Advertisment

করোনা, ঘূর্ণিঝড় ও নিমাইয়ের বৌ

ওই যে পুঁটি, ওই যে ল্যাটা। কতদিন পর এত লোক হাততালি দিচ্ছে। মুখে মাস্ক। হাসিটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সবাই হাসছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
'Tin Chokka Putt': Special column by Animesh Baisya on impact of corona man woman relationship

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় অনিমেষ বৈশ্যের বিশেষ কলাম।

নিমাইকে দেখলাম মাছ ধরছে। সাতসকালেই। পরনে লুঙি। খালি গা। হু হু বাতাসে কেত্তনের তারসপ্তকের মতো কাঁপছে নিমাইয়ের পাঁজরা। মুখে অবিশ্যি মাস্ক আছে। নিমাইয়ের সঙ্গে আরও তিন-চারটে কচিকাঁচা। পুকুরের ধারে মাঠ। কাল বিকেলেও ছিল খটখটে। আজ পুকুরের জল উপচে মাঠও পুকুর। সেই মাঠে মাছ ঘুরছে। ল্যাটা, কই, তেচোখা। নিমাইয়ের হাতে জাল। স্রোতের দিকে জালটা ধরে রেখেছে। তাতেই উঠছে দু'একটা মাছ। মাছ যত, লোকও তত। বহুদিন পর এত লোক জড়ো হয়েছে। উদোম গা। দু'একটা মাছ উঠছে আর সবাই হাততালি দিচ্ছে। ওই যে পুঁটি, ওই যে ল্যাটা। কতদিন পর এত লোক হাততালি দিচ্ছে। মুখে মাস্ক। হাসিটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সবাই হাসছে। নিমাইকে বললাম, 'কটা মাছ পেলে?' মাস্ক সরিয়ে হাসল নিমাই। যেন এতদিন গারদে ছিল। রাতের ঝড়বৃষ্টি জেলের গরাদ ভেঙে দিয়েছে। নিমাই বলল, 'ওই পেয়েছি খান কতক। এ বেলাটা চলে যাবে। দু'মাস পর ঘর থেকে বেরোলাম। উফফ। কাল রাতে কী ঝড় গেল। ঠাকুরদার জন্মের মাসে নাকি এরকম ঝড় হয়েছিল। ঠাকুরদার নাম ছিল ঝড়েশ্বর।' নিমাই হেঁপো রোগী। দমকে দমকে কাশে। ঠান্ডা হাওয়ায় কাশিটা বেড়েছে। কিন্তু তাতে কী! হাঁটু দুটো বুকের কাছে ঠেকিয়ে মাছ ধরেই চলেছে। নিমাইয়ের টিনের চালা কাল উড়ে গেছে। ঘর বেআব্রু। ঘরে যুবতী বৌ। কাল তিন-চারটে ছেলে ঘরে এসে বলল, 'সে কী গো। আবার যদি বৃষ্টি নামে তা হলে তো ঘর ভেসে যাবে। পলিথিন আছে? পলিথিন? পঞ্চায়েতের গজানন মিত্র বলছিল ওর কাছে ত্রিপল আছে। রিলিফের মাল। অনেক আছে গুদাম ঘরে।' নিমাই বলেছে, 'দরকার নেই।' ছেলেগুলো মুখ শুকনো করে বলল, 'তা তোমার ভালো করতেই এসেছিলাম। তুমি গাঁয়ের লোক। ভাবলাম যাই দেখে আসি।' নিমাই জানে, ওরা কেউ ভাঙা ঘর দেখতে আসেনি। দেখতে এসেছিল ওর বৌকে। নিজে যদি পলিথিন জোগাড় করতে পারে তো ভালো, না হলে ইস্কুলে গিয়ে উঠবে রাতে। এখন তো কই, ল্যাটা ধরি খান কতক। এতদিন পর এত লোক দেখে ভালো লাগছে নিমাইয়ের। এত হাওয়া, এত পাখির ডাক কতদিন শোনেনি। সেই যে পুলিশ এসে বলে গেল, 'ঘর থেকে বেরোলে ঠ্যাং ভেঙে দেব। একে তো হেঁপো রোগী। করোনা ধরলে আর বেঁচে ফিরবে না।' মরতে বড় ভয় নিমাইয়ের। বৌ মালতীর দিকে তাকায়। ভরা বুক। উঠোনের গন্ধরাজ গাছটা ফুলে ভরে আছে। কোকিল এখনও যায়নি মুলুক ছেড়ে। আর ঘর ছেড়ে বেরোয়নি নিমাই। ঘরেই রয়েছে। এমনকী মালতীকে একটু নাড়াঘাঁটাও করেনি দুমাস। একদিন ধরতে গিয়েছিল। ছিটকে সরে গেছে মালতী। তাতে নাকি করোনা হয়। কে জানে।!

Advertisment

আরও পড়ুন: ঈদ হোক বা পুজো, করোনা আতঙ্কে উৎসব বিমুখ দুই বাংলাই

মাঠের ধারে গুঁইরাম পালের বিরাট বাড়ি। সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছ। ফলন্ত আমের গাছ খান তিনেক। কৃষ্ণচূড়াটা গোড়া সুদ্ধ উপড়ে পড়েছে। আমের ডাল ভেঙেছে খান কতক। কাঁচা আম ঝুলছে। পালগিন্নি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আম ছিঁড়ে নিচ্ছে। নিমাইয়ের হাসি পেল। গামলার জলে ল্যাটা মাছটা ছেড়ে দিয়ে সে তাকাল পালগিন্নির দিকে। কতদিন নিজের বৌ ছাড়া অন্য কাউকে দেখেনি। পালগিন্নি বলল, 'নিমাই গাছটা কেটে দিবি? হাজার টাকা পাবি।' হাজার টাকার লোভ সামলাতে পারল না নিমাই। হাজার টাকা অনেকদিন চোখেই দেখেনি। সেদিন বাজারে হাঁসের ডিম দেখে বড় লোভ হয় নিমাইয়ের। বহুদিন ডিম খায়নি। লাল কুসুম। হাঁসের ডিমে নাকি তাকত বাড়ে। কিন্তু কুড়ি টাকা জোড়া শুনে উল্টো মুখে হাঁটা লাগিয়েছিল। পালগিন্নি ভাঙা ডাল থেকে আম ছিঁড়ছে। কী যেন ঝড়টার নাম? আমফান নাকি আমপান? আমের সময় বলেই কি এই নাম? হবে হয়তো। অত কিছু সে জানে না। নিমাই বলল, 'হ্যাঁ, কাটব। কুড়ুলটা নিয়ে আসি।' সে কুড়ুল নিয়ে এল। উপড়ে পড়া কৃষ্ণচূড়ার ডাল ফুলে ভরে আছে। নিমাইয়ের কী মনে হল কে জানে, সে কোপ দিতে গিয়েও দিল না। ফুলগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা কাঠবিড়ালি মরা গাছের শিকড়ে ঘুরছে। টিক টিক টিক টিক। সে কুড়ুলটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড় লাগল বাড়ির দিকে। পালগিন্নি অবাক। ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেল। তিনি ডাকলেন, 'আরে এই নিমাই, নিমাই।' নিমাই কিছু শুনল না। ডাকুক গিয়ে পালগিন্নি। মেঘ ঘিরে এসেছে। ঘরের চালা নেই। আকাশ যা দেখার দেখুক। মালতী নিশ্চয় ছিটকে সরে যাবে না।

corona virus amphan Tin Chokka Putt
Advertisment