Advertisment

মাঝে মাঝে মূর্তি ভেঙে পড়াই ভাল

একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। হিন্দুরা কি বাস্তবিকই মূর্তির পূজা করে? উত্তর হল, "না।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Amader Rajniti

অলংকরণ- অরিত্র দে

মূর্তিপূজক হিসেবে হিন্দুরা জগতে পরিচিত। নিরাকার একেশ্বরবাদীদের চোখে প্রথাটি হাস্যকর, যদিও মান্য ব্যক্তির মূর্তি শহরের চৌরাস্তার মোড়ে অথবা পার্কে প্রতিষ্ঠা করার সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছেন প্রধানত ইউরোপীয়রাই। এই প্রথাটি হাস্যকর নয়, কারণ এটা যাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন, তাঁদের অভ্যাসগুলোকে শ্রদ্ধা করতেও আমাদের শেখানো হয়েছে। এই পদ্ধতিতে মূর্তি হতে পারা মরণশীল মানুষেরা মাতা মেরী বা যীশুর তুল্য না হলেও তার একধাপ নীচের আইকন হয়ে ওঠেন। ক্রমশ ছোট বা বড় মাপের দেবতা হয়ে ওঠেন শেক্সপীয়ার, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর বা টলস্টয়। এঁরা লৌকিক দেবতা, রাজ আজ্ঞায় নির্বাচিত নন। একইভাবে রাজার পছন্দানুযায়ী নির্দিষ্ট দেশে উপাস্য মূর্তি হয়ে উঠতে পারেন লেনিন থেকে ইন্দিরা গান্ধী বা বল্লভ ভাই পটেল।

Advertisment

রাজনৈতিক দেবমূর্তিদের উপস্থিতি ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে   অনেক বেশি প্রভাবশালী (imposing), কিন্তু শত্রুসেনার দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও মূলত এঁদেরই। লৌকিক দেবতারা কাউকে ভয় দেখান না, সাধারণের কাছ থেকে বছরে একবার দুটো ফুলমালা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। ক্ষমতার হস্তান্তর হলেও সাধারণত কেউ এঁদের মূর্তি ভাঙে না, যদি তারা এলাকার সাধারণ মানুষকে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। একমাত্র যদি বিজেতা বিজিত অঞ্চলের কৃষ্টিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে বা বদলে ফেলতে চায়, তাহলেই এসব মূর্তি ভাঙা হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে এই দ্বিতীয় ধরণের প্রচেষ্টা অপ্রত্যাশিত ছিল।

আরও পড়ুন, বিদ্যাসাগরের ভাঙা মূর্তি ও বর্ণপরিচয়: দ্বিতীয় ভাগ

ইদানীং অবশ্য লৌকিক দেবমানবদের রাজনৈতিক ভূমিকা বদলাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাঁদের মূর্তিগুলির রাজনৈতিক তাৎপর্যও। একেক রাজনৈতিক গোষ্ঠী কোনো এক মূর্তিমানবকে নিজেদের নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এমনকি নিজেদের অভ্যাস বা দর্শনের সমর্থনেও তাঁদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করছেন। স্বাভাবিকভাবেই সেইসব মান্যবর ও তাঁদের মূর্তিরা বিপক্ষের শত্রু হয়ে উঠছেন। কপিরাইট উঠে যাবার পর জনপ্রিয় প্রয়াত লেখকদের বই ছাপিয়ে লাভের কড়ি ট্যাঁকে গুঁজতে যেমন প্রকাশকদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, তেমনি মৃত্যুর পর "মহামানব"দের লিগ্যাসি নিজের দখলে আনার লড়াই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। দখল সম্ভব না হলে ধ্বংস করো, অথবা ধ্বংস করা অসম্ভব হলে কোনোভাবে ঐতিহ্যকে নিজের বলে দাবি করো। দুটো প্রক্রিয়ারই প্রধান সুবিধে হল, মৃত মানুষ বাধা দিতে পারে না।

একটু ভুল বলা হল। মৃত মানুষের তরফ থেকেও বাধা আসতে পারে অনৈতিক বা অযৌক্তিক দখলদারি এবং হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে, যদি সেই মানুষ মূর্তির বাইরেও বেঁচে থাকেন। তাঁর হয়ে বাধা দিতে পারে তাঁর দর্শন, কর্ম, যদি তা বর্তমান সময় ও প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে পারে, যদি তার প্রকৃত উত্তরাধিকারী বেঁচে থাকে সমাজে। যদি সাধারণ মানুষ নিজেদের লৌকিক নরদেবতাদের বাঁচিয়ে রাখে নিজেদের ভেতরে, তাহলে এই দুই ধরণের আক্রমণ (বেদখল বা ধ্বংস করার চেষ্টা) থেকেই তাঁরা রক্ষা পেতে পারেন।

আরও পড়ুন, তর্ক এবং ঝগড়া: ভোটপর্ব যা দেখাচ্ছে

এই পর্যায়ে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। হিন্দুরা কি বাস্তবিকই মূর্তির পূজা করে? উত্তর হল, "না।" কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না তো? ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি মন্দির বা প্যান্ডেল, সর্বত্র মূর্তিরা পূজা পাচ্ছে। মূর্তির সামনে হাত জোড় করেছি। এভাবে মূর্তি-মূর্ত গুলিয়ে গেছে আমদের মগজে এবং সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মূর্তি, তা সে দেবতার হোক বা মানুষের। তাহলে আমার অবিশ্বাসযোগ্য উত্তরটির ভিত্তি কী? পূজার পদ্ধতি একটু মন দিয়ে খেয়াল করলেই তা বোঝা যাবে।

হিন্দুরা বিগ্রহকে দেবতা ভাবেন না, তাঁর চিহ্ন বা আধার ভাবেন। পূজারি সেই বিগ্রহে দেবত্ব আরোপ করেন, মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। দেবতার আবাহন করে মূর্তিটিকে অবলম্বন করে আসলে সেই দেবতার পূজা করা হয়। পূজার শেষে ঘট নেড়ে দিলেই মূর্তির দেবত্ব শেষ, তখন তা স্রেফ মূর্তি মাত্র, যার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তখন সেই মূর্তিকে নদী বা পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। তার নাম বিসর্জন। আবাহনের বিপরীত বিসর্জন হলেও কাজদুটির মধ্যে তফাত আছে। আবাহন করা হয় দেবতার আর বিসর্জন দেওয়া হয় তাঁর পরিত্যক্ত মূর্তিটিকে। দেবতাকে কেউ জলে ফেলে দেয় না।

মূর্তির এই সীমাবদ্ধ ও প্রতীকী প্রয়োজনটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে আমাদের মূর্তি "ফেটিশ" খানিক সারতে পারে। সেটা না বোঝার ফলে আমরা দেবতাকে বিসর্জন দিয়ে মূর্তির উপাসনা করে চলেছি… ধর্মে, জীবনে এবং রাজনীতিতে। আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ এখন পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, কিছু গান, শান্তিনিকেতনের দোল আর পৌষমেলা ইত্যাদি। বিদ্যাসাগরের কর্মকাণ্ড আর জীবন দর্শন নিয়ে বাঙালি তথা ভারতবাসীর বিপুল উৎসাহ আমার জীবৎকালে চোখে পড়েনি। "বর্ণপরিচয়" স্কুল শিক্ষাক্রমে গুরুত্ব হারানোর পর থেকে তিনি নিছকই মূর্তিতে পর্যবসিত হয়েছেন। এমনকি সেই মূর্তি নিয়েও আমাদের বিরাট মাথাব্যথা ছিল না। এতদিন পর তাঁর মূর্তি ভাঙার ফলে আমরা জানতে পেরেছি যে বিদ্যাসাগর কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মূর্তি ছিল। সহসা জেগে উঠে আমরা তাঁর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার দাবি করছি। সেই যোগ্যতা আমাদের আছে কিনা, তাও ভাবা দরকার।

বস্তুত বিদ্যাসাগরের সমসময়ে বঙ্গসমাজ তাঁকে ধারণ করতে পারেনি। শেষ জীবন তিনি কাটান কর্মটাঁড়ে। পরবর্তীকালের বাঙালিও পারেনি বিদ্যাসাগরের লিগ্যাসিকে ধারণ করতে। এই দেবতাটির পূজা করার যোগ্যতা আমরা অর্জন করতে পারিনি। এখানে আবার পূজার পদ্ধতিটি ভালো করে বোঝা দরকার। পূজার আগে নানারকম নিয়মকানুন মেনে পূজারী "সবাহ্য অভ্যন্তরঃ শুচি" হয়ে নিজের মাথায়, মূলাধারের কাছে ফুল-টুল দেন দেখেছি। আসলে দেবতার উপাসনা করার উদ্দেশ্য হল তাঁর গুণগুলি আত্মীকরণ করা। নিজে দেবত্বে উত্তীর্ণ না হয়ে দেবতার পূজাও করা যায় না, তাই অত শুচি হবার, নিজের মাথায় ফুল দেবার ব্যবস্থা। তাই বিদ্যাসাগর দেবতার পূজা করার জন্যও জাতি হিসেবে, মানুষ হিসেবে কিছুটা উত্তরণের প্রয়োজন ছিল। সেটা না হলে মূর্তি থাকে, কিন্তু তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। তখন শুধুমাত্র মূর্তি ভেঙে একজন আইকনের প্রতিষ্ঠা নাড়িয়ে দেওয়া যায়।

মাঝেমধ্যে বোধহয় মূর্তিদের ভেঙে পড়া ভালো। না, আইকনোক্লাজমের দর্শনের ভিত্তিতে কিছু বলছি না। আমাদের দেশের বিসর্জনের সংস্কৃতিকে স্মরণ করেই বলছি৷ প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার পর মূর্তিকে বিসর্জন দিলে মূর্তির দেবতা হয়ে ওঠা রোধ করা যায়। বাস্তব হল, আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ বা বিদ্যাসাগরের প্রয়োজন এখনো ফুরায়নি। তাই এক্ষেত্রে প্রয়োজন ঠিক বিপরীত। মূর্তি ভেঙে গেলে তবেই আমরা দেবতাটির কথা আলোচনা করি, তাঁর অস্তিত্ব সম্বন্ধে পুনরায় সচেতন হই। এভাবে দেবতার মূর্তি হয়ে যাওয়া আটকানো যায়। প্রস্তরীভূত রবীন্দ্রনাথ বা বিদ্যাসাগর নন, জীবন্ত রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্যাসাগরকে আমাদের প্রয়োজন। মূর্তি তাঁদের প্রতীক মাত্র।

চোদ্দই মে বিদ্যাসাগর মূর্তিটি বাস্তবে কে ভেঙেছে, সেই সংক্রান্ত বাদানুবাদে আমার উৎসাহ কম। মূর্তি পেরিয়ে বিদ্যাসাগরকে ভাবা বেশি জরুরি মনে করি। অন্যান্য আইকনদের নিয়েও একইভাবে ভাবা প্রয়োজন। তাঁদের পাথর হয়ে যাওয়া এবং ভেঙে পড়া রোধ করার জন্য সচেষ্ট হওয়া দরকার। সে পথে  এগোনোর ব্যাপারে কোনো উৎসাহ চোখে পড়ছে না। যুযুধান দু'পক্ষই বিদ্যাসাগরের নতুন মূর্তি গড়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এ হল সমাজের বুকে বিদ্যাসাগরের রেজারেকশন হতে না দিয়ে তাঁকে পুনরায় মূর্তিতে বেঁধে ফেলার আয়োজন, কারণ জীবিত বিদ্যাসাগর ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ও শাসকের পক্ষে বিপজ্জনক।

দিলীপ ঘোষ বর্ণপরিচয় আর সহজ পাঠের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন বলে আমরা দারুণ মজা পেয়েছি। অথচ তাঁর কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়ঙ্কর প্রবণতা অথবা অবক্ষয়ের চিহ্নটি নজর এড়িয়ে গেছে। তিনি বিদ্যাসাগরকে নিছক একটি শিশুপাঠ্য পুস্তকের লেখক হিসেবে সীমায়িত করে ফেলতে চেয়েছেন। বইয়ের নাম শুধরে দিয়ে এবং ঠাট্টা করে  খুশি হবার মুহূর্তে আমরা মেনে নিচ্ছি যে বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র বর্ণপরিচয়ের জন্য বিখ্যাত। সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই, নারীশিক্ষার প্রসার, বিধবাবিবাহ প্রচলন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজগুলো সম্পূর্ণ চাপা পড়ে যাচ্ছে। এটাই ওঁরা চান, যাতে আমাদের মনে বেঁচে থাকেন এক অরাজনৈতিক বিদ্যাসাগর, যিনি প্রায় মূর্তির মতোই নিরীহ। রাজনৈতিক বিদ্যাসাগরের যা কর্মকাণ্ড ও দর্শন, তা বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং বিদ্যাসাগরকে বাঙালির (তথা ভারতবাসীর)  জীবন থেকে মুছে দিতে না পারলে তাঁরা চাইবেন শুধুমাত্র বর্ণপরিচয় প্রণেতা হিসেবে তাঁর খণ্ডিত সত্তাটুকুকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং তাকেই বিদ্যাসাগরের পূর্ণ অবয়ব হিসেবে তুলে ধরতে। এটা রিভিশনিজমের এক সুন্দর ব্যবহার। রাজ্যের শাসক দল কন্যাশ্রী প্রকল্পের সূত্রে বিদ্যাসাগরের সত্তাধিকার দাবি করতে পারেন বটে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁরাও জীবন্ত বিদ্যাসাগরের মুখোমুখি হতে চাইবেন না। দুই পক্ষের জন্যই নিরাপদ এক টুলো পণ্ডিত বা মূর্তিতে পর্যবসিত ঈশ্বর বাঁড়ুজ্জে।

বিদ্যাসাগরকে… বিদ্যাসাগরদের এভাবে পাথর হয়ে যেতে দেব, নাকি তাঁদের মূর্তিতে প্রাণসঞ্চার করব, সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। এখনই। সময় বেশি নেই।

আমাদের কলেজবেলায় এক নাগরিক কবিয়াল গেয়েছিলেন, "প্রাণে গান নাই মিছে তাই রবি ঠাকুর মূর্তি গড়া।"

মাঝেমাঝে সেসব মূর্তি ভেঙে পড়াই বোধহয় ভালো। সেই অভিঘাতে যদি প্রাণে গান আসে!

(কৌশিক দত্ত চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment