চারিদিকে শরৎ শেষ, হেমন্ত, কিংবা বসন্তের শুরুর পরিবেশ। বুথে ঢুকে কোনও রাজনৈতিক দলের এজেন্টকে খুঁজে পাওয়া যাছে না। এমনকি কোন সরকারি কর্মচারীও বসে নেই। ঘরটায় পৌঁছে গিয়ে একটা বিশেষ জায়গায় ভোটার কার্ড ঠেকালেই হাসিমুখে ঝকঝকে পর্দা ঘেরা ছোট্ট ঘরে দিকনির্দেশ করছে একটা রোবট। সেখানে শুধু ফুলের ছবি। পদ্ম, ঘাসফুল, সূর্যমুখী, গাঁদা, গোলাপ, জবা, ধুতরো ইত্যাদি। আর ফুলের সঙ্গে মিলেমিশে আছে বিভিন্ন প্রশ্ন। বোতাম জোরে টিপলেই রিনরিনে স্বরে কে যেন বলছে, "আঘাত করা উচিৎ নয় গণতন্ত্রের যন্ত্রে, বৈদ্যুতিন কণাদের কষ্ট হয়"। কয়েকবার আলতো আঙুল ছোঁয়ালেই কাজ সারা।
পাশের অন্য একটা যন্ত্র থেকে প্রথমে মুখ আর তারপরেই লেজ ঝোলাচ্ছে ছোট্ট চিরকুট। মাধ্যাকর্ষণের আকুল ডাক শুনে সে ডানা মেলে একটা হালকা হাফটার্নে ওপর থেকে নিচের বাক্সে ঢুকে যাচ্ছে টুক করে। জলে নয়, হাওয়ায় সার্কাস দেখাচ্ছে আর্কিমিদিসের সূত্র। ভোট শেষে বেরোনোর পথে বাইরে সাজানো সারি সারি ছোট ছোট দোকান। সেখানে স্মারক বিক্রি করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। একদিকে ছোট ছোট মাটির ভাঁড়ে দুব্বো ঘাসের সঙ্গে ঝুলে থাকা সাদা ফুল, তার একটু দূরে পদ্মের কত বাহার।
রাজনীতির অতীত আর বর্তমানের তুলনায় একদিকে তরমুজ, আর অন্যদিকে কুমড়ো। দুইয়েরই ওপরটা সবুজ, একটা কালচে, অন্যটায় সবুজের মাঝে উঁকি দিচ্ছে সামান্য সাদা ছোপ। ভেতরের লাল আর হলুদ পাশাপাশি কেটে রাখা, সময়ের সারণীতে দু-তিন দশকের ব্যবধানে। কে আবার একটা স্লোগান টাঙ্গিয়ে রেখেছে, 'কুমড়োর ভেতর হলুদ হয় না, ওটাই গেরুয়া'।
আরও পড়ুন: ব্যর্থ কে? কলকাতায় ফণী নাকি হুজুগে বাঙালি?
ভারতের মানচিত্র রেখে ভূগোলের পড়াশোনা হচ্ছে একদিকে। আগের নির্বাচনগুলোতে কোন অঞ্চলে কত কত ভোট পেয়েছিল কোন দল, তার পরিসংখ্যান আর বিভিন্ন রঙ। ইতিহাসের দোকানও আছে। সেখানে স্বাধীনতার পর প্রথম একশো বছর কীভাবে নির্বাচন হত তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। একটা পুরোনো ভাঙা ভোটযন্ত্র, কাঠের ব্যালটবাক্স ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা আছে এদিক ওদিক। এমনকি পাশেই রাশিবিজ্ঞানের একটা স্টলে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন নির্বাচনে কত পরিমাণে জাল ভোট পড়েছিল তার গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যানভিত্তিক ফলাফল।
প্রাচীন ভোটযন্ত্রের নকশায় জালিয়াতি নিয়ে আছে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির আলোচনা। তারও আগের মজার কিছু গল্প, যেখানে কিনা চারশো নিরানব্বুইটা একই দলের ব্যালটের ওপর রাখা আছে একটা মাত্র অন্য দলের ছাপ মারা কাগজ। একটু দূরে বিশেষভাবে ঘেরা জায়গায় আছে পুরোনো দিনের কিছু ছবি। সেখানে ঢোকার আগে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। "মন শক্ত এবং হৃদয়ে সাহস থাকলে তবেই ঢুকবেন। অসুবিধে হলেই বেরিয়ে এসে পাশে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।" স্ট্রেচার নিয়ে সেই ঘেরা জায়গায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। মাঝে মাঝেই দু-একজন পুরোনো দিনের ভোটদৃশ্য দেখে জ্ঞান হারাচ্ছেন। তাঁদের বাইরে এনে নাকে কী সব শোঁকানো হচ্ছে। কেউ কেউ জ্ঞান ফিরে পেয়ে আর সেখানে ঢুকছেন না, কেউ আবার মনটাকে প্রস্তুত করে নিয়ে আবার ঢুকছেন। পুরনো এসব ঐতিহাসিক স্থিরচিত্র এবং চলছবি পাঁচ বছরে একবার করেই দেখানো হয়, নির্বাচনের দিন।
দেশে এখন সমস্ত নির্বাচন একসঙ্গে করে একদিনেই সব কাজ সেরে ফেলা হয়। বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তরে আঙুল নড়াচড়া করে তবেই ছুটি পাওয়া যায় গোটা ভোট প্রক্রিয়া থেকে। তবে এরকম ভোটমেলার কেন্দ্র থাকে অনেক জায়গাতেই। তাই ভিড় খুব নেই। আর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সফল প্রয়োগে দেশে এখন মানুষের সংখ্যা সামলানো গেছে অনেকটা। পুরনো দিনে কী ঘটত সেই নিয়ে আলোচনা করার অনুমতি নেই দেশে। তবে নিজের মত করে অতীতকে পাঁচ বছরে একবার কয়েক মিনিটের জন্যে দেখে আসা যায়। সেখানেই খুঁজে পাওয়া যায় ডোবায় ভাসা ঢাকনা ওপড়ানো ভোটযন্ত্র থেকে হাসপাতালে চিৎ হয়ে থাকা ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানুষের ছবি।
আরও পড়ুন: ভোটের নাটক, নাটকের ভোট
এখন এমন কিছু ঘটে না। যে কোনও ফুলের ছাপ মারা দলে যেমন ভোট দিতে পারেন মানুষ, তেমনই দলবদল করা যায় এককথায়। তবে তা স্থির হয়ে যায় ভোটের দিনটিতেই। অর্থাৎ ভোটের দিনেই রাজনৈতিক কর্মী এবং নেতাদের ঠিক করে নিতে হয়, সামনের পাঁচ বছর তাঁরা কোন দলে থাকবেন। আর তা ঠিক করতে হয় ভোটের ফল বেরোনোর আগেই, ঠিক নিজের ভোটটা দিয়ে দেওয়ার পর। দলবদল না করলে সেই দলেই রয়ে গেলেন নেতা। আর বদলালে নিজের দলের কাছ থেকে ফেরত নিতে হবে টোকেন। তারপর ভোটমেলায় অন্যদলের বাক্সে গিয়ে সেই টোকেন জমা দিতে হবে।
তবে ভোটের ফল বেরোনোর আগে সর্বোচ্চ তিনবার এদল ওদল করা যাবে। সময় বেশি থাকে না। কারণ ভোটের দিনের রাতেই ফল প্রকাশিত হয়ে যায়। ফলে সকালের দিকে ভোটটা দিয়ে দেওয়ার পর সক্রিয় নেতা কর্মীদের এক বা একাধিকবার দলবদল চটজলদি সেরে ফেলতে হয়। তবে একদলের প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে অন্যদলে চলে গেলে কোনও অসুবিধে নেই। জিতে গেলে অন্য দলের হয়েই সরকারের কাজ করা যাবে। আর বিভিন্ন দলের মধ্যে বোঝাপড়া এতটাই ভাল যে দেশ এবং দেশের মানুষের অগ্রগতিতে সবাই এককাট্টা।
অনেক সময় এমন আলোচনাও হয় যে নির্বাচন রাখার আর প্রয়োজন কী? তবু দেশের শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষেরা চান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন। তাই সেটুকু চলছে। যাঁরা নির্বাচনে জেতেন তাঁদের নিজেদের পেশা অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যে কোনও দলের টিকিটেই (অর্থাৎ ফুলের ছাপে) মন্ত্রী হওয়া যায়। যেমন ধরুন বিদ্যুৎমন্ত্রী হতে গেলে বৈদ্যুতিক প্রযুক্তিতে যাঁর অভিজ্ঞতা এবং পরীক্ষার নম্বর বেশি তাঁকেই সুযোগ দেওয়া হবে শুরুতে। চিকিৎসকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অর্থশাস্ত্রের পণ্ডিত হবেন অর্থমন্ত্রী। মজার কথা হল এইরকমের বন্দোবস্ত এই দেশে কয়েক শতক আগেই ছিল। তবে তা দেখা যেত অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে। সাধারণভাবে পড়াশোনায় গাড্ডা খাওয়া লোকজন সেই সময় রাজনীতি করতেন, তবে সে তো অনেক দিন আগের কথা।
আরও পড়ুন: অভিজাতদের উচ্চারণ ভাঙিয়ে আসন জয়ের সম্ভাবনা কম
তা এই বদল হল কীভাবে? শোনা যায়, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের লোকসভা নির্বাচনে প্রচণ্ড গরমে যখন ভোট হয়, তখন প্রচুর নেতানেত্রী প্রথম অনুভব করতে শুরু করেন যে এটা নির্বাচনের সঠিক সময় নয়। তার কারণ শরীরে নুন কমে গিয়ে অনেকের মাথায় সোডিয়াম-পটাশিয়ামের অভাব ঘটতে শুরু করে। অক্সিজেন তো প্রচণ্ড উত্তাপে কিছুটা কম ছিলই, আর সেকথা নেতানেত্রীরা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে মস্তিষ্কে বিভিন্ন রাসায়নিকের অভাবে ঘাসফুল থেকে দলবদল করা পদ্মফুলের প্রার্থী এক কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ফেরার সময় ভুল করে আবার ঘাসফুলের ঘরে ঢুকে যান। সেখানে তিনি যখন শালপাতার থালায় ভাত খাচ্ছেন, তখন ঘাসফুলের নেতা তাঁকে জানিয়ে দেন যে পদ্মফুলের হয়ে লোকসভায় হারলেও তাঁকে ফিরিয়ে এনে আবার ঘাসফুলের রাজ্যসভার প্রার্থী করা হবে। সেদিনই দেশের পদ্মফুল দলের প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড গরমে প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেন যে ঘাসফুলের চল্লিশজন বিধায়ক তাঁর দলের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছেন।
এই সব শুনে এবং দেখে জনগণ এতটাই গুলিয়ে যায় যে ভরা গ্রীষ্মে তারা চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করে এবং ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শুধুমাত্র ফুল চিহ্নেই ছাপ দেয়। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই শুধু ফুল চিহ্নের দলেরাই দেশজুড়ে সমস্ত আসন লাভ করে। তারপর থেকেই দেশের নির্বাচন পদ্ধতিতে সংশোধনের শুরু। গ্রীষ্মে আর ভোট হয় না। আর ফুলের চিহ্ন ছাড়া ভোটে দাঁড়ানোও যায় না। ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে সারা দেশ সেই যে অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলে তাতেই তো এই নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি।
এখানে দলবদলে দোষ নেই কোনও, কারণ সবই তো ফুলের দল। ভোটে অশান্তি খুব কম, কারণ খুব বেশি উত্তেজনায় একজন আর একজনকে বড়জোর ফুল ছুঁড়ে মারে। আর ২০১৯-এর নির্বাচন থেকেই যে এই নতুন পথের যাত্রা শুরু, সে কথা ভোলে নি কেউই। বিশেষ করে ২০১৯-এর ২৯ এপ্রিল বীরভূমে ঘাসফুল আর পদ্মফুলের একই শালপাতায় গুলিয়ে যাওয়াটাই নাকি টার্নিং পয়েন্ট। সবটাই 'অনু' নামক অব্যয়ের খেলা। যার অর্থ 'পরে', 'পশ্চাতে', 'সদৃশ' বা 'যোগ্যতা' ইত্যাদি শব্দ-সূচক উপসর্গ। দুই নেতাতেই অনু-র অনুপ্রেরণা। তাই তারপর থেকে এই দিনটাই ব্রহ্মাণ্ডের সব থেকে এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা দিবস, যদিও সে দিনটায় আজকাল গরমের জন্যে বীর-ভূমে ভোট হয় না।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)