"প্রেম কখনোই দুর্বলতা নয়, বরং আপনার সাহস, যা আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে," লজ্জায় লাল হয়ে বলেন তিস্তা দাস। উজ্জ্বল হলুদ শাড়ির আভায় উদ্ভাসিত সদ্য-বিবাহিতা তিস্তা খেলছেন হাতের চুড়িগুলো, পাশে বসে মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখছেন স্বামী দীপন চক্রবর্তী। অনেক প্রেমের গল্পের মতোই ওঁদের কাহিনীও শুরু হয়েছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব দিয়ে। কিন্তু বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো ছিল না। কারণ এটি সম্ভবত বাংলার প্রথম 'রামধনু বিবাহ' বা 'রেনবো ওয়েডিং'।
দীপন বলেন, "২০১৬ সালে ট্রান্সজেন্ডার ভিজিবিলিটি ডে-তে কনে সেজেছিল তিস্তা। সেখানেই ওকে প্রথম দেখি। ওর সৌন্দর্যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই।" কিন্তু তিস্তার সঙ্গে কথা হওয়া পর্যন্ত তাঁর প্রতি সেই অর্থে প্রেমের টান অনুভব করেন নি দীপন। "ওর সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করা এত সহজ ছিল, সেজন্য নিজের মনের অবস্থার কথা জানাতে ভয় করত, পাছে আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায়।"
অবশেষে মনে জোর এনে, বন্ধুবান্ধবের পরামর্শ নিয়ে দীপন ঠিক করেন, নিজের আবেগের কথা জানিয়েই দেবেন তিস্তাকে, সঙ্গে দেবেন আজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি। "আমরা সবসময়ই ব্যতিক্রমের রাস্তায় হেঁটেছি, তাই বস্তাপচা 'আই লাভ ইউ' বলি নি। আমি শুধু বলেছিলাম, সবসময় ওর সঙ্গে থাকতে চাই," বলেন দীপন।
আরও পড়ুন: এক ছাদের তলায় ১৫ জন রূপান্তরকামী মহিলার বিয়ে, উদযাপনে সামিল রায়পুর
এই বিয়ের বর-কনে উভয়েই লিঙ্গ পরিবর্তন করাতে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন, পরিভাষায় সেক্স রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি (SRS)। চলতি মাসের গোড়ার দিকে বাঙালি বিয়ের রীতিনীতি মেনেই চার হাত এক হয় তাঁদের, এবং বিশ্ব জুড়ে শিরোনামে চলে আসেন দম্পতি। কিন্তু দুনিয়াজোড়া মানুষের কাছ থেকে নতুন জীবনের শুভচ্ছার মাঝেই উঠে এসেছে সমালোচনাও।
কলকাতার কাছেই আগরপাড়ায় সুখের সংসার পেতেছেন দুজনে, সঙ্গে রয়েছে চারটি কুকুর, আটটি বেড়াল। "প্রথম যখন ও প্রপোজ করে, ওকে বলেছিলাম যে এতে কিন্তু আমাদের দুজনের লড়াইয়ে আরেকটা মাত্রা যোগ হবে। ঠিক তাই হয়েছে," বলেন তিস্তা। "আমাদের সমাজে অনেকেই মনে করেন, একজন 'সিসজেন্ডার' (জন্মগতভাবে) পুরুষ একজন রূপান্তরকামী নারীকে বিয়ে করলে তার রক্ষাকর্তা হতে পারে, কিন্তু দীপন যেহেতু 'ট্রান্সম্যান' (রূপান্তরকামী পুরুষ), ও আমাকে রক্ষা করতে পারবে না।"
এই প্রসঙ্গে সমালোচকদের উদ্দেশে একটি প্রশ্ন করতে চান কলকাতার সমকামী এবং রূপান্তরকামী সমাজের পরিচিত মুখ তিস্তা: "একজন 'সিসজেন্ডার' যদি একজন রূপান্তরকামীকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং আমরা তার সমালোচনা করি, তাহলে একজন পুরুষকে 'ট্রান্সম্যান' বলে প্রত্যাখান করাটাও কি তাকে অসম্মান করা নয়?" ৩৮ বছর বয়সী তিস্তার আরও বক্তব্য, "লড়াই বরাবরই আমার জীবনের একটা অঙ্গ, তাই থাকবেও। কিন্তু আমাদের নিজেদের সমাজের কাছ থেকেই সমালোচনা শুনতে হচ্ছে, এটা সত্যিই দুঃখের।"
সমালোচকদের একাংশের মত, এই বিয়ের ফলে ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীদের অধিকারের লড়াই থেকে সরে যাবে মানুষের দৃষ্টি। ভারতে যেহেতু আইনত বিবাহ করতে পারেন না রূপান্তরকামীরা, তিস্তা-দীপনের বিয়ে তাঁদের সমাজের আন্দোলনের বিপরীতেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন এই অংশ।
আরও পড়ুন: ‘রুদ্ধশ্বাস, কত প্রতীক্ষা’র অবসান, বিয়ে করছেন ওড়িশার রূপান্তরকামী আমলা
পশ্চিমবঙ্গ ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহা দুই সদ্যবিবাহিতকে অভিনন্দন জানিয়েই বলছেন, "এটা একেবারেই আমার নিজস্ব মতামত। কিন্তু সবকিছুর পরিণতি কি শুধু বিয়ে? বৃহত্তর সমাজ আমাদের ব্রাত্য করে রেখেছে, মানুষের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয় নি, তাহলে সেই সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্যই কি তাদের রীতিনীতি মেনে নেওয়া?" রঞ্জিতা আরও বলছেন, "তিস্তা আমার অনেকদিনের বন্ধু, এবং ওদের জীবন সুখের হোক সেটা নিশ্চয়ই চাইব। কিন্তু আমার মতে এই সমাজ, এই আচার-অনুষ্ঠান, আমাদের সবসময় দূরে সরিয়ে রেখেছে। এইসমস্ত পিতৃতান্ত্রিক ধারা মেনে চলাটা কোথাও যেন একটা হেরে যাওয়া।"
এতেই শেষ করেন না রঞ্জিতা। বলেন, "আইনত হয়তো ওরা বিবাহিত, কিন্তু এ বিয়ে তো দুজন 'ট্রান্স' মানুষের মধ্যে হয় নি। একজন নারী এবং একজন পুরুষের মধ্যে হয়েছে। যেখানে আমরা চাই দেশের 'ট্রান্স' নাগরিকদের জন্য সমান অধিকার, সেখানে এই বিয়ে কি আমাদের আন্দোলনের বিপরীতে নয়?"
উল্লেখ্য, তিস্তা এবং দীপন প্রথাগত বাঙালি বিয়েই শুধু করেন নি, স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট মারফত তাঁদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনও করিয়েছেন। নথিতে সই করেছেন মহিলা এবং পুরুষ হিসেবেই।
রঞ্জিতার প্রশ্নের জবাবে তিস্তার বক্তব্য, "হ্যাঁ, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিয়ের কোনও আইনি সংস্থান নেই। কিন্তু আমাদের লড়াইটা কি মানুষের নিজস্ব আইডেন্টিটি নিয়ে ছিল না? আমি নিজেকে নারী বলব না তৃতীয় লিঙ্গ, সেটা আমার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করবে। আমি চিরকাল নিজেকে নারী ভেবে এসেছি, আমার ভোটার আইডি কার্ডেও তাই আছে, তাহলে ক্ষতিটা কোথায়? দুঃখের বিষয়, আমরা লড়েছিলাম স্বাধীনতার জন্য, অধিকারের জন্য। কিন্তু এখন যখন আমি আমার স্বাধীনতা প্রয়োগ করছি, তখন কথা শুনতে হচ্ছে।"
মূলস্রোত এবং প্রান্তিকের বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে তাঁর বিয়ে, জন্ম দিয়েছে আরও বেশ কিছু নতুন বিতর্কের। "মূলস্রোত আমাদেরকে বলে প্রান্তিক। এটা কি দুঃখের বিষয় নয় যে আমরাও এই ধারণায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, এবং নিজেদেরকে মূলস্রোতের অংশ হতে দিচ্ছি না?" প্রশ্ন তিস্তার
অন্যদিকে রঞ্জিতা বলছেন, "বিয়ের গাঁটছড়া বাঁধার যে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম নীতি, যেগুলি প্রাচীন হিন্দু প্রথা, সেগুলি মেনে নিলে আমরা তো পিছনদিকে হাঁটব।"
কিন্তু তিস্তা-দীপনের যুক্তি, বিয়ের অনেক রীতিই তাঁদের নিজেদের গ্রহণযোগ্য মনে না হওয়ায় সেগুলি পালন করেন নি তাঁরা, যদিও এ নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না। তিস্তা বলেন, "আমাদের বিয়েতে কন্যাদান হয় নি। আমি কোনও সামগ্রী নই যে আমাকে দান করবে কেউ, কাজেই আমাকে কেউ সম্প্রদান করেন নি। আর সিঁদুর-শাঁখা পরেছি শুধু আমার মাকে খুশি করতে।"
জন্মেছিলেন সুশান্ত দাস হিসেবে, কিন্তু ২০০৪ সালে SRS বা লিঙ্গ পরিবর্তন করান তিস্তা। ছোটবেলাতেই ধরা পড়ে 'জেন্ডার ডিসফোরিয়া', অর্থাৎ নিজের লিঙ্গ ঘটিত মানসিক অবসাদ এবং অশান্তি। জীবনের প্রতি পদে পাশে পেয়েছেন মা শুভ্রাকে। "আমাকে সমর্থন করেছিলেন বলে হাজার লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে মাকে। আর পাঁচটা পায়ের মতোই নিজের সন্তানের বিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি তো মায়ের ছেলে হতে পারি নি, তাই ওঁর খুশির জন্য যদি ছোটখাটো কিছু করি, তাতে আমার লড়াই ছোট হয় না," বলেন তিস্তা।
কিন্তু লড়াই শেষ হয় নি। আসামের দীপান্বিতা, যিনি এখন তিস্তার স্বামী দীপন, নিজের পরিবারের কাছ থেকে সেই ভালবাসা বা সমর্থন পান নি যা তিস্তা পেয়েছেন। আসামের ছোট শহর লুমডিংয়ে এখনও খুব সহজে কেউ মেনে নেন না লিঙ্গ পরিবর্তন। দীপনের বাবা-মা এখনও খোলাখুলি তাঁর অস্ত্রোপচার নিয়ে কথা বলেন না, কাজেই বিয়ের খবরে যে তাঁরা স্তভিত, তা বলা বাহুল্য। কাজেই কলকাতার বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সমর্থন পেলেও, তাঁর বিশেষ দিনে উপস্থিত ছিলেন না দীপনের বাবা-মা।
এজন্যই দীপনকে বিয়ে করেছেন তিনি, জানান তিস্তা। "ও মানুষ হিসেবে এত ভালো, ওর নিশ্চিতভাবেই প্রাপ্য এমন একটা পরিবার, যারা ওকে নিঃশর্তভাবে ভালবাসে। আমি ওকে সেটাই দিতে চেয়েছি। এবং এটাও ভেবেছি, একজন জন্মগতভাবে পুরুষ আমার নারী হয়ে ওঠার লড়াইটা বুঝবেন না। কাজেই ও যখন আমাকে বলল ওর পাশে থাকতে, আমার মনে হয়েছিল এটাই সবচেয়ে ভালো রাস্তা।"
সোহিনী দাশগুপ্তর তথ্যচিত্র 'আই কুডন্ট বি ইয়োর সান, মম', এবং স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি 'দ্য থার্ড জেন্ডার'-এর দৌলতে নজর কাড়েন তিস্তা। বর্তমানে তিনি কলকাতার এসআরএস সল্যুশনস নামক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আইনি সাহায্য এবং চিকিৎসা পরিষেবা পেতে সাহায্য করেন। এই এজেন্সির মাধ্যমেই দীপনের সঙ্গেও দেখা হয় তাঁর।
তাঁদের যুগ্ম লড়াই এখনও শেষ হয় নি, এবং সমালোচনার ভয়ে পিছিয়ে যাবেন না তাঁরা, এমনটাই জানাচ্ছেন দীপন-তিস্তা। বরং তাঁদের আশা, তাঁদের দেখাদেখি স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবনের পথ বেছে নেবেন আরও অনেকে।