ভোর পাঁচটায় উঠে সাড়ে ছ'টার মধ্যে নিজের ১৬ বছরের কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা লেদার কম্পলেক্সের বানতলা থেকে ময়দানের দিকে রওনা দেন পরমেশ হালদার। যে করেই হোক, আটটার মধ্যে পৌঁছতে হবে, স্যার বলে দিয়েছেন। দেরি হলে শুধু যে রাম বকুনি খেতে হবে তাই নয়, শেখাও কম হবে, সেটা আরও বড় লোকসান।
Advertisment
নিজের ২২ বছরের সদ্য গ্র্যাজুয়েট কন্যার জন্য মাঠের একপাশে অপেক্ষা করছেন রুমা মিত্র। দৃঢ়স্বরে বলেন, "আজকাল যা দেখি চারপাশে, পেপারে পড়ি, মেয়েদের নিজেদেরই নিজেদের রক্ষা করতে হবে। কারোর ওপর ভরসা করার কী দরকার? আমার মেয়ে যাতে একাই লড়তে পারে, তাই ওকে এনেছি এখানে।"
বছর ৩৮ এর অনসূয়া চক্রবর্তী পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, অফিস সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে। বক্তব্য, "প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরি, যখন চারপাশ একেবারে ফাঁকা, চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। কতরকম বিপদ হতে পারে, ভেবে ভয় করে। সেই ভয় কাটাতে এখানে এসেছি।"
Advertisment
বয়স বা শারীরিক সক্ষমতা নয়, আসল ব্যাপার হলো উৎসাহ। ছবি: শশী ঘোষ
এঁরা সবাই যেখানে এসেছেন, ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের উল্টোদিকে সেই পুলিশ অ্যাথলেটিক ক্লাবের মাঠে তখন আন্দাজ ২০০ জনের ভিড়। প্রায় সকলেই মহিলা, বয়স ১২ থেকে ৪০-এর মধ্যে। কখনও একসঙ্গে, কখনও বিভিন্ন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গিয়ে, নানারকম কঠিন কসরত করে এই নারীবাহিনী যে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তার কোনও পোশাকি নাম নেই। তবে প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের এসিপি কৃষ্ণেন্দু পাল বলছেন, একে 'স্ট্রিট ফাইটিং' বলা চলে, মূলত কিক বক্সিং এবং কিছু মার্শাল আর্টসের মিশ্রণ।
'তেজস্বিনী' প্রশিক্ষণ শিবিরে আপনাকে স্বাগত। শহরের পথেঘাটে, এমনকি নিজেদের বাড়িতেও, মহিলারা যাতে শারীরিক হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেন, সেই লক্ষ্যে কলকাতা পুলিশের বিশেষ উদ্যোগ। গত বছরের মে মাসে চালু হয় 'তেজস্বিনী', এবং মেলে অভূতপূর্ব সাড়া। তার ভিত্তিতেই ফের একবার ২৩ থেকে ২৭ নভেম্বর 'কমিউনিটি পুলিশ' শাখার দায়িত্বে আয়োজিত হয়েছে প্রশিক্ষণ কর্মশালা, যেখানে একেবারে বিনামূল্যে ১২ থেকে ৪০ বছর বয়সী মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেবেন কলকাতা পুলিশের অভিজ্ঞ ট্রেনাররা।
এবারের কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে কলকাতা পুলিশের ওয়েবসাইটে নাম লিখিয়েছিলেন প্রায় ৬০০ আগ্রহী প্রার্থী (যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গতবারও অংশগ্রহণ করেছিলেন), কিন্তু অতজনকে একসঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতন পরিকাঠামো এখনও তৈরি হয় নি, যার ফলে 'ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভড' ভিত্তিতে আমন্ত্রণ পেয়েছেন ২০০ জন। যাঁরা বাদ পড়লেন, তাঁদের হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। এবার থেকে আরও অনেক ঘনঘন আয়োজিত হবে 'তেজস্বিনী' প্রশিক্ষণ শিবির, জানাচ্ছেন অতিরিক্ত নগরপাল (৪) সুপ্রতিম সরকার, যাঁর দেখভালে রয়েছে 'কমিউনিটি পুলিসিং' শাখা।
সত্যিই কি মাত্র পাঁচদিনে কিছু শেখানো যায়? বিশেষ করে আমার-আপনার মতো অতি সাধারণ মহিলা বা মেয়েদের, যাঁদের না আছে শারীরিক ফিটনেস বলতে কিছু, না নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস? সকাল আটটা থেকে দশটার মধ্যে এই কর্মশালায় হাজির হলেই উত্তর পেয়ে যাবেন। শক্ত মাটির উপর শুয়ে বসে গড়াগড়ি খেয়ে, সারা গায়ে ধুলো মেখে, রীতিমত ঘেমে নেয়ে অনুশীলন করছেন সকলে, হাসিমুখে। পান থেকে চুন খসলেই জুটছে কৃষ্ণেন্দুবাবু বা তাঁর পুরুষ ও মহিলা সহকারীদের কড়া তিরস্কার, কিন্তু একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে ফের প্রথম থেকে শুরু করছেন সবাই।
কৃষ্ণেন্দুবাবু নিজেই উদাহরণ দিয়ে বলছেন, "গতকাল প্র্যাকটিসের সময় একটি মেয়ের নাক থেকে অল্প রক্ত বেরোয়। সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। এমন নয় যে কাঁদতে বসে গেল।" বস্তুত, শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি মানসিক কাঠিন্য গড়ে তোলাও এই শিবিরের লক্ষ্য। "এখানে যাদের দেখছেন, কেউই প্রায় এর আগে কোনোরকম এক্সারসাইজ পর্যন্ত করে নি, মার্শাল আর্টস তো দূরের কথা, কিন্তু দেখুন কী উৎসাহ সবার।"
মার্শাল আর্টসের মারপ্যাঁচ শেখা শুধু নয়, তৈরি হয় মানসিক কাঠিন্যও। ছবি: শশী ঘোষ
বিভিন্ন ধরনের মার্শাল আর্টস থেকে বেছে নেওয়া নির্দিষ্ট কিছু মারপ্যাঁচ শেখানো হচ্ছে অংশগ্রহণকারীদের, যাঁদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ক্যারাটে বা টায়েকন্ডোর অভ্যাস রয়েছে। যেমন ১৫ বছরের আফিনা সালাউদ্দিন, যার 'ক্যারাটে স্যার' তাকে বলে দিয়েছেন এখানে আসতে। রোগা, ছোটখাটো মেয়েটি সোৎসাহে বলে, "আমার বন্ধুরাও এসেছে কয়েকজন। পরের বার আরও বেশি আসবে। খুব ভালো লাগছে এখানে, কারণ ঠিকঠাক টেকনিক জানলে গায়ের জোরই যে সব নয়, সেটা শিখছি।"
হাতাহাতি লড়াইয়ের নানারকম কায়দা শেখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, 'গুড টাচ' এবং 'ব্যাড টাচ'-এর তফাৎ, এমনকি নিজেদের আইনি অধিকার সম্পর্কেও মহিলাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করবে এই কর্মশালা।
তবে পাঁচদিন পর কী হবে? উত্তরটা দিলেন অনসূয়া, "নিজেদেরকে প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে হবে। আমরা যতটা খাটছি, ততটাই খাটছেন আমাদের ট্রেনাররা। আমরা যদি অভ্যাস না রাখি, তবে তো পুরোটাই মিথ্যে হয়ে যাবে।"