Advertisment

জোটের আমি জোটের তুমি, জোট দিয়ে যায় চেনা

গান্ধী পরিবার যদি ভোটের আগে বন্দ্যোপাধ্যায়ে বন্ধু খুঁজে পায় তাহলে রাজ্য কংগ্রেসকে কাপড় জুটিয়ে মাথা ঢাকার জন্যে নতুন করে চরকা সংগ্রহে পথে নামতে হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Modi Mamata Left Congress Equation

রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনে প্রার্থী না দেওয়ার পথেই হাঁটতে চলেছে সিপিএম-এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট।

লোকসভা ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে। গোটা ভারতের আসন সংখ্যার হিসেব নিকেশ কী হতে পারে তা নিয়ে সমীক্ষা শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যেই। দেশজোড়া বিজেপি বিরোধী লড়াইতে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তৃণমূল। জানুয়ারি ১৯-এর ব্রিগেড কিংবা ফেব্রুয়ারি ৩-এর সিবিআই বনাম কলকাতা পুলিশ দ্বন্দ্ব তৃণমূল-বিজেপি তরজাকে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাজনীতির দুটো বিষয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত - এক, স্বকীয় বৈপরীত্য আর দুই, সদা পরিবর্তনশীল সত্য। সেই হিসেবে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যে যেমন নেতানেত্রীদের আনাগোনা আছে, তেমনই আছে নীতির মিল এবং অমিল।

এক সময়ে তারা দল হিসেবেও একজোট ছিল, আজ বিপরীতমুখী। সুতরাং কেউ যদি কখনও সাদাকে লাল বলে থাকে, সেই হিসেবে আজকের সবুজ আর গেরুয়া মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলে দোষের কিছু নেই। অর্থাৎ বাম-কংগ্রেসের অভিযোগ অনুযায়ী তৃণমূল আর বিজেপির লড়াই কতটা সত্যি আর কতটা যুদ্ধু যুদ্ধু খেলা সেই নিয়ে ধন্দ থাকবেই। ফেব্রুয়ারীর তিন তারিখ থেকে শুরু হওয়া “ক্যান রে ব্যাটা ইসটুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট!” এর উত্তর পেতে পেতে হয়ে গেল সাত। অর্থাৎ পাঁচ দিনের মাথায় (সাত থেকে তিন বিয়োগ করলে চার হয়, কিন্তু তিনকে বাদ দিলে তো আর চলবে না) মোদী সাহেব জানালেন, তৃণমূল সুপ্রিমোর ঊনবিংশ ব্রিগেডে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির সঙ্গে আপস করবেন না তিনি, প্রতারকদের শাস্তি হবেই। ঠিক যেন “ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটা পাবে আজ এখনি!” গোছের জবাব।

Advertisment

বেজায় হুলো সিবিআই ঠিক কীভাবে ফাঁদ পাতছে সে খবর সংবাদমাধ্যমের পাতায় গিজগিজ করছে। সাতের সন্ধেতেই নয় তারিখে প্রশ্নোত্তরের দিন ঘোষণা। কী কী প্রশ্ন আসতে পারে সে নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনী মাধ্যমিকের সাজেশন বই বার করে ফেলছে চটজলদি। ভোটবসন্তে বেকার ভাতার সুনামি ছড়ানো কেন্দ্র রাজ্য জনমুখী বাজেট পর্যন্ত সেই ভিড়ে নিতান্তই বইমেলায় হারিয়ে যাওয়া অবলা শিশু। এই লড়াই করতে করতে লোকসভা ভোটটা এসে গেলে মোটামুটি নিশ্চিন্ত। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গের বিয়াল্লিশ আসনেই তৃণমূলের জেতার সম্ভাবনা যথেষ্ট, তার মধ্যে দু তিনটে যদি ফসকে যায় সেগুলো বিজেপির হাতে যাওয়াই সবথেকে মঙ্গল। অতঃপর নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে ঠিক হবে কে কোন দিকে যাবে আসবে। সে আড়ি-ভাব ঠিক হবে মশলা খেয়ে। নারদা-সারদা নয়, সুকুমার রায় 'নারদ নারদ' লিখেছিলেন অনেকদিন আগেই। আর সে কবিতার শেষে কাউকে পুলিশ ডেকে গারদে ঢোকানো হয় নি, কারণ রাজনীতির মূল সুর তো সম্প্রীতি - "শেকহ্যান্ড আর দাদা বল, সব শোধবোধ ঘরে চল"।

আরও পড়ুন, কে লেখে মমতার চিত্রনাট্য?

তৃণমূল আর বিজেপির এই সম্পর্কের দিকে তাকালে মনে পড়বে বেশ কয়েক দশক আগে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের মিথোজীবিত্বের কথা। রাজ্যে চুটিয়ে শাসন করেছে বামেরা আর কেন্দ্রে কংগ্রেস। রাজ্যের তুমুল ঝগড়া খুব বেশি প্রভাব ফেলে নি দু'দলের সর্বভারতীয় শীর্ষ নেতৃত্বের বোঝাপড়ায়। তাইতো দক্ষিণপন্থী বিজেপির ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শেষ পর্যন্ত নতুন সহস্রাব্দে দ্বৈত ঢাক আর গুড় বাদ দিয়ে কেন্দ্রে বাম সমর্থনে পরপর দুবার কংগ্রেস সরকার গড়েছে, যার তিন অক্ষরের নাম ইউপিএ। তখনও রাজ্যে কংগ্রেস আর তৃণমূলের জোট কখনও ভাঙছে, কখনও জুড়ছে। তবে তৃণমূল আর কংগ্রেস মিলে ২০১১ তে ক্ষমতায় আসার পর থেকে কে কোন দলে বোঝা বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিল।

সমব্যথীরা বুঝবেন, সে জন্যে এই দুই দলকে দোষ দেওয়া যায় না, কারণ দুটোই অতীতে একই বৃন্ত ছিল, পরে তো দুটি কুসুম। তবে তৃণমূল রাজত্বে হঠাৎ করে কিছু কংগ্রেস নেতার মনে হল শাসকের সঙ্গে থাকলে রাজ্যে নিজেদের দলটারই নাকি আর অস্তিত্ব থাকবে না। তাই কংগ্রেস বাঁচাতে ২০১৬ বিধানসভায় একজোটে লড়ল বাম আর কংগ্রেস। সংগঠন ভিত্তিক বামেদের ভোট মসৃণভাবে চলে গেল কংগ্রেসের দিকে। আর বামেদের ওপর বিরক্ত এক বড় অংশের কংগ্রেস সমর্থকরা ভোট পাচার করে দিলেন তৃণমূলের দিকে। সব মিলিয়ে বামেদের ভোট শতাংশ আরও কমল, কিছু আসন বেড়ে গেল কংগ্রেসের।

বামেদের নেতৃত্ব রেগেমেগে তার পরের কিছু পাড়া নির্বাচনে একা লড়ে উত্তপ্ত আত্মশ্লাঘায় মাখন মাখালেন। একটু ঠাণ্ডা হতে বিধি বাম বুঝে আবার সামনের লোকসভায় কংগ্রেসের সঙ্গে আপাত আঁতাতের পথ খোঁজা শুরু। আর কংগ্রেস রাজ্যজুড়ে দশ শতাংশের নীচে ভোট নিয়ে মান অভিমানের খেলায় “কে প্রথম কাছে এসেছে” গোছের মুখ করে বামেদের ডাকের অপেক্ষায়।

রাজ্যনেতা বদলের পর কংগ্রেসে এখন জেলা সভাপতি বদলের ধুম, নদিয়ায় কে জেলার নেতা হবেন তাই নিয়ে ইমেল যাচ্ছে রাহুল গান্ধীর কাছে। কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতা কৃষকদের ঋণ মুকুব করে মাটির কাছাকাছি, তাই তাঁকে চিঠি লেখার জন্যে বামনকে চন্দ্রযানে চড়াতে হয় না। এদিকে যে দু-একজন সাংসদ তৃণমূল-বিজেপি দ্বৈরথের মধ্যে কংগ্রেসকে এক আধখানা আসনের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন, তাঁরাও হাঁটা দিচ্ছেন তৃণমূলের দিকে। যাঁরা তৃণমূলের কাছে মাথা নোয়াতে রাজি নন, তাঁদের কাছেও আসন ধরে রাখার জন্যে বাম-কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপির ভরসা সম্ভবত বেশি। মরণশীল মানুষ তো সুযোগ পেলে এদিক ওদিক যাবেই, কিন্তু চিরন্তন দল? সেখানেও বৈপরীত্যের শেষ নেই। সারদা নিয়ে কেন্দ্র আর রাজ্য কংগ্রেস সম্পূর্ণ উলটো মেরুতে। গান্ধী পরিবার যদি ভোটের আগে বন্দ্যোপাধ্যায়ে বন্ধু খুঁজে পায় তাহলে রাজ্য কংগ্রেসকে কাপড় জুটিয়ে মাথা ঢাকার জন্যে নতুন করে চরকা সংগ্রহে পথে নামতে হবে।

আরও পড়ুন, মমতাকে ফোনে রাহুল গান্ধী কী বলেছেন? প্রশ্ন ‘ছোড়দা’র

বামেদের সমস্যা একটু ভিন্ন, এবং ভাষা গুরুগম্ভীর। পার্টি দলিলে লেখা হবে, 'পরিবর্তিত আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিটব্যুরোর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর কেরলে বামেরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, পশ্চিমবঙ্গে তাদের পক্ষে, আর সারা ভারতে মেহনতী মানুষের লড়াইয়ের পাশে'। এই কংগ্রেসকে হারাতেই একবার বামফ্রন্ট আর বিজেপি ভি পি সিংহের বাম আর দক্ষিণদিকে সামিল হয়েছিল।

সব মিলিয়ে রাজনীতির সবটাই একে অন্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের সম্ভাবনা। সময়টাকে একটু চেপ্টে কাছাকাছি নিয়ে এলে, কিংবা কোন দল কোন দলকে সমর্থন করছে সেটা পাশাপাশি ফুটকি এঁকে জোড়া লাগালে, অথবা কেউ একদল থেকে অন্যদলে গিয়ে নিজেকে বাঁচালে, সবকিছুই মিলেমিশে একাকার। তখন তৃণমূল আর বিজেপি কাছে না দূরে ভেবে সময় নষ্ট করতে হবে না, মণিপুর আর তামিলনাড়ুর দুটো রাজ্যস্তরের দলকেও আলাদা করতে কষ্ট হবে। এটাই তো ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। দলে ভাগ হয়ে যেমন কখনও বিশ্বকাপ আবার কখনও ক্লাবের হয়ে খেলা যায়, ভারত অস্ট্রেলিয়া তীব্র যুদ্ধ যেমন মিলেমিশে যায় আইপিএলে, রাজনীতিও ঠিক তেমনই।

তবু লং মার্চে হাঁটেন কৃষকেরা, পায়ে ফোস্কা পড়বে জেনেও; ফেব্রুয়ারির শুরুতে ব্রিগেড ভরান পাহাড়তলি থেকে শহরতলি পৌঁছনো স্বতঃস্ফূর্ত বাম সমর্থকেরা, লোকসভায় রাজ্য থেকে আসন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম সেটা বুঝেও; শীতের ভোরে খাকি হাফপ্যান্ট পরে লাঠি ঘোরান আরএসএস-এর সদ্য দেশপ্রেমিক, বেশি দামে রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা হবে শুনেও।

ঠিক সেই সংসদীয় নিয়মেই সামনে লোকসভা নির্বাচন। ভোটযন্ত্রের আঁচে নিজেদের সেঁকবো সবাই। জোটজল্পনা ছেঁকে অঙ্ক কষা হবে ভোট শতাংশ আর জয়ীকে সবটুকু উজাড় করে দেওয়া সংসদীয় আসনের। তবু নতুন সরকার ক্ষমতা দখলের পর কোন এক প্রৌঢ় নাগরিক নব্বইয়ের দশকে কলেজ জীবনে শোনা কবিতার দুলাইন সামান্য বদলে নিয়ে বলবেন, “লোকসভা ভোট শেষে জোট শোধবোধ, ফাঁকা মাঠে থ্যাঁতলানো আপাত বিরোধ।"

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment