দুর্ঘটনায় কোমায় চলে যান শুভেন্দু মাজি। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের মধ্য-ত্রিশের এই তরুণ ২০১৪ সাল থেকে বিছানায়, একই ভাবে শুয়ে। তখন থেকেই তাঁর মস্তিষ্কের সমস্ত ক্রিয়া বন্ধ। বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। ছেলেকে ভালো করে তোলার ক্ষেত্রে কোনও ত্রুটি রাখেননি। জলের মতো টাকা খরচ করেছেন। চিকিৎসার খরচের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ৯০ লক্ষ। ডাক্তাররা আশা দিচ্ছেন না। ছেলের ভালো হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন ওঁরাও। এখন শুভেন্দুর স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছেন তাঁর বাবা-মা। মৃত্যুর পর ছেলের অঙ্গদানও করতে চান। ইচ্ছে, তাঁদের ছেলে এভাবেই বেঁচে থাক। বাঁচুন এই অঙ্গ যাঁর প্রয়োজন, তিনিও।
স্বেচ্ছামৃত্যু। অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এদেশের পক্ষে এখনও যথেষ্ট অচেনা এক ভাবনাও বটে। ইংরেজি 'euthanasia'-র আভিধানিক অর্থ যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। স্বেচ্ছামৃত্যুকে কি সেই ব্র্যাকেটে ফেলা যায়? কঠিন প্রশ্ন। তবে শুভেন্দুর বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে যন্ত্রণাময় জীবনের হাত থেকে মুক্তি দিতেই যে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছেন, সেটা অভিধান চর্চা না করেও বলা যায়।
আরো পড়ুন: চোখের সামনে তিলে তিলে মরছে ছেলে, স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন বাবা-মায়ের
২০১৮-র মার্চে ভারতে 'প্যাসিভ ইউথেনেসিয়া' আইনসিদ্ধ হয়। ৯ মার্চ, ২০১৮ সুপ্রিম কোর্ট একটি আবেদনের ভিত্তিতে এই রায় দেয়। রায়ের বক্তব্য হলো, রোগী যখন পার্মানেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেটে (স্থায়ীভাবে মস্তিষ্ক অচল হয়ে যাওয়া) রয়েছেন, একমাত্ৰ তখনই লাইফ সাপোর্ট (ভেন্টিলেশন/কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার পদ্ধতি) বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে এই প্রয়োগ ঘটালে, তাকে আইনসিদ্ধ বলে মানা হবে। বলা বাহুল্য, সমস্ত বিষয়টির মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা, আইন ও প্রশাসন এবং নানা নীতি, অনুশাসন ইত্যাদির এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তবু এই রায় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে।
এরই পাশাপাশি এটাও বোঝা যায়, আইন অধিকার দিলেও এই প্রয়োগ বলবৎ হওয়ার পথটা খুব সরল নয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে সব জেনে-বুঝে পা ফেলা, সেও এক কঠিন পরীক্ষায় পাশ করার মতো ব্যাপার। মোদ্দা কথা, চাইলেই স্বেচ্ছামৃত্যুর বাসনা পূর্ণ হবে না।
এত কিছুর পর মাজি দম্পতির ইচ্ছা পূর্ণ হবে কিনা, তা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। যদিও তাঁদের ইচ্ছেটা যুক্তিযুক্ত তো বটেই, ছেলের অঙ্গদানের ভাবনাকেও কুর্নিশ জানাতে হয়। ব্যক্তিগত গভীর বেদনার উত্তরণ ঘটিয়েছেন ওঁরা। সামাজিক সচেতনতার নিদর্শনও রাখতে চাইছেন।
এদেশে এর আগেও অনেকে স্বেচ্ছামৃত্যুর বাসনা প্রকাশ করেছেন। তা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম উত্তাল হয়েছে। আইন-আদালত পর্ব চলেছে বছরের পর বছর। ফল মিলেছে প্রথম এই গত বছর। সেটাও আবেদনের আনুপাতিক বিচারে নামমাত্র। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। বিশ্বের যে সব দেশে ইউথেনেসিয়া এখনও পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে, সংখ্যার বিচারে তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। সেখানেও নানা শর্তসাপেক্ষে আইনি অনুমোদন মেলে। শর্তগুলি পৃথক পৃথক, সেটাও বলা দরকার।
আরো পড়ুন: এ বছরে শহরে প্রথম অঙ্গদান, শিক্ষিকার কিডনি-লিভারে বাঁচবে আরও জীবন
সেক্ষেত্রে, নানা ধর্ম-সম্প্রদায়ের জটিল দেশ ভারতে আইন শুধু নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও বিষয়টি কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তাতে সন্দেহ আছে। আজও এদেশের মানুষের জীবন ও মৃত্যুর মাঝে ধর্মের অনুশাসন দণ্ড হাতে দাঁড়িয়ে একদল নির্ণায়ক। স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তাঁদের বিচার-বিশ্লেষণকে আমল না দিলে যে চলবে না, সে কথা বলাই বাহুল্য।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলব, আইন বা সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। অনেক দিক বিবেচনা করতে হয়। স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়া সহজ নয়। এক্ষেত্রে নতুন ভাবনার উন্মেষ প্রথমে সানাজিক ব্যাপ্তিতে এলে, তবেই সেটা পরে আইনের স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। অর্থাৎ তরুণ সন্তানের মৃত্যুর অধিকার চাইছেন যে প্রবীণ দম্পতি, তাঁরা কোন অবস্থায় পৌঁছেছেন, সেটা বুঝতে গেলে নিছক আইনের চোখ দিয়ে দেখলে বিষয়টা বোঝা যাবে না। সামাজিক সচেতনতাও সমান জরুরি।
প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে যে দুশ্চিন্তা, মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রনা ওঁরা সহ্য করেছেন ও করছেন, তার পরিমাপ করা যায় সহজেই। আর আর্থিক বিপর্যয়? সেটা যে সবথেকে কঠিন সমস্যা, সেও তো আমরা সকলেই জানি। এমনিতেই এদেশে চিকিৎসার খরচ ও পরিষেবা, দুটোই মধ্যবিত্তের পরিস্থিতির প্রতিকূল। কোমার মতো জটিল সমস্যায় সেটা কোথায় পৌঁছতে পারে, বুঝতে অসুবিধা হয় না। কঠোর বাস্তব হলো এই, ওঁদের ছেলে অনেকদিন আগেই জীবনের স্রোতের বাইরে চলে গেছেন। গভীর শোকের মধ্যেও মাজি দম্পতি এই বাস্তব বুঝেছেন। ওঁদের বয়স হয়েছে। কিছু একটা হয়ে গেলে, ছেলেকে কে দেখবে, সেই দুশ্চিন্তাও বুকের ওপর চেপে বসেছে ওঁদের।
আরো পড়ুন: ডাক্তার নিগ্রহের রেকর্ড নেই সরকারের কাছে, ফের চিঠি মুখ্যমন্ত্রীকে
সমাজ ও সংসার আজ এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, যেখানে কারও কাছেই কোনও রকম বাড়তি প্রত্যাশা রাখা মোটেই সমীচীন নয়। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধব - কে কতদিন পাশে থাকে বা থাকতে পারে আজকাল? একটা সময়ের পর পরিবারের লোকজনের মধ্যেও একটা বিরক্তি এসে যায়। অক্ষম মানেই সমাজ-সংসারের বোঝা, এটা আজ আর মেনে নিতে দ্বিধা করা উচিত নয়। যাঁরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, তাঁরা লোক রেখে এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন। প্রশ্ন অবশ্য সেখানেও থেকে যায়। বিশ্বস্ত বা ভরসাযোগ্য হবেন তো সেই মানুষটি?
স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার উচিত কিনা, তা নিয়ে বিতর্কের পিছনে নানা যুক্তি কাজ করে। রক্ষণশীল যাঁরা, তাঁরা ধর্ম, রীতি, রেওয়াজের প্রশ্ন তোলেন। অনেকেই মনে করেন, এটা যত্রতত্র ব্যবহার করতে পারে স্বার্থান্বেষী লোকজন। আত্মহত্যার ক্ষেত্রেও প্ররোচনামূলক হয়ে উঠতে পারে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার। এই যুক্তিগুলি নিশ্চয় ফেলে দেওয়ার নয়। কিন্তু এটাও তো ঠিক, স্বেচ্ছামৃত্যুর আইনি অধিকার ছাড়াই কি কিছু কম হচ্ছে এসব?
স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারকে নিছক সমর্থন জানানোর উদ্দেশ্যে এই লেখা নয়। যেটা দরকার, সেটা খুব পুরোনো এক চাহিদা। চাই একটু সহমর্মিতা। প্রয়োজন বিষয়ের গভীরে যাওয়া। যে কোনো চাওয়ার পিছনে যে যুক্তি ও বাস্তবতা থাকে, তাকে অনুভব করা। সর্বোপরি আধুনিক ও সমায়ানুগ দৃষ্টিভঙ্গি রাখা। মানুষের জন্যই সমাজ ও আইন। মানুষের প্রয়োজনের ভিত্তিতেই ঘটেছে সামাজিক বিবর্তন। সংবিধান রচনা বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাগুলিকে প্রাধান্য দেওয়ার সময় এসেছে।
জীবন পুঁথির নিয়ম মেনে চলে না। জীবন নিজেই প্রতি মুহূর্তে নিজের তৈরি নিয়ম ভাঙে। কোমায় শয্যাশায়ী হয়ে দিন-মাস-বছর পার করেছেন শুভেন্দু। এক তরুণের এই পরিণতি তো নিয়ম হতে পারে না। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে এই অনিয়ম জীবনই ঘটিয়েছে। চোখের সামনে রোজ জীবন্মৃত ছেলেকে দেখছেন তাঁর বাবা-মা। তাঁদের কথাও একটু ভাবা দরকার বোধহয়। এবং তাঁদের মতোই আরও অনেকের কথা! বাবা-মায়েরা, আপনজনেরা ভাবছেন। খোলা মনে এই ভাবনাকে স্বাগত জানালে ক্ষতি কী? জীবনই যখন বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তখন চিরশান্তির অধিকার না দেওয়ার আমরা কে?