১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার পর একটা বড় সমস্যা দেখা দেয় ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে। ইতিহাস বলে এই দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল। এই সুত্রে বলতে হয় আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেরও একটা ইতিহাস আছে। আর তা হল কোচবিহারের ভারতভুক্তির ইতিহাস। লেখক/ঐতিহাসিক ড. নৃপেন্দ্রনাথ পাল তাঁর সম্পাদিত বই ‘বিষয়ঃ কোচবিহার’(১৯৯৪)- এর প্রস্তাবনায় লিখেছেন “কোচবিহার আজ পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা মাত্র। একদিন এই কোচবিহার ছিল স্বাধীন রাজ্য। বিস্তীর্ণ এই রাজ্যের স্থপতি ছিলেন মহারাজ বিশ্বসিংহ।”
জানা যায় কোচবিহারের এই সূচনার ইতিহাস, এরপর ১৯৪৯ সালের ২৮ অগস্ট কোচবিহার আরও এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। ওই দিন তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯ কোচবিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে কোচবিহার একটা জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
কোচবিহারের ভারতভুক্তির এই ইতিহাস নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা কথা বলেছিল কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষীয়ান অধ্যাপক জ্যোতিপ্রসাদ রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন -
“১৯৪৯ সালে ২৮ অগস্ট একদা স্বাধীন রাজ্য কোচবিহার, ভারতভুক্ত হলেও এই মাহেন্দ্রক্ষণের একটা সলতে পাকানোর ইতিহাস আছে। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্-মুহূর্তে দেশাত্মবোধের মহৎ আবেগ ও বাঁধভাঙা আনন্দে আপ্লুত হয়ে তখনকার অন্যতম জাতীয় নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে শুভেচ্ছা বার্তায় লিখেছিলেন মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ : ‘…you can count upon my whole hearted co-operation and my very best wishes in the prosecution of any policy that you my think it necessary to adopt for the restoration of peace and for the eradication of poverty.’(১২.৮.১৯৪৭) দেশপ্রেমিক কোচবিহার রাজের বক্তব্য জানার পর তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করে বল্লভভাই প্যাটেল জানালেন : ‘I should like to take this opportunity of thinking your Highness for so readily agreeing to accede to the Indian Dominion, along with Assam and West Bengal.’ (১৭.৮.১৯৪৭) তদানীন্তন ভারত সরকারের সঙ্গে মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে অবশেষে ভারতের স্বাধীনতা লাভের দু’বছর পর প্রজাদের ভবিষ্যত জীবনে শান্তি, সুস্থিতি, উন্নতি, মঙ্গল এবং বৃহত্তর অর্থে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য একদা রাজন্য শাসিত স্বাধীন দেশীয় রাজ্য কোচবিহার, ভারত ইউনিয়নের মানচিত্রে জুড়ে যায় ২৮ অগস্ট ১৯৪৯। মহারাজের এই উদার প্রজাপ্রীতি ও দেশব্রতী মনোভাবের স্বরূপ পরিস্ফুট হয়েছে ভারতভুক্তির মুহূর্তে কোচবিহারবাসীর উদ্দেশ্যে জারি করা শুভেচ্ছা-বার্তায় : ‘we shall always watch with keen interest your moral and material welfare and always pray of your happiness and prosperity.’
আরও পড়ুন বেঙ্গল থিয়েটার ও বাংলার সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রথম অভিনেত্রী নিয়োগের সার্ধশতবর্ষ
এই সব স্বল্প-জানা নথি থেকে বোঝা যায়, মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে সেদিন রাজকীয় কৌলিন্যের মহিমা দূরে সরিয়ে রেখে প্রজা তথা দেশবাসীর সামাজিক, অর্থনৈতিক মানের উন্নতির কথা চিন্তা করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য মিশিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষের মানচিত্রে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আগামীদিনে কোচবিহারবাসীর অস্তিত্ব, স্বপ্ন, আবেগ, কৃষ্টি, সংস্কৃতির চর্চা তথা ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে শুধুমাত্র প্রান্তিক রাজন্য শক্তি কিংবা রাজস্বের ওপর নির্ভর করলে হবে না; সামগ্রিকভাবে কোচবিহারের সমাজব্যবস্থায় সুখ-শান্তি-উন্নতি, জীবনযাত্রার মানের ক্রম-স্বাচ্ছন্দ্যের দিশা পাওয়ার জন্য ভারতভুক্তি জরুরি।”
আরও পড়ুন ঐতিহ্যের নদিয়া: যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে বাঙালির অভিজাত ইতিহাস
এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন কোচবিহারে ধূমধাম করে পালন করা হয়, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। অধ্যাপক রায়ের কাছ থেকে এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন - সারা দিন রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরির মধ্যে কোচবিহার জেলা জুড়ে গত ২৮ অগস্ট অনুষ্ঠিত হল ৭৪তম ‘ভারতভুক্তি দিবস’। মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় নিউ কোচবিহার রেল স্টেশন সংলগ্ন ফুটবল মাঠে। আয়োজন করে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস্ অ্যাসোসিয়েসন, যার প্রধান হলেন অনন্ত রায়(মহারাজ)। এই অনুষ্ঠানে অনন্ত রায়(মহারাজ) ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক এবং কোচবিহার জেলার বিজেপি’র বিধায়ক, কর্মী-সমর্থকরা। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা গেছে। কোচবিহার শহর ছাড়াও দিনহাটা, মেখলিগঞ্জ, তুফানগঞ্জ ইত্যাদি মহকুমার নানা স্থানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যমে এই গৌরবময় দিনটি স্মরণ করেন কোচবিহারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতন কৃতিজন ও সাধারণ নাগরিকেরা।
জি.সি.পি.এ.-র এই উদযাপন অনুষ্ঠান সম্পর্কে অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ২৫ বছর ধরে এই দিবস পালন হচ্ছে। এই দিনে ১৯৪৯ সালে ভারতের গভর্নর ভিপি মেনন ও কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দিপেন্দ্র নারায়ণ ভুপবাহাদুরের মধ্যে ভারত ও কোচবিহার রাষ্ট্রের চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এর পর থেকে কোচবিহার ভারতের একটি রাজ্যে পরিণত হয়। চুক্তির পুনর্নবীকরণ ও কোচবিহার রাজ্য পুনর্গঠনের দাবিতে জি.সি.পি.এ. মহারাজ অনন্ত রায়ের নেতৃত্বে ২৫ বছর যাবৎ এই আন্দোলন চলে আসছে।