উইনস্টন চার্চিলকে মনে পড়ে যায়।
আইপিএল এবং বিরাট কোহলিকে নিয়ে লিখতে বসে মনে পড়ে যায় আজ থেকে আশি বছর আগে তৎকালীন রাশিয়াকে নিয়ে করা চার্চিলের মন্তব্য: "Russia is a riddle wrapped in a mystery inside an enigma"। রাশিয়া একটা ধাঁধা, রহস্যে মোড়া এবং ধোঁয়াশায় আবৃত।
বিরাট কোহলির আইপিএল পারফরম্যান্সও ঠিক তাই। ধাঁধা, রহস্য, ধোঁয়াশা। টেস্ট হোক বা ওয়ান-ডে বা টি-টুয়েন্টি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিনটে ফরম্যাটেই যাঁর ব্যাটিং গড় পঞ্চাশের বেশি, বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানের রাজমুকুট যাঁর মাথায় ঝলমল করছে, তিনি এবং তাঁর টিম আইপিএল-এ এভাবে খেই হারিয়ে ফেলে কী করে? এক-দু'বার নয়, বছরের পর বছর?
এই নিয়ে টানা ছ'বছর হল, আইপিএল অর্ধেক শেষ হওয়ার আগেই বিরাটের রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর দৌড় কার্যত শেষ। চলতি আইপিএল-এ টানা হাফ ডজন ম্যাচ হেরে যাদের নামই হয়ে গেছে 'হারসিবি'! অবস্থা এমন পর্যায়ে, বিরাট টিমের ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে শুধু ব্যাটিংয়েই মন দিন, এমন দাবিও উঠে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ওঠারই কথা। যাঁর নেতৃত্বে ভারত টেস্টে এক নম্বর, ওয়ান ডে-তে দুই, তিনি টানা ছ'বছর ধরে একটা ফ্র্যাঞ্চাইজির ক্যাপ্টেন থেকেও ট্রফি জেতা দূরে থাক, টিমকে প্লে অফে তুলতেই যখন ল্যাজে-গোবরে, নেতৃত্বের অধিকার নিয়ে কথা তো উঠবেই।
আইপিএল-এ কেন পারে না আরসিবি? কেন পারেন না কোহলি? ব্যাটসম্যান হিসেবে পাঁচ হাজারের উপর রান আছে তাঁর বারো বছরের আইপিএল-ইতিহাসে। ব্যর্থ কোনভাবেই নন ব্যাটসম্যান হিসেবে। কিন্তু ব্যক্তিগত সাফল্য দলগত উত্থানে কোন ভূমিকা না নিলে তো শেষ বিচারে মূল্যহীন হয়ে যায় সব হিসেব-নিকেশ। কেন হয় এমন, কেন হয়ে আসছে লাগাতার?
ক্রিকেটীয় অণুবীক্ষণের নিচে ফেললে আরসিবি-র হতশ্রী পারফরম্যান্সের মূল কারণটা কিন্তু বেরিয়ে আসে। আইপিএল-এর সফল দলগুলোর দিকে তাকান। চেন্নাই আর মুম্বই তিনবার করে ট্রফি জিতেছে। কলকাতা আর হায়দ্রাবাদ দু'বার করে। টিমলিস্ট ঘেঁটে দেখুন, চেন্নাই, মুম্বই বা কলকাতা কিন্তু নিজেদের 'কোর গ্ৰুপ' বা 'নিউক্লিয়াস' নিয়ে বেশি অদলবদল-পরীক্ষানিরীক্ষার রাস্তায় হাঁটেনি। ধোনির চেন্নাই যেমন। যতই বলা হোক 'ড্যাডিজ আর্মি', যতই বলা হোক বুড়োদের টিম, 'কোর গ্ৰুপ'-এ সেই ধোনি-রায়না-জাদেজা-মোহিত-ব্র্যাভো-ওয়াটসন। এবং তাঁদের নিয়েই সাফল্য।
মুম্বই? সেই পোলার্ড-মালিঙ্গা-বুমরা-পান্ডিয়া ব্রাদার্স। কেকেআর-ও তাই, উথাপ্পা-নারিন-কুলদীপ-চাওলা-রাসেল। টিমের ব্যালান্স বা ভারসাম্য মোটামুটি অক্ষত রেখে তবেই নিলামে বিদেশি তারকা বা তরুণ ভারতীয়দের জন্য ঝাঁপিয়েছে এই সফল ফ্র্যাঞ্চাইজিরা।
বিরাট অধিনায়ক হিসেবে দলে এই ভারসাম্যটা আনতে ব্যর্থ হয়েছেন এত বছর ধরে ক্যাপ্টেন থেকেও। গত কয়েক বছরে টিমে বড় বেশি কাটছাঁটের রাস্তায় গিয়েছেন, যেমন করে থাকেন টিম ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রেও। দেশের হয়ে খেলার সময় এই খামতিটা কিছুটা ঢেকে যায়। কারণ সবাই চেনেন সবাইকে, একে অন্যের সঙ্গে ঘরোয়া বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেকদিন ধরে খেলেছেন। কিন্তু যেখানে দেড়মাস ব্যাপী একটা টুর্নামেন্টে বিদেশের ক্রিকেটার খেলছেন, খেলছেন আনকোরা অনূর্ধ উনিশ বা জাতীয় টিম থেকে ছিটকে যাওয়া অভিজ্ঞ ত্রিশোর্ধ, সেখানে দল হিসেবে সবাইকে একসূত্রে বাঁধতে গেলে অধিনায়ককে অধৈর্য্য হলে চলে না। পরম যত্নে একটা কোর গ্ৰুপ তৈরি করতে হয়।
বিরাট সেই ধৈর্য্য, সেই যত্ন দেখাতে পারেন নি। নিলামে কোটি কোটি টাকা খরচা করেও ক্রিকেটার নির্বাচনে গলদ থেকে গিয়েছে। টিমটা আর 'টিম' হয়ে উঠতে পারেনি। দায় তো ক্যাপ্টেনকেই নিতে হবে।
একটা দীর্ঘ সময় ধরে গেইল-ডিভিলিয়ার্স-বিরাট, ব্যাটিংয়ে এই ত্রয়ীর উপর নির্ভর করে এসেছে আরসিবি। গেইল-বিদায়ের পর যাঁরা এসেছেন, মোটামুটি অশ্বডিম্বই প্রসব করেছেন। বোলিং চিরদিনের দুর্বল জায়গা বেঙ্গালুরুর। অথচ এক চাহাল ছাড়া কোনও ম্যাচ-উইনিং বোলার এত বছরেও তুলতে পারেন নি বিরাট। টিম ব্যাটে ২০০ প্লাস করলেও বিপক্ষ অনায়াসে রানটা তুলে দিয়ে গেছে বোলিংকে তুলোধোনা করে। এবারের টিমটাই দেখুন। সাইনি-সিরাজ এবং 'বর্ষীয়ান' সাউদি... এই পেস অ্যাটাক নিয়ে কখনও ডেথ ওভারে আটকানো যায় পাওয়ার হিটারদের, স্বপ্ন দেখা যায় ট্রফি জেতার?
আরও পড়ুন: সত্যিই কি অসভ্য বিরাট কোহলি?
এবং আশ্চর্য, সে অভিজ্ঞ বিদেশি হোন বা দেশজ কোন তরুণ তুর্কি, বেঙ্গালুরু থেকে অন্য টিমে যাওয়ার পর অনেকের সাদামাটা পারফরম্যান্স বদলে গিয়েছে রাতারাতি। উদাহরণ আছে একাধিক। এর একটাই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হয়। বিরাট ক্যাপ্টেন হিসেবে পারেন নি প্লেয়ারদের থেকে তাঁদের সেরাটা বার করে আনতে। যেটা করতে গেলে ভরসা রাখতে হয় সতীর্থদের উপর, একটা স্থিরতা আমদানি করতে হয় তাঁদের মানসিকতায়। বছর বছর টিমে গুচ্ছের বদল হলে কী করে আর স্থিরতা আসবে? সবাই কোহলির মতো জিনিয়াস নন। যাঁরা মাঝারি, তাঁদের 'ভাল', আর যাঁরা 'ভাল', তাঁদের 'খুব ভাল' হয়ে ওঠার সুযোগটা তো দিতে হবে। কোহলি দেন নি, নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাঁড়িপাল্লায় টিমের বাকিদের মাপতে গিয়ে ডুবেছেন।
কষ্ট হয় আরসিবি টিমটাকে দেখে। শুধু ছ'টা ম্যাচ পরপর হেরেছে বলে নয়, কষ্ট হয় টিমটার শরীরী ভাষা দেখে। জেতার বিশ্বাসটাই যেন ভল্টবন্দি করে মাঠে নামছে বিরাটের বাহিনী। মোক্ষম সময়ে রোজ একাধিক ক্যাচ পড়ছে। পরপর বিমার দেওয়ার জন্য পেসারকে সরিয়ে নিতে হচ্ছে ডেথ ওভারে। জেতা ম্যাচ কীভাবে হেরে আসতে হয়, তার লাইভ ডেমো চলছে যেন। এবং দিশেহারা বিরাট একের পর এক ভুল করে চলেছেন ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে। স্পিনিং উইকেটে হওয়া ম্যাচে পেসাররা সুবিধে করতে পারছেন না দেখেও ভুলে যাচ্ছেন, মইন আলি বলে কেউ একজন টিমে আছেন। কেকেআর ম্যাচে পবন নেগিকে খেলতে নাইটরা হিমশিম খাচ্ছে দেখেও দু'ওভার করিয়ে সরিয়ে নিচ্ছেন। রাসেলের মতো পাওয়ার হিটাররা বল ব্যাটে দ্রুত আসা পছন্দ করেন জেনেও।
কষ্ট হয় বিরাটকে দেখে। তিনি বিরাট কোহলি, দুনিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান, দিনের পর দিন যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখে মাঠ ছাড়ছেন হারের গ্লানি নিয়ে, কার ভাল লাগে দেখতে? সেদিন কমেন্ট্রি করতে গিয়ে সুনীল গাভাসকার মজার ছলে বলছিলেন, "আরসিবি যে প্লে অফ-এ যাচ্ছে না, ভালই হল একদিক থেকে। সামনে বিশ্বকাপ, ভারত তরতাজা অবস্থায় পাবে কোহলিকে।" রসিকতাই, কিন্তু কোন ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীর ভাল লাগে এসব শুনতে?
কখনও কখনও কী যে নিষ্ঠুর হতে পারে ক্রিকেট!