বিকেল বেলা পথ হাঁটতে গিয়ে ধস্তাধস্তি। ওদিকের পাঁচিলের ওপর দিয়ে সাতটা ঢিল, পাঁচটা ঢেলা, যোগ করলে হল বারো। আর রাস্তায় আটটা লাঠি। দুটো বাইক পুড়েছে, তিনটে সাইকেল, একটা স্কুটার। চারটে লোকের মাথা ফেটেছে। সব মিলিয়ে সতেরোটা সেলাই। মূর্তি ভেঙেছে মাত্র একটা। বাংলার বিদ্বজ্জন লাঠি গুনল না, পাটকেলের নামতা পড়ল না, সব আলোচনা গিয়ে ঠেকল বিদ্যাসাগরে। আচ্ছা বিদ্যাসাগরটা ঠিক কী? থুড়ি কে? বীরভূমে থাকে না গান্ধীনগরে? বাংলায় এতো লোকজন, কে যে বিদ্বজ্জন, কে যে সেলিব্রিটি, কে যে পুরনো মহাপুরুষ, এত কিছু মনে রাখতে গেলে ভোটটা করব কি করে? সাত দফা নির্বাচন এমনিতেই হেজে গেছে।
পরপর কাজ থাকবে, পটাপট ধমকি, দু-একটা বুথদখল, সাতটা মিছিলে দাদাগিরি। সবটা শেষ করে কোথায় মন্দারমণির ঠান্ডা ঘরে বসে কয়েকদিন বিশ্রাম নেব সে ফুরসতটুকুও নেই। অসহ্য গরমে অনন্ত এই নির্বাচন চটকাতে চটকাতে নিজের পিণ্ডিটাই (পিত্তি নয়) আঙুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে। তার মধ্যে আজকে রাস্তায়, কালকে আবার পাঁচিলের আড়ালে। আজকে ঢিল, কালকে ডাণ্ডা। সঙ্গে মাঝে মাঝে বন্দুক চালানোও জানতে হচ্ছে। দু এক জায়গায় নেতানেত্রীদের পাহারা দিতে গিয়ে হেলিকপ্টার চড়াও হয়ে যাচ্ছে কখনও সখনও।
আরও পড়ুন, একটি কাল্পনিক ভোটকথা
নির্বাচন করতে গিয়ে যা যা শিখতে হচ্ছে এরপর তো মার্কিন যুদ্ধবিমানে সেনাধ্যক্ষ হিসাবে চাকরি দিয়ে দেবে। কিন্তু মে মাসের চোদ্দ তারিখে কী ভাঙতে কী ভেঙেছি, তারপর পুরোটা গুবলেট। রাজ্যের সব থেকে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলগুলো পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে আগামী দুদিন বেশি হল্লা না মাচাতে। “চুপচাপ যে কোনও ফুলে ছাপ” শ্লোগান এখন বন্ধ। সময় কাটানোর জন্যে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে লাল ফিনফিনে মলাটওয়ালা চটি একটা বই। ভেবেছিলাম গুপ্তকথা মার্কা কিছু হবে। দুপুরে রুটি, তড়কা, কষা মুরগি আর ঠান্ডা মাছরাঙা সহযোগে সাঙ্গোপাঙ্গো জুটিয়ে গ্রন্থ সমালোচনা লিখব। তাকিয়ে দেখি সে বইয়ের নাম বর্ণপরিচয়! এটা পাঠরত অবস্থায় স্খালন করতে হবে মূর্তি ভাঙার অপরাধ।
গল্প শুনেছি সাতষট্টি থেকে সাতাত্তরের। মূর্তি নাকি সেই সময়েও ভাঙত। তবে সে মূর্তি যারা ভাঙত তারা অনেকটা পড়াশোনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিত। আমাদের সময় কম। মূর্তি তো শুনেছি বিভিন্ন দেশেই ভাঙা হয়। পড়ার অবসর হয় না, কিন্তু মুঠোফোনে টুকটাক যা দেখি তাতে লেনিন নামের একটা লোকের মূর্তিও তো ভেঙেছে বারবার। আর মূর্তি ভাঙলেই কিছুদিন হইচই। তারপর আবার সব ঠাণ্ডা। হাতে ধরে থাকা বোতলখানার মত। আর মূর্তি যারা ভাঙছে তাদের মধ্যে এত ভাগাভাগি করাই বা কেন? কেন আজকে রাস্তায় রোড শো করা কিংবা কলেজের মধ্যে থেকে ঢেলা ছোঁড়া যুবক যুবতীদের শ্রেণিবিভক্ত করা হচ্ছে অর্ধশতাব্দী আগের ভারি ফ্রেমের চশমা, রংচটা ফতুয়া, কাঁধে ঝোলা কাপড়ের ঝোলা-ওয়ালাদের সঙ্গে?
আরও পড়ুন, অভিজাতদের উচ্চারণ ভাঙিয়ে আসন জয়ের সম্ভাবনা কম
বিভিন্ন প্রকৃতির বামপন্থার হাত ধরে যে শিক্ষিত দল ক্ষমতায় এলো সাতাত্তরে, ২০১১ পর্যন্ত তারাই বা করলটা কী? শিশু বয়সে তাদের হয়ে খাটার অভিজ্ঞতা হয় নি। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পৌঁছতে পৌঁছতেই ২০০৮, যখন পঞ্চায়েত নির্বাচন বুঝিয়ে দিচ্ছে লাল পতাকা বর্ণপরিচয়ের প্রথম পাতার মতই ফ্যাকাসে। তাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে গেলে যে দলে যেতে হয় সেখানেই গেছি। কংগ্রেস থেকে ভেঙে বেরোনো দল তৃণমূল, ফলে সে হস্তান্তর ভোরবেলা কাক ডাকার মতই সত্য। সময়ের ডাকে রক্তগোলাপের পাতা ঝরিয়ে ততদিনে পেশিবহুল বাম নেতারা পৌঁছে গেছেন ঘাসফুলে। পরিবর্তনকে চলরাশি ধরে সেখান থেকে আজকে জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ, জলপদ্ম আর স্থলপদ্মর মত। আর আট বছরের রাজত্বে যে না পাওয়ার স্বাদ তেতো করছে জিভকে, সেখানে রাম-বাম একাকার।
তাই মাথা ফাটিয়ে সাদা ফেট্টি বাঁধব, নাকি মাথায় ফেট্টিবাঁধা মানুষগুলোর সঙ্গে থাকব, সেই ধোঁয়াশা থেকে মুক্তি পাওয়া শক্ত। তবে কোন এক শক্তিশালী দলের সঙ্গে থাকতেই হবে। নইলে সিন্ডিকেটের কাছে ধার করা ইঁট সিমেন্ট বালি দিয়ে ঘরের পাশে তৈরি হবে আর একটা বেঁটে স্মৃতি সৌধ। নেতাদের নির্দেশমত গেরস্ত লোকজনকে জানিয়ে দিয়েছি আজকে শহিদ বিদ্যাসাগরের সম্মানে সর্বদল সমন্বয়ের মিছিল, যেখানে থাকবেন সর্বধর্মের মানুষ। তাই তাদের বাড়ি থেকে বেরোনো নেই মোটে। আগে থেকে শাক-সবজি, ডিম-পাঁউরুটি-ঝোলাগুড়, আলু-পটল-ঝিঙ্গে-পোস্ত এরকম দৈনন্দিন জীবনের চেনা টুকরো গুলো সকাল সকাল গুছিয়ে রাখুন। আমাদের পথে নামতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। জীবিকার কারণেই আমরা অর্থের পক্ষে, শক্তির পক্ষে, ক্ষমতার পক্ষে। সেখানে বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ আর সরু গলিতে থাকা হরিপদ কেরানিকে আমাদের পক্ষে আলাদা করা শক্ত।
আরও পড়ুন, পায়ের ফাঁকে মিসাইল আর লেনিনকে এক ঘুষি
বরং আমাদের ধন্যবাদ দিন যে মানুষ মরে নি, মূর্তি ভেঙেছে মাত্র। চাইলে ভোট মিটে গেলে আবার একটা গড়িয়ে নেবেন। আপনাদের মত বুদ্ধিজীবীরা জানেন যে ভোট কেমন হবে ঠিক করে দিয়েছে মিডিয়া। আপনারাই সকাল বিকেল দেখছেন, শুনছেন, পড়ছেন রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপন। সেখানে আজকের বাংলায় দুটো দল ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি? আমাদের আপাতত এই দুটো দলের একটায় থাকতেই হবে। আজকের কোন তৃতীয় পক্ষের মিছিলে তাই আমাদের দেখবেন না। আমরা প্রথম দুই দলের জটলাতেই পাহারা দেব। আর কোনভাবে যদি ভোটে জিতে যায় তৃতীয় কোন দল?
আপনি স্বপ্ন দেখছেন মাত্র। তা যদি বাস্তব হয়? ভয় পাবেন না। দিন কয়েকের মধ্যে আমরা আবার ব্যবহৃত হব সেই অন্য দলে। থালা না থাকলে বর্ণপরিচয়ের পাতায় রাখব ফুলকো রুটি, তড়কার ঝোল গড়াবে ‘অ-আ-ক-খ’-র সরলরেখায়। তবে স্বপ্ন থাকবে কোনওদিন সত্যি হয়ত এই বাংলায় কোন রাজনৈতিক দল আমাদের প্রথম ভাগ পেরিয়ে দ্বিতীয় ভাগের যুক্তাক্ষরে পৌঁছে দিতে পারবে। “বর্ণবিভাগের সঙ্গে অর্থ শিখাইতে গেলে, গুরু, শিষ্য, উভয়পক্ষেরই বিলক্ষণ কষ্ট হইবেক, এবং শিক্ষাবিষয়েও আনুষঙ্গিক অনেক দোষ ঘটিবেক।”
আরও পড়ুন, স্বদেশি রাজনীতি, বিদেশি প্রচার
আপনারা তো সৎ সজ্জন শিক্ষিত মানুষ। যুক্তাক্ষর শিখেছেন অনেক দিন ধরে। বর্ণবিপর্যয় না ঘটিয়ে এই শহরে প্রার্থী দেখে ভোট দিন, দল নয়। যে মানুষেরা অন্তত বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগটা রুটি-তড়কা ছাড়াও চেখে দেখেছে। আমাদের কথা একটা দিন নাই বা ভাবলেন। অন্তত একটা দিন ভুল করে ভয় পেলেন না আমাদের। আমাদের অচেনা আবছায়া পেরিয়ে একদিন অন্তত ভোট দিন টিকি-দাড়ি না দেখে। তারপর সময় এলে আপনাদের কাছ থেকেই শিখব ভাঙা প্লাস্টার অফ প্যারিস আর বিদ্যাসাগরের মূর্তির সম্পর্ক — বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগ।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)