আমাদের স্বাধীনতা দিবস কবে? ১৫ অগাস্ট। পশ্চিমবঙ্গের হাতে গোনা কয়েকটি গ্রামে স্বাধীনতা দিবস কবে? ১৮ অগাস্ট, অর্থাৎ আজ। কেন? সে এক লম্বা গল্প।
১২ অগাস্ট, ১৯৪৭। ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা করলেন, ১৫ অগাস্ট থেকে স্বাধীন হয়ে যাবে ভারত। কিন্তু গোল বাঁধল বাংলাকে নিয়ে। তার কারণ, মাত্র দেড় মাসের মধ্যে দেশভাগ-পরবর্তী মানচিত্র তৈরি করার দায়িত্বে ছিলেন যে সিরিল র্যাডক্লিফ, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (পরে বাংলাদেশ) ভাগে দিয়ে দিয়েছিলেন মালদা এবং নদীয়ার মতো বাংলার হিন্দু অধ্যুষিত জেলা। এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অগাধ বৈচিত্র্য এবং জটিল সামাজিক ও ধর্মীয় সমীকরণ সম্বন্ধে তাঁর অজ্ঞতা, এবং কিছুটা দায়ী ছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ইংল্যান্ডে ফেরার তাড়া, যার ফলে তিনি ক্রমাগত দ্রুত দেশভাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করে চলেছিলেন র্যাডক্লিফের ওপর।
ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণার ফলে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে গোটা অঞ্চলে। এখানকার বাসিন্দারা ১৫ অগাস্টকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। পূর্বপুরুষদের মুখে শোনা গল্প উদ্ধৃত করে বর্তমান প্রজন্মের বাসিন্দারা বলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিক নেতা এবং নদীয়ার রাজপরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রতিবাদ নিয়ে হাজির হন কলকাতায় ব্রিটিশ প্রশাসনের দরবারে, এবং মাউন্টব্যাটেনের কানে খবর পৌঁছয়। তড়িঘড়ি মানচিত্র বদলানোর আদেশ দেন ভাইসরয়, যাতে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি ভারতেই থাকে, এবং মুসলমান অধ্যুষিত জেলা যায় পূর্ব পাকিস্তানে। এই প্রক্রিয়া শেষ হয় ১৭ অগাস্ট গভীর রাতে।
আরও পড়ুন: কীভাবে আমরা পেলাম আমাদের পতাকা?
ভারতের ইতিহাসের এই অপেক্ষাকৃত অখ্যাত ঘটনার উদযাপন আজও হয়ে চলেছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কিছু গ্রামে। ১৫ অগাস্টের বদলে ১৮ অগাস্ট এখানে পালিত হয় স্বাধীনতা দিবস, এবং এই মুক্তি স্রেফ ব্রিটিশদের হাত থেকে নয়, পূর্ব পাকিস্তানের হাত থেকেও, এমনটাই ভাবা হয় এখানে। কারণ এই সেই দিন, যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে যোগ দেয় গ্রামগুলি।
নদীয়ার ছোট্ট গ্রাম শিবনিবাস, কলকাতা থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথ। এখানে ১৯৯১ সাল থেকে ১৮ অগাস্টে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের আয়োজন করে আসছেন ৪৯ বছর বয়সী অঞ্জন শুকুল। "আমার দাদু ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, গল্পটা তাঁর কাছেই শোনা, যদিও কোনও লিখিত নথিপত্র নেই," indianexpress.com কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, গ্রামের সবাই পুরুষানুক্রমে জানেন স্বাধীনতা দিবস কেন ১৮ অগাস্ট ধার্য হয়েছিল, কিন্তু শুকুল উদ্যোগ নেওয়ার আগে পর্যন্ত দিনটি সেভাবে উদযাপিত হতো না। "এর আগে কেউ ১৫ অগাস্টের পর জাতীয় পতাকা তোলার সাহস পেতেন না," বলেন অঞ্জনবাবু। তাঁর ধারণা, 'লোকে কী ভাববে', এই সঙ্কোচেই গুটিয়ে ছিলেন গ্রামবাসীরা।
আরও পড়ুন: ১৫ অগাস্ট দিনটিতেই কেন পালিত হয় ভারতের স্বাধীনতা দিবস?
অন্যদিকে উত্তর ২৪ পরগণার বনগাঁ শহরে আজ থেকে ১১ বছর আগে আদালত চত্বরে ১৮ অগাস্ট জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয় বনগাঁ বার অ্যাসোসিয়েশন। বনগাঁর ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তথা বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সমীর দাস বলেন, "বনগাঁ মহকুমা স্বাধীনতা পায় ১৮ অগাস্ট, ১৯৪৭, সকাল সাড়ে দশটায়, যখন আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অংশ হই। আমাদের স্বাধীনতা ১৫ অগাস্ট আসে নি।"
সমীরবাবু আরও বলেন, এই মর্মে কিছু নথিপত্র বনগাঁ মহকুমা অফিসে এখনও রয়েছে, এবং শহরবাসী তাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন। "কী নজরে দেখা হবে, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল অনেকের মনেই, কাজেই এর আগে আমরা এই দিনটি পালন করতাম না," বলেন তিনি। প্রথম প্রথম স্থানীয় কোষাগারে উত্তোলিত হতো জাতীয় পতাকা, যার পর আদালত চত্বরে স্থানান্তরিত হয় ঘটনাস্থল। সমীরবাবুর কথায়, "১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭-এর পরের কয়েকটা দিন পূর্ব পাকিস্তানের পতাকা উড়েছিল এখানে, কিন্তু ১৮ অগাস্ট প্রথমবার ওড়ে ভারতের তেরঙ্গা।"
নদীয়া জেলায় শিবনিবাস ছাড়াও ১৫ অগাস্টের পর স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয় শান্তিপুর, কল্যাণী, বনগাঁ, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, শিকারপুর এবং করিমপুরে, যেহেতু প্রত্যেকটি শহরই প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল। "১৭ অগাস্ট রাতে ভারতের অংশ হয় রানাঘাট, যার ফলে ওরা সেদিন পালন করে দিনটি," বলেন অঞ্জন শুকুল।
মালদা জেলার রতুয়া গ্রাম এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটেও ১৫ অগাস্টের পর পালিত হয় স্বাধীনতা দিবস। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দিন অনুযায়ী ঠিক হয়, কবে কবে উদযাপিত হবে 'ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে'। "১৫ অগাস্টেও আমরা পতাকা উত্তোলন করি, কিন্তু আনুষ্ঠানিক উৎসব হয় ১৮ অগাস্ট," বলেন অঞ্জনবাবু।