশি এই জেলায় ফরাসি, ওলন্দাজ এবং আর্মেনীয় জাতির মানুষরাও এসেছিলেন। শুধু যে এসেছিলেন এমনটাই নয়, তারা কেউ এখানে ব্যবসা করেছেন, কেউ প্রত্যক্ষভাবে বাংলা তথা দেশের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন আবার কেউ বসতি স্থাপন করেছেন। যেমন, বহরমপুরের কাছে সৈদাবাদের আর্মেনিয়ান চার্চ সেখানে একদা তাদের বসবাসের ইতিহাস বহন করে চলেছে। ১৬৬৫ সাল থেকে আর্মেনীয়দের এই অঞ্চলে আগমন এবং ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাদের এই চার্চ গঠন। এই চার্চের প্রাঙ্গণে অনেক আর্মেনীয়কে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
ওলন্দাজরা বহরমপুরের কাশিমবাজারের কাছে কালিকাপুর নামক স্থানে ব্যবসা করত। এই তথ্য পাওয়া যায় কাশিমবাজারের ডাচ সমাধিক্ষেত্র দেখলে। লর্ড কর্ণওয়ালিশকেও এখানে সমাধিস্থ করা হয়।
ফরাসীরা যে মুর্শিদাবাদে এসেছিল তা এখনও বোঝা যায় একটা নাম দেখে। সৈদাবাদের কাছে গঙ্গার তীরবর্তী একটা জায়গার নাম এখনও ‘ফরাসডাঙা’। আমরা জানি পূর্বে চন্দননগরেরও এই একই নাম ছিল এবং যার কারণ সেখানে ফরাসি উপনিবেশ ছিল।
এই ঐতিহাসিকতা ছাড়াও, মুর্শিদাবাদের মাটি জন্ম দিয়েছে মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (দাদাঠাকুর), রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মনীশ ঘটক, আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিধায়ক ভট্টাচার্য, সৈয়দ মুজতবা সিরাজ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, প্রণব মুখোপাধ্যায়, মীর আফসার আলি, অরিজিৎ সিং প্রমুখ বাঙালিদের যারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালি জাতির নাম উজ্জ্বল করেছেন এবং করে চলেছেন। সবশেষে, স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। মুর্শিদাবাদ জেলা বাঙালির যে এই সুপ্রাচীন ইতিহাস ধারণ করে আছে, জেলা ভাগ হলে এবং এই নাম মুছে গেলে কি আদৌ এই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ থাকবে নাকি মুর্শিদাবাদ নামের সঙ্গে মিশে থাকা এই ঐতিহাসিক সূত্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে? যদিও এই প্রশ্নের উত্তর এখনও বহু সূক্ষ্ম তর্ক এবং আলোচনার দাবি রাখে।
সূত্র: 'Magnificent Murshidabad', Prithwiraj Chaudhuri,
'রক্তমৃত্তিকা- প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ জনপদ', জয়ন্ত ভট্টাচার্য