টাইগার হিলের ওপরে ছিলেন সেপাই সতপাল সিং। প্রাণপণ যুদ্ধে চেষ্টা করছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি-আক্রমণ রুখতে। লড়াইয়ে তাঁর হাতে নিহত হন নর্দার্ন লাইট ইনফ্যান্ট্রির ক্যাপ্টেন কারনাল শের খান সমেত চারজন।
টাইগার হিলের ওপরে ছিলেন সেপাই সতপাল সিং। প্রাণপণ যুদ্ধে চেষ্টা করছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি-আক্রমণ রুখতে। লড়াইয়ে তাঁর হাতে নিহত হন নর্দার্ন লাইট ইনফ্যান্ট্রির ক্যাপ্টেন কারনাল শের খান সমেত চারজন।
পাঞ্জাবের সাঙ্গরুর জেলার ছোট শহর ভবানীগড়। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত ৪৬ বছর বয়সী হেড কনস্টেবল সতপাল সিং। কিন্তু একটু ঠাহর করে তাঁর উর্দিটা দেখলেই বুঝবেন, ইনি কোনও সাধারণ ট্র্যাফিক পুলিশকর্মী নন। শার্টের ওপর চার সারি মেডেল এবং ফিতে, যাদের মধ্যে একটি আধা নীল-আধা কমলা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীর চক্র।
Advertisment
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে কার্গিলের টাইগার হিলের ওপরে ছিলেন সেপাই সতপাল সিং। প্রাণপণ যুদ্ধে মরিয়া চেষ্টা করছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি-আক্রমণ রুখতে। এই লড়াইয়ে তাঁর হাতে নিহত হন নর্দার্ন লাইট ইনফ্যান্ট্রির ক্যাপ্টেন কারনাল শের খান সমেত চারজন। পরে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান নিশান-এ-হায়দারে ভূষিত হন শের খান। বরফঢাকা পাহাড়চুড়োয় তাঁর অসমসাহসিক শেষ লড়াইয়ের সাক্ষী ছিলেন যে ভারতীয় ব্রিগেড কম্যান্ডার, তাঁর সুপারিশের ভিত্তিতেই এই সম্মান।
সতনাম ছিলেন ৮ শিখ টিমের দুজন অফিসার, চারজন জেসিও (জুনিয়র কম্যান্ডিং অফিসার) এবং ৪৬ ওআর (আদার র্যাঙ্কস)-এর অন্তর্ভুক্ত, যাঁদের কাজ ছিল টাইগার হিল পুনরুদ্ধার করতে ১৯ গ্রেনাডিয়ারদের সাহায্য করা।
Advertisment
টাইগার হিলের হেলমেট এবং ইন্ডিয়া গেট পোজিশনের ওপর পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রাণ হারান ১৮ জন সৈনিক, যাঁদের মধ্যে ছিলেন তিনজন জেসিও। প্রানে বেঁচে গিয়েও কমবেশি জখম হন দলের সবাই, দুই অফিসার মেজর রবীন্দ্র পারমার এবং লেফটেন্যান্ট আর কে শেখাওয়াত সমেত।
কার্গিল যুদ্ধের পর তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের সঙ্গে সতপাল সিং।
"আমরা আমাদের পোজিশনে পৌঁছে যাই ৫ জুলাই, ১৯৯৯-এর সন্ধ্যেয়। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা, অথচ আমাদের পরনে যা ছিল, তা ছাড়া কোনও বাড়তি জামাকাপড় নেই। হয় এক্সট্রা গরম কাপড় নিতে পারতাম, নয় এক্সট্রা হাতিয়ার আর গোলাবারুদ। কোনটা বেছে নিয়েছিলাম বুঝতেই পারছেন," বলেন সতপাল।
৭ জুলাই আসে প্রথম পাকিস্তানি প্রতি-আক্রমণ, ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে যায় ভারতীয় সেনা। "একের পর এক আক্রমণ আসছিল। একটা থামাই, তো আরেকটা আসে। পাকিস্তানিদের যিনি অফিসার, খুব ভালো অফিসার ছিলেন।" এদিকে ভারতীয়দের অফিসার এবং জেসিও-রা ততক্ষণে আহত, দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুবেদার নির্মল সিং, যিনি নিজেও জখম, কিন্তু ওয়্যারলেসে যোগাযোগ বজায় রাখছেন ব্রিগেড কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম পি এস বাজওয়ার সঙ্গে।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনের হাতে বীর চক্রে ভূষিত হচ্ছেন সতপাল
সতপালের কথায়, "মাথায় সরাসরি গুলি লেগে মারা যান সুবেদার সাহেব, কিন্তু তার আগে আমাদের বলে যান, আমরা যেন (৮ শিখের জয়ধ্বনি) 'বোলে সো নিহাল সৎ শ্রী আকাল' বলে শত্রুসেনা এবং তাদের নেতৃত্বে যে অফিসার ছিলেন, তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি এলএমজি (লাইট মেশিন গান) চালাতে চালাতেই চারটে গুলি খাই। এরপর শুরু হয় হাতাহাতি লড়াই। একজন লম্বা চওড়া, ট্র্যাকস্যুট পরা লোক ওদের লিডার ছিলেন, তাঁর ওপর লাফ দিয়ে পড়লাম আমি। চারদিকে তখন তুলকালাম চলছে, দু'পক্ষই লড়তে লড়তে তুমুল গালাগালি করছে একে অন্যকে। ওই অফিসারকে মারি আমি।"
সতপাল তখন জানেন না, তাঁর হাতে নিহত অফিসারের নাম ক্যাপ্টেন করনাল শের খান। "আমি চারজনকে মারি - ওই অফিসার, তাঁর রেডিও অপারেটর, এবং তাঁকে কভার করা দুজন জওয়ান।" ওই অফিসারের মৃত্যুতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা। সতপাল বলেন, "আমরা দেখেছিলাম কীভাবে উনি (শের খান) লিড করছেন দলকে, 'ফায়ার-অ্যান্ড-কভার' করে করে বারবার আক্রমণ করছেন আমাদের। ভালো লড়েছিলেন।"
সতপালের প্রাক্তন ব্রিগেড কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার বাজওয়া বলেন, "আমি সুপারিশ করেছিলাম যেন সতপালকে টাইগার হিলে ওর অসাধারণ সাহসিকতার জন্য পরমবীর চক্র দেওয়া হয়। পরে বীর চক্র পায় ও।"
সেনাবাহিনীতে তাঁর মেয়াদ শেষ করে ২০০৯ সালে ছুটি পান সতপাল। পরের বছর যোগ দেন পাঞ্জাব পুলিশে। "হয়তো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বীর চক্র পাওয়ার কোনও সুবিধেই পাই নি। প্রাক্তন সৈনিক কোটায় জয়েন করেছিলাম। এখন হেড কনস্টেবল হয়েছি," এখন বলেন সতপাল। "যেসব খেলোয়াড়রা মেডেল জেতেন, তাঁদেরকেও এর চেয়ে উঁচু পদে নেওয়া হয়। আমি এমন একজনকে মেরেছি যাঁকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিলিটারি সম্মান দেওয়া হয়েছে। তবু বলব, ঈশ্বর দয়াময়। আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন। একটাই দুঃখ, আমার এমএ পাশ করা ছেলেটা এখনও বেকার।"