শিয়ালদা থেকে বেলেঘাটা মেন রোড ধরে যেতে যেতে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের কাছে চোখে পড়ে অ্যাসবেস্টস দিয়ে তৈরি একটা বড় দরজা, যার উপরে লেখা ‘Parsi Tower of Silence’ তার নীচে বাংলায় স্পষ্ট করে লেখা - পারসি টাওয়ার অফ সাইলেন্স ‘কবর স্থান’। এই নাম দেখে বোঝা যায় এটা পার্সিদের শেষকৃত্য করার পবিত্র স্থান। একটু গুগল সার্চ করলে বা কিছু বাংলা লেখা পড়লে অনায়াসেই এর সম্বন্ধে জানা যায় যে এখানে পার্সিরা তাঁদের সম্প্রদায়ের কোনও মানুষের মৃতদেহ সৎকার করার জন্য নিয়ে আসেন। এবং আরও জানা যায় যে সেই সৎকার পদ্ধতি কী বীভৎস, মানুষের দেহ খোলা আকাশের নীচে চিল-শকুনকে অর্পণ করা হয় যাতে তারা এই দেহ খেয়ে তৃপ্ত হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এর পিছনে আছে শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস এবং এই জনগোষ্ঠীর মানুষের বিশ্বাস। প্রশ্ন জাগে আজকের এই ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়েও কী কলকাতার পার্সিরা এই আচার পালন করছে বা করতে পারছে? নাকি ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’ বর্তমানে সাইলেন্ট হয়ে গেছে? আসুন, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একটু খুঁজে দেখা যাক।
পার্সিদের এই শেষকৃত্য প্রথার কথা জেনে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান-সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের একটু অবাক হতে হয় বৈকি। কারণ তাঁরা হয় মৃতদেহকে আগুনে পোড়ায় নাহলে মাটিতে কবর দেয়। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে মৃতদেহকে খোলা আকাশের নীচে চিল-শকুনের খাদ্য হিসাবে রেখে তার সৎকার করার এই প্রথা একটু আলাদা। এবং এই প্রথার প্রচলন আছে আমাদের কলকাতার মধ্যেই, এ কথা জানতে পেরে আরও চমকিত হয়ে যেতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আচার, হরেক রকম প্রথা। একথাও তো অস্বীকার করা যায় না।
কবে থেকে পার্সিরা আসা শুরু করলেন আমাদের এই কলকাতায়? প্রথমে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। তথ্যের ইতিহাস বলছে এই শহরে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পার্সিদের আবির্ভাব হয়। তৎকালীন সুরাট থেকে দাদাভাই বেহ্রামজি বানাজি প্রথম এই শহরে আসেন এবং তারপর থেকে একটু একটু করে তাঁদের জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই শহরের ভৌগলিক অবস্থান আর পাটের ব্যবসা পার্সিদের এখানে আসার জন্য আকৃষ্ট করে। এবার প্রশ্ন হল এই ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’ কবে তৈরি হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে উনিশ শতকে। বিখ্যাত পার্সি সোরাবজি পরিবারের অন্যতম সদস্য নওরোজি সোরাবজি বেঙ্গলি কলকাতার পার্সি সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম এক ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালের ২৮ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বেলেঘাটায় (তৎকালীন বেলিয়াঘাটা) এই ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’ –এর উদ্বোধন হয়। একে পার্সিরা তাদের ভাষায় বলে ‘দাখ্মা’। গোটা পূর্ব এশিয়ায় এটাই পার্সিদের প্রথম ‘দাখ্মা’ বা শেষকৃত্যের স্থান। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হওয়া একটা লেখায় ঐতিহাসিক অশোক ভট্টাচার্য লিখছেন “আজও সুদূর রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, মালয় থেকে পার্শীদের শবদেহ বহন করে আনা হয় এই কলকাতায়, কলকাতার এই নিস্তব্ধ গম্বুজটির শীর্ষে।” অতএব বোঝা যাচ্ছে গত শতকেও পার্সি জনসমাজে বেলেঘাটার এই ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’-এর গুরুত্ব কতখানি ছিল।
আরও পড়ুন স্বাধীনতার পরেও কলকাতায় উড়ত ব্রিটিশ ‘ইউনিয়ন জ্যাক’!
এই স্থানের সঙ্গে যুক্ত আছে পার্সিদের শতাব্দী প্রাচীন বিশ্বাস। জরাথ্রুস্টিয় ধর্মমতে বিশ্বাসী এবং আগুনের উপাসক পার্সিরা বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পরে এই মানবশরীরকে তাদের প্রকৃতি মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াটাই কর্তব্য। আগুনে পোড়ালে শরীরের রোগ-ব্যাধি পরিবেশে মিশতে পারে, জলে ভাসিয়ে দিলে জল দূষিত হয়ে পরিবেশ ও অন্য প্রাণের ক্ষতি হতে পারে এবং মাটিতে কবর দিলেও মাটি দূষিত হতে পারে। এই ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে তারা শবদেহকে এমন কোনও উঁচু জায়গায় রেখে আসে যেখানে চিল, শকুন বা অন্য কোনও প্রাণী সেই দেহের সৎকার করে এবং নিজেদের তৃপ্ত করে। সবশেষে পড়ে থাকে শুধু কঙ্কাল, যা কালের নিয়মে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। এই বিশ্বাস থেকেই পার্সিরা কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলকে বেছে নেয়। কারণ আজকে সে জায়গা জনবহুল হলেও একসময়ে সেখানে ছিল ঘন জঙ্গল। এবং সেখানে সত্যিই নিস্তব্ধতা ছিল।
পার্সিদের এই সৎকার প্রথার মধ্যে আরও কয়েকটা নিয়ম আছে। এই নিয়মগুলো সম্পর্কে কলকাতানিবাসী পার্সি পার্ল তারাপুরের বক্তব্য একটু পড়ে নেওয়া যাক। তার সঙ্গে ইংরাজিতে হওয়া কথাবার্তার বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় এরকম- “কেউ মারা গেলে প্রথমে তাঁকে নিয়ে আসা হয় ‘রাভাঙ্গা’ (Ravangah)তে, এখানে সৎকারের আগে শেষ প্রার্থনা করা হয়। এই ‘রাভাঙ্গা’তে সবাই যোগদান করতে পারেন; এমনকি যারা পার্সি নন তাঁরাও। এরপরে দেহ নিয়ে যাওয়া হয় ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্সের’ দিকে যেখানে শুধুমাত্র পার্সিরাই থাকতে পারেন এবং তারপরে একসময়ে যাঁরা সেই দেহকে সৎকার করাবেন তাঁরাই সঙ্গে যেতে পারেন। যাঁরা শবদেহ সৎকার করান তাঁদেরকে বলা হয় ‘পল বিয়ারার’ (Pall Bearer)। যাজক যখন থেকে প্রার্থনা শুরু করেন তখন থেকেই শুরু হয় দেহকে ধুয়ে ফেলার কাজ। সঠিকভাবে ধোওয়া শেষ হলে সেই দেহকে ঢেকে দেওয়া হয় মস্লিন কাপড়ে। আর তাঁকে উপরে সাদা রঙের বেনিয়ান আর নীচে সাদা রঙের পাজামা পরানো হয় এবং একটা প্রার্থনার পর তার সঙ্গে আরও কয়েকটা জিনিস যোগ হয়। এসব মিটলে দেহকে পল বিয়ারাররা অন্তিম সৎকারের দিকে নিয়ে যায়।”
শুধু এই নয়। মৃত্যুর পরে পার্সিরা আয়োজন করে প্রার্থনার এবং সেখানে তৈরি হয় একটা বিশেষ খাবার। পার্লের কথায় “মৃত্যুর চার দিন পর আয়োজন করা হয় ‘চারম্’ (Chaaram)। সেদিন প্রার্থনা হয়ে যাওয়ার পরে পরিবেশিত হয় ‘মাটন ধানশাক’ (Mutton Dhanshak)। বাধ্যতামূলকভাবে ‘মাটন ধানশাক’ই তৈরি হতে হবে সেই দিনে। এর রীতি হচ্ছে কেউ এটা তৈরি করবে আর সেই পরিবার এটা খাবে। সেই পরিবার যদি চায় তাহলে তারা কাউকে নিমন্ত্রণ করতে পারে। যেহেতু ধানশাক ‘চারম্’-এ বানানো হয় তাই এই খাবার খেতে খুব সুস্বাদু হলেও এটা অন্য কোনও আনন্দের উৎসবে বানানো বা পরিবেশন করা যায় না।”
তাই পার্সিদের ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’-এর সঙ্গে কেবলমাত্র চিল-শকুনের শবদেহ খাওয়ার বীভৎসতা নেই। সে সঙ্গে আছে তাদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস আর নানান আচার ও প্রথা। সবশেষে প্রশ্ন হল এখনও কী এই একইভাবে পার্সিরা এই প্রথা পালন করছে? বা করতে পারছে? নাকি তারা কোনও বিকল্প পথ খুঁজে নিচ্ছে। কারণ এখন আর বেলেঘাটায় নিস্তব্ধতা নেই। চারিদিকে গজিয়ে উঠেছে ফ্ল্যাট, বাড়ি, হয়েছে বড় বড় রাস্তা, যার উপর দিয়ে দিনরাত ছুটে চলেছে শ’য়ে শ’য়ে গাড়ি। এই বিষয়ে পার্লের বক্তব্য, “যুগ যুগ ধরে আমরা এই বিশ্বাস করে এসেছি যে আমরা আমাদের পরিবেশকে দূষিত করব না। যে কারণে আমরা এই নিয়মে দেহ সৎকার করি। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। ওই জায়গার আশেপাশে অনেক মানুষ থাকতে শুরু করেছে। তারা অভিযোগ করতে শুরু করেছে যে এইভাবে সৎকারের ফলে দুর্গন্ধ উঠছে এবং আরও অন্য অসুবিধা হচ্ছে। তাই বিভিন্ন গবেষকদের পরামর্শ নিয়ে আমরা বিকল্প পথও খোঁজা শুরু করেছি। ঠিক করা হয়েছে যে যিনি মারা গেছেন তিনি তাঁর সৎকারের কোনও উপায় বলে বা লিখে গেছেন কিনা, বা তাঁর পরিবার কী ঠিক করেছে। পরিবর্তিত সময়ের কথা মাথায় রেখে এখন আমাদের সমাজ থেকে সেই কথামতো সৎকার করা হয়।”
সূত্র: ভট্টাচার্য, অশোক, ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’, রমাপদ চৌধুরী (সম্পা.), ‘অচেনা এই কলকাতা’
Banerjee, Himadri (Ed.), ‘CALCUTTA MOSAIC: Essays and Interviews on the Minority’