Advertisment

বাংলার শিকড়: গুপ্তিপাড়া, বারোয়ারি দুর্গাপূজার জন্মস্থান

বারোয়ারি পুজোর আঁতুড়ঘর গুপ্তিপাড়ার প্রধান উৎসব কিন্তু দুর্গাপুজা নয়। এখানকার খ্যাতি রথযাত্রার জন্য। চৈতন্য ভাবধারায় বৈষ্ণবধর্মের অধিক প্রচার ও প্রসারের ফলে এ অঞ্চলে রথযাত্রার সূচনা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
দুর্গা পুজো, durga puja 2019

বাতাসে উৎসবের আমেজ, এখানে ওখানে বারোয়ারি পুজোর প্রস্তুতিপর্ব। অথচ আমরা কি জানি, জমিদার ও ধনবানদের বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে কবে মা দুর্গা হয়ে উঠলেন সার্বজনীন? বাংলার বুকে বারোয়ারি পুজোর প্রচলন ঘটেছিল হুগলি জেলার যে গ্রামে, তার নাম গুপ্তিপাড়া। আবার বাংলার ঐতিহ্যবাহী মন্দিররীতির নিদর্শন আজও সযত্নে আগলে রেখেছে হুগলি জেলার এই ছোট্ট শহর।

Advertisment

সতেরোশো ও আঠারোশো শতকে গড়ে ওঠা চারটি বৈষ্ণব মন্দির রয়েছে বৃন্দাবনচন্দ্রের মঠ চত্বরে। বেশ খানিকটা উঁচু ভিতের ওপর দন্ডায়মান এই চারটি মন্দিরের মধ্যে বৃন্দাবনচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির দুটি আটচালা রীতিতে তৈরি। রামচন্দ্র মন্দিরটি একচালার, তার গায়ের টেরাকোটার কাজ নয়নাভিরাম। আর এই চত্বরের সবচেয়ে পুরোনো মন্দিরটি হল চৈতন্যদেব মন্দির। সবকটি মন্দির সরু পথের দ্বারা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত, যেই পথ আবার খিলান বা আর্চ দ্বারা নির্মিত।

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 টেরাকোটার কাজ

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 এভাবেই পরস্পরের সাথে সংযুক্ত মন্দিরগুলি

ষোল শতকের মধ্যভাগে রাজা বিশ্বেশ্বর রায় তৈরি করেছিলেন চৈতন্য মন্দিরটি। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। এটি জোড়বাংলা রীতিতে তৈরি। অর্থাৎ দুটি খড়ের দোচালা পাশাপাশি সংযুক্ত করলে যেমন দেখতে লাগে, তেমন। বাংলা মন্দির রীতিতে জোড়বাংলা নির্মাণের মধ্যে কিছুটা কৃত্রিমতা অন্তর্নিহিত থাকে, কিন্তু এই মন্দিরটিতে তা অতিক্রমের এক নবতর প্রয়াস দেখা যায়।

শ্রীচৈতন্যদেবের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত এই মন্দিরে বহু সংস্কার ঘটেছে। দেওয়ালের ওপর, বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সংযোজন ও পরিবর্ধন হয়েছে। আচ্ছাদনের ওপর পড়েছে পুরু পলেস্তারা। শোনা যায় এর গায়ে এক কালে ছিল বাংলার প্রাচীনতম টেরাকোটা কাজের নিদর্শন। কিন্তু বর্তমানে সে সবই কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে। খর্বাকৃতি পিলার ও তার ওপর কারুকার্য করা খিলান এখনো বর্তমান। ষোড়শ শতকের শেষভাগে ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলাদেশে নির্মিত মন্দিরগুলিতে অলঙ্কার সজ্জার যে রূপ ও বিন্যাস দেখা যায়, এখানে তারই প্রতিফলন। চৈতন্য মন্দিরের উঠোন এখন নানা কাঠের প্রমাণমাপের পুতুলের আবাসস্থল। এই মূর্তিগুলি রথযাত্রার সজ্জার কাজে ব্যবহৃত হয়।

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 জোড়বাংলা রীতিতে চৈতন্যমন্দির

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 চৈতন্যমন্দিরের দালানে

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির

বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ১৮১০ সালে। এর উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট, এটিই প্রাঙ্গণের সবচেয়ে বৃহৎ মন্দির। বাংলা মন্দির রীতির আটচালা ধারায় তৈরি এই স্থাপত্যটির গায়ে টেরাকোটার কাজ খুব বেশি নেই। এই আটচালা মন্দিরটির ক্ষেত্রে দেওয়াল ও আচ্ছাদন সমান উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। তবে মন্দিরগাত্রে ও অভ্যন্তরে রয়েছে রঙিন ফ্রেস্কোর কাজ। গর্ভগৃহে বেশ কিছু সুন্দর ছবি রয়েছে। মানুষের হাতের নাগালের বাইরে যে ছবিগুলি আছে, সেগুলি অত্যাচারমুক্ত ও অবিকৃত থাকতে পেরেছে, যেমন ছাদের কাছে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর ছবি। এই মন্দিরে আছে রাধা, কৃষ্ণ, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও গরুরের বিগ্রহ।

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 আটচালার গঠন

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির

এই বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরের ডান পাশে রামচন্দ্র ও বাম পাশে কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ১৭৪৫ সালে। বাংলার মসনদে তখন নবাব আলিবর্দী খাঁ। এই মন্দিরটিও আটচালা রীতিতে তৈরি। কিন্তু বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরটির সঙ্গে এটির গঠনরীতির সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। এটির ক্ষেত্রে আসনের দৈর্ঘ্য থেকে দেওয়াল, দেওয়াল থেকে আচ্ছাদন উচ্চতায় হ্রস্বতর। মন্দিরটির প্রতি গাত্রে চারটি করে খর্বাকার কলাম ধরে রেখেছে তিনটি কারুকার্যশোভিত খিলানকে।

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের আটচালারীতি

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 কারুকার্যমণ্ডিত খিলান

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 রামচন্দ্র মন্দির

এই খর্বাকার কলাম তুর্কি রীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই মন্দির চত্বরের সবচেয়ে সুষমামণ্ডিত স্থাপত্যটি হলো রামচন্দ্র মন্দিরটি। এটি এক রত্ন বিশিষ্ট। একরত্ন ভাবকল্পনার এক সম্পূর্ণ নতুন সম্ভাবনা এই মন্দিরটির নির্মানরীতিতে সুস্পষ্ট। প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে একরত্ন দেহে উভয় অংশের মর্যাদা সমান। কিন্তু রামচন্দ্র মন্দিরের স্থপতি এই উভয় অংশের সমমর্যাদার রীতি পরিহার করে নিম্নাংশকে রূপকল্পনার একমাত্র কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ঊর্ধ্বাংশে রত্নের দৈহিক গঠন আলাদা হলেও ভাবগতভাবে এটি নিম্নাংশের স্বাভাবিক পরিণতির ফল।

রত্ন গঠনে সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ ও তার চালা আচ্ছাদনের রেখা প্রবাহে ভাবগত বন্ধন সুদৃঢ়। একরত্নের দেহে মৌলিক কোনো পরিবর্তন না করে নির্দিষ্ট ভাবকল্পনার মধ্যে দুই অংশের সার্থক মেলবন্ধন করাই এই মন্দিরের স্থপতির অন্যতম কৃতিত্ব। আঠারোশো শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজা হরিশচন্দ্র রায় এটি নির্মান করেছিলেন। মন্দিরটি একতলা, তার চূড়াটি অষ্টভুজবিশিষ্ট। একতলার সামনের দেওয়াল ও দক্ষিণ দেওয়ালে টেরাকোটার অপূর্ব কাজ নজরে আসে। চূড়াটিও টেরাকোটা শোভিত। এই টেরাকোটার প্যানেলে নজরে আসে রামায়ণের কাহিনিচিত্র, যেমন, মেঘনাদ যজ্ঞ করছেন আর লক্ষ্মণ ও বিভীষণ আসছেন, বানর সেনা লঙ্কার সেতুবন্ধনের জন্য পাথর বয়ে আনছে, বালী ও সুগ্রীব লড়াই করছে ইত্যাদি।

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 একরত্ন রীতি

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 কারুকার্যমণ্ডিত থাম

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 খিলানের কারুকাজ

এছাড়া দেখা যায় রাজকীয় শোভাযাত্রা, রাধা-কৃষ্ণের লীলা, নৌবহর। আছে দৈন্যন্দিন জীবনচিত্রও। পুরাকালে গুপ্তিপাড়া ছিল দেশের শিল্প সংস্কৃতি চর্চার এক অন্যতম কেন্দ্র। সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান হিসেবে খ্যাত এই শহরে ছিল একাধিক টোল, বাস করতেন বহু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। স্থানীয় সরকারি গ্রন্থাগার 'শিশির বাণীমন্দির পাঠাগার’-এ বহু সংরক্ষিত প্রাচীন পুঁথির দেখা মেলে।

আবার বাংলা কবিগানের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র ভোলা ময়রা জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই গুপ্তিপাড়ায়। কবি লিখেছিলেন, "মোহনলালের অসীর সঙ্গে চণ্ডীদাসের বাঁশি মিশেছে এ দেশে।" সেই বীর মোহনলাল, নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার দেওয়ান মোহনলালও এই গুপ্তিপাড়ার সন্তান। হিন্দু মোহনলাল নিজ কৃতিত্বে নবাবের রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে যখন সিরাজের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন মোহনলাল জীবন পণ করে লড়ে গেছিলেন ইংরেজ সেনার বিরুদ্ধে। গুপ্তিপাড়া তার এই বীর সন্তানকে ভোলে নি। মোহনলালের জন্য একটি স্মারক আছে এখানে, তাতে লেখা "ইমান রাখিলে তুমি সেনাপতি তোমারে নমস্কার, বীর প্রতিভায় তুমি যে বাঙ্গালী তোমারে নমস্কার"।

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 টেরাকোটার প্যানেল

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 টেরাকোটায় কৃষ্ণলীলা

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 টেরাকোটায় নৌবহর

১৭৬০ (ভিন্নমতে ১৭৯০) সালের কথা। গুপ্তিপাড়ায় দুর্গাপূজা তখন হত সেনবাড়িতে। কিছু মানুষ মিলে ঠিক করলেন তাঁরা সেনবাড়ির দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ করবেন না। তাঁদের মধ্যে বারো জন  মিলে একটি কমিটি গঠন করলেন, তাঁদের আয়োজনে স্থানীয় বিন্ধ্যবাসিনী মাতার মন্দিরে প্রথম বার অনুষ্ঠিত হলো সর্বজনীন শারদোৎসব। বারো জন বন্ধু বা ইয়ারের উদ্যোগ, তাই বারোয়ারি। বাংলার বুকে এক নতুন যুগের সূচনা হল। যে মায়ের আরাধনা এতকাল ছিল কিছু মুষ্টিমেয় অর্থবান ব্যক্তির ঠাকুরদালানে সীমাবদ্ধ, তা ছড়িয়ে পড়ল জনসাধারণের পাড়ায় পাড়ায়। আর এখন তো বারোয়ারি পুজোরই রমরমা, গুটি কতক বাড়ির পুজোর প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে।

বারোয়ারি পুজোর আঁতুড়ঘর গুপ্তিপাড়ার প্রধান উৎসব কিন্তু দুর্গাপুজা নয়। এখানকার খ্যাতি রথযাত্রার জন্য। চৈতন্য ভাবধারায় বৈষ্ণবধর্মের অধিক প্রচার ও প্রসারের ফলে এ অঞ্চলে রথযাত্রার সূচনা। বাংলার অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ রথযাত্রা এটি। বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরেই বাস জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার। এখানে যে প্রকাণ্ড রথটি বের হয় রথযাত্রার দিন, সেটি নয় তলা, উজ্জ্বল রঙে সজ্জিত। কাঠের ঘোড়া ও নানা কাঠের মূর্তিতে তা সাজানো থাকে। চারটি মোটা দড়ি দিয়ে তা টানা হয়, পিছনে থাকে ভারসাম্য রাখার জন্য আরেকটি মোটা দড়ি। প্রায় দু কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে রথ যায় গুপ্তিপাড়ার বড়বাজারের গোপাল মন্দিরে। এত দীর্ঘ পথ এদেশের আর একটিমাত্র রথ অতিক্রম করে, তা পুরীর রথযাত্রায়।

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 সেনবাড়ি

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 এখানেই হয়েছিল প্রথম বারোয়ারি পুজো

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 ঢেকে রাখা রথ

দুর্গা পুজো, durga puja 2019 আটচালা মন্দিরস্থাপত্য

উল্টো রথে আবার জগন্নাথ দেব ফিরে আসেন বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে। মাঝের এই সাত দিন গুপ্তিপাড়ায় বিশাল মেলা বসে, অজস্র জনসমাগম হয়। উল্টোরথের আগের দিন ‘ভাণ্ডারলুঠ’ বলে যে অনুষ্ঠান হয়, তার খ্যাতি রাজ্যজুড়ে।

বছরের বাকি দিনগুলি বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির চত্বরের বাইরে একটি টিনের আচ্ছাদনে রথটি ঢেকে রাখা থাকে। এভাবেই গুপ্তিপাড়া বাংলার ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন করে বেঁচে আছে আজও। এখানকার গুপো সন্দেশ আর মাখা সন্দেশের স্বাদের কথা লোকমুখে ফেরে। আজও ‘দেশ কালী’ পুজা ও ‘মশাল কালী’ (ডাকাতে কালী) পূজায় মেতে ওঠে এ শহর। রথযাত্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়। বছরের অন্যান্য সময়েও দেশ বিদেশ থেকে বহু ভ্রামণিক আসেন, প্রাচীন বাংলার মন্দিরস্থাপত্য উপভোগ করতে।

heritage Durga Puja 2019
Advertisment