Advertisment

কেন বামপন্থী এই লোকসভা নির্বাচন

সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বামপন্থীরা তিন শতাংশের নিচে ভোট বা কুড়ির কম আসন পেলেও ক্ষতি নেই। তাঁদের চাপেই স্বাধীন ভারতে এই প্রথম সব দল লোকসভা ভোটে বামপন্থী বুলি আওড়াচ্ছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Farmers Rally in wake of Pulwama Incident

দ্বিতীয় দফার লং মার্চে কৃষকরা। ফাইল ছবি

ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে অনেকেই স্বচ্ছল নন। এঁদের মধ্যে আবার নব্বুই কোটি ভোটার। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের বেশিরভাগেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। গোটা দেশে হয়ত দশ কোটি মানুষ আছেন যাঁদের জীবন চলছে বেশ মসৃণভাবে, বাকি আরও কুড়ি কোটি যোগ করতে পারেন যাঁরা মোটামুটি ভালো আছেন তাঁদের নিজস্ব পাটিগণিতে। কিন্তু বাকি ১০০ কোটি, ইংরিজিতে যাকে বলে এক বিলিয়ন, সবসময়ই কোনও না কোনও আর্থিক অসুবিধার মধ্যে দিন কাটান। এই নির্বাচনে সেই একশো কোটির প্রতি নেতাদের প্রতিশ্রুতির বন্যা এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।

Advertisment

সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচার নিম্নবিত্তের উন্নয়ন, সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্যে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। একটা অঙ্ক এ প্রসঙ্গে পরিষ্কার। তা হলো, যে পরিমাণ টাকাই কোন নাগরিককে দেওয়া হোক না কেন, তা আজকের দিনে হাজারের কম হলে পুরো বিষয়টা অর্থহীন হয়ে পড়ে। আর সারা দেশে শ্রমিক বা কৃষক, যাঁদের কাছে এই ভাতা পৌঁছনোর কথা, সেই সংখ্যাটা দেশজুড়ে অবশ্যই কমপক্ষে দশ কোটির অঙ্কে। অর্থাৎ আসমুদ্র হিমাচলের হিসেবে এই ধরনের যে কোন প্রকল্পের একক হলো এক হাজার গুণ দশ কোটি, অর্থাৎ দশ হাজার কোটি টাকা। আবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে এটা হল ন্যুনতম খরচের একক।

আরও পড়ুন: ভোট দিতে যাওয়ার আগে মনে রাখবেন…

মোদী সরকারের শুরুর দিকে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ করে ভরে দেওয়ার প্রতীকী প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই ধরনের প্রচারের শুরু। সেসব অতিরিক্ত শূন্যের গল্প রাজত্বের শুরুর দিকে আলোড়ন তুলেছিল, কিন্তু শেষের দিকে আর ঠিকঠাক কাজ করে নি। বিপদ বুঝেই বিজেপি সরকারের শেষ বাজেটে এসেছে শ্রমিকদের ভবিষ্যনিধি এবং কৃষকদের তিন খেপে দু'হাজার করে মোট ছ'হাজার টাকার গল্প। এর মধ্যেই এক কিস্তি দু'হাজার কৃষকদের ব্যাঙ্কে পৌঁছে গিয়ে থাকার কথা। তবে সেটা ঠিক কবে কোথায় কিভাবে পৌঁছেছে, অথবা পৌঁছচ্ছে অথবা পৌঁছবে, সে খবর নির্বাচনী প্রচারে অনুপস্থিত। আর শ্রমিকদের ভবিষ্যনিধির টাকার উপন্যাস তো ছাপা হবে বহুদিন পরে, ফলে সে আলোচনা আপাতত শুরু হওয়ার প্রশ্নই নেই। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়াটা অনেক সহজ।

আম আদমির কথা ভেবে কংগ্রেস হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই কৃষিঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই ঋণ মকুবে কতজন কৃষক উপকৃত হলেন, সে তথ্য এখনও গণমাধ্যমে অনুপস্থিত। এর মধ্যেই রাহুল গান্ধী সর্বজনীন ন্যুনতম আয়ের কথা ঘোষণা করেছেন। সেখানে আবার বছরে প্রতি পরিবার পিছু বাহাত্তর হাজার টাকা, পাঁচ কোটি পরিবারের জন্যে। গুণ করতে একটু পরিশ্রম হবে, তবে শূন্যগুলোকে বাদ দিয়ে ৭২ কে ৫ দিয়ে গুণ করলে হয় ৩৬০। তারপর ঠিকঠাক শূন্য বসালে মোট টাকা দাঁড়ায় তিন লক্ষ ষাট হাজার কোটি।

indian farmer loan কংগ্রেস শাসিত রাজ্যে ঋণ মকুবের ফলে কতজন কৃষক উপকৃত হলেন, সে তথ্য এখনও গণমাধ্যমে অনুপস্থিত

ভাবছেন কি এই টাকা অনেক বেশি? মোটেই না। ভারতের ২০১৯-২০ র বাজেটে মোট খরচ ধরা হয়েছে প্রায় আঠাশ লক্ষ কোটি টাকা। আর এই বাজেটেই পিছিয়ে থাকা মানুষদের জন্যে রাখা হয়েছে তিন লক্ষ সাতাশ হাজার কোটির বেশি। এর মধ্যে আছে এমএনআরজিএ, স্বচ্ছ ভারত মিশন, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, জাতীয় শিক্ষা মিশন গোছের বিভিন্ন পরিকল্পনা। শেষ বাজেটে কৃষকদের জন্যে ঘোষিত হয়েছে 'প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি'। দু'হেক্টরের কম যাঁদের জমি, সেই সমস্ত কৃষকের কাছে তিনবারে দু'হাজার টাকা করে পৌঁছে যাবে ছ'হাজার। বাজেটে পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে এই কারণে, যার মধ্যে কুড়ি হাজার কোটি নেওয়া হয়েছে ২০১৮-১৯ এর বাজেট থেকে। অর্থাৎ একটা বিষয় কিন্তু একেবারে পরিষ্কার, যে আমাদের বাজেটে যথেষ্ট টাকা আছে নিম্নবিত্ত নাগরিকের অন্ন সংস্থানের জন্য।

আরও পড়ুন: আগামী সরকার হোক অনিশ্চিত সরকার

এখন প্রশ্ন হলো, এইসব বিষয়ে বিজেপি বা কংগ্রেসের মতো দলকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে কেন? এক সময়ে সারা দেশে প্রায় সাত-আট শতাংশ ভোট পাওয়া বামেদের শক্তি কমে এখন দুই-তিন শতাংশে। তাহলে কেন এতো ভাবতে হচ্ছে কৃষক কিংবা শ্রমিকদের কথা? মানুষের দুঃখ যতই থাক, ভোট তো যাবে মূলত বিজেপি এবং কংগ্রেসের ঘরে, অথবা সেই সমস্ত ডান অথবা মধ্যপন্থী দল থেকে ভেঙে বেরিয়ে আসা কিছু আঞ্চলিক শক্তির কাছে। অথবা ভারতের দক্ষিণে রুপোলী পর্দা থেকে জাদুকাঠি হাতে আবির্ভূত নেতৃবৃন্দ, তাঁদের পরিবার কিংবা সাঙ্গপাঙ্গদের দখলে।

আসলে বিষয়টা হলো, রাজনৈতিক দল হিসেবে বামেদের সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রে অন্যান্য বড় জাতীয় বা আঞ্চলিক দলগুলোর কোন তফাৎ নেই। এক দলের ভোটে জেতা নেতা অন্য দলের নির্বাচিত প্রতিনিধির মতোই একই গুণসম্পন্ন। দলবদলে তাই মানুষগুলোর চেহারা বদলায় না। কিন্তু পিছিয়ে থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে, আন্দোলনের পথে, লড়াইয়ের ময়দানে বামপন্থীদের প্রভাব তুলনায় বেশি। যে কোনও কর্মী আন্দোলনের সামনের সারিতে অবশ্যই বাম মনোভাবাপন্ন নেতাদের খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ। নীতিভিত্তিক রাজনীতিতে তাঁদের কর্মপদ্ধতি অনেক সংবেদনশীল।

শিক্ষাগত যোগ্যতায় তাঁদের মধ্যে অনেকেই বড় কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের থেকে কম নন। তাই ভোটের অঙ্কে ধাক্কা খেলেও শোষিত মানুষের দাবিদাওয়ার জায়গায় দেশজুড়ে বামেদের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে। তাদের নেতৃত্বে কৃষকদের লম্বা মিছিলের ছবি অবহেলা করতে পারছে না সংবাদমাধ্যম। সেই হাওয়াতেই গত বছরের শেষে হিন্দি বলয়ে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। তারপর আর নোটবাতিলে কাজ হয় নি, বারবার করে বিজেপিকে বলতে হয়েছে নিম্নবিত্ত মানুষদের উন্নয়নের কথা। সে হাওয়ার গতি বুঝতে পেরেছে কংগ্রেসও। সেই কারণেই এই লোকসভা ভোটের আগে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষদের জন্যে প্রতিশ্রুতির বন্যা।

আরও পড়ুন: কংগ্রেসের কিছু চাল কি আগ্রাসী বিজেপির সুবিধে করে দিচ্ছে?

কিন্তু অনুপস্থিত রয়ে যাচ্ছে যে কথা, তা হলো এই টাকা কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতার নয়। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্য কোনও নেতা পকেট থেকে টাকা দিচ্ছেন না। সে টাকা এই দেশেরই টাকা। সে টাকার একটা বড় অংশ শেয়ার বাজার থেকে আসে না, আসে কৃষিজ সামগ্রী কিংবা ছোট থেকে বড় অসংখ্য শিল্পক্ষেত্র থেকে। পরিষেবা ক্ষেত্রেও কাজ করেন বহু অভাবী মানুষ। মোটরবাইকে চড়ে মুখরোচক খাবার পৌঁছে দেন দেশের স্বচ্ছল মানুষদের ঘরে। অর্থাৎ চিরন্তন যে ভারতবর্ষ, যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে বাকিরা বহু বছর ধরেই আছেন, সঙ্গে সমাজ বদলের নিয়মে নতুন করে যোগ হয়েছেন এক বিশাল পরিষেবা ক্ষেত্রের অসংখ্য কর্মী।

সরকার বড় মুখ করে যে অর্থ পিছিয়ে থাকা মানুষদের দেবেন বলছেন, তার উৎপাদন এঁদের হাত ধরেই। ফলে এতে রাজনৈতিক নেতাদের মহত্ত্ব কিছু নেই। সেটা দেশের সমস্ত নিম্নবিত্ত মানুষের ন্যায্য দাবী। বিজেপি বা কংগ্রেসের জনমোহিনী ঘোষণায় যে প্রচার অনুপস্থিত, তা হলো এই দাবীর কথা। সেটাকে সম্প্রদানের সংজ্ঞায় ফেলে ভোট প্রচারের প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিক্রি করলে এর বাস্তবায়ন হবে না কোনোদিনই। পরিষেবার ক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদেরও আনতে হবে এর আওতায়। দেশজুড়ে প্রচুর মানুষ কাজ করছেন দুশো থেকে পাঁচশো টাকা রোজে। তাঁদের মাস মাইনে নেই। নেই সামাজিক সুরক্ষা। এজেন্সির মাধ্যমে তাঁদের নিয়োগ করে খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে অনেক বেশি। নির্বিঘ্নে চালু থাকছে 'শোষণের মাধ্যমে অধিক কর্মদক্ষতার' ডানপন্থী তত্ত্বও। সরকারি ক্ষেত্রেও প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই ধরনের নিয়োগ চলছে গোলমেলে আইন এনে। বেসরকারি ক্ষেত্রে সেই শোষণের মাত্রা সীমাহীন।

সমাজবিজ্ঞানের দুটো দিক আছে। একদিক বলে মানুষকে বিনা পরিশ্রমে খেতে দিলে সে আর কাজ করবে না। দেশে উন্নয়নের গতি কমে যাবে। এটা মোটামুটি ডানপন্থী মতামত। আর সেই মতেই চুঁইয়ে আসা আশার আষাঢ়ে পুঁজি ভাগযোগ করে বেঁচে আছেন আমাদের একশো কোটি সহ-নাগরিক। এভাবে তো স্বাধীনতার পর থেকে ভালোই চলছিল। তাহলে হঠাৎ করে এবারের নির্বাচনে এত বামপন্থী প্রচার কেন? প্রথম কথা, ভোট। নির্বাচনে জিততে গেলে নিম্নবিত্ত মানুষের ভোটেই জিততে হবে। তাঁদের সংখ্যা এখন প্রচুর। আর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল উন্নতিতে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে তথ্য। তাঁরা প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছেন, সাহস করে জিজ্ঞাসা করছেন।

ঠিক সেই জায়গাতেই পিছু হটছে বিজেপি বা কংগ্রেসের মত দলগুলি। বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে ফেরত না নেওয়ার চিরকালীন পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে রাজনীতি। এবার ধীরে ধীরে তা বদলে যাওয়ার পালা শুরু। সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বামপন্থীরা তিন শতাংশের নিচে ভোট বা কুড়ির কম আসন পেলেও ক্ষতি নেই। তাঁদের চাপেই স্বাধীন ভারতে এই প্রথম সব দল লোকসভা ভোটে বামপন্থী বুলি আওড়াচ্ছে। যে দলই কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসুক না কেন, এ দেশের একশো কোটি নজর রাখবে নীতি নির্ধারকদের দিকে। প্রতিশ্রুতি নয়, প্রয়োজন বাস্তবায়নের। সেই দাবি সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে চলুক সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন। দলমত নির্বিশেষে যাত্রা শুরু হোক আমাদের ভারতবর্ষে দারিদ্র্য নির্মূলকরণের শেষ যুদ্ধের পথে।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment