শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বারাণসী কেন্দ্রে প্রার্থী হতে রাজি হলেন না। বলা ভাল, তিনি প্রার্থী হলেন না। কারণ দিল্লির গুঞ্জন বলছে, রাজীব-তনয়া ভোট লড়তে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দল নয়, গান্ধী পরিবারের সিদ্ধান্ত হলো, ভোটে মোদীর বিরুদ্ধে প্রিয়াঙ্কার প্রার্থী হওয়া অনুচিত। গান্ধী পরিবার মানে আসলে মা সনিয়া গান্ধী। অবশ্য প্রিয়াঙ্কাকে যাঁরা চাইছেন, তাঁরা আবার ভোটের বাতাসে এক নতুন প্রস্তাব ভাসিয়ে দিয়েছেন। সেটা হলো, রাহুল কেরালায় যেমন লড়ছেন লড়ুন, কিন্তু আমেঠি আসনটিতে প্রিয়াঙ্কাকে লড়তে দিন। তবে আমি শুনছি, সনিয়া একই সঙ্গে পুত্র এবং কন্যা দুজনকেই রাজনীতির মার্কেটে 'লঞ্চ' করতে রাজি নন। সেটাই গান্ধী পরিবারের রাজনীতির পুরোনো কৌশল।
সঞ্জয় এবং রাজীব গান্ধীও তো দুজনে একসঙ্গে রাজনীতির মঞ্চে অবতীর্ণ হন নি। সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পরই রাজীব রাজনীতিতে আসেন। এবারও সনিয়া প্রিয়াঙ্কাকে নন, রাহুলকেই বেছে নিয়েছিলেন। রাহুল নিজে রাজনীতির আজকের হাল হকিকতে কতটা সত্যি সত্যি উৎসাহী, কতটা সত্যি সত্যি এই রাজনীতিতে সাফল্য অর্জন করতে পারেন, এসব নিয়ে আমার মনেও অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু সনিয়া রাহুলকেই বেছে নেন। বিশেষত জামাই রবার্ট ভদরাকে নিয়ে এত বিতর্ক তৈরী হয় যে সনিয়া কিছুটা বিরক্তই ছিলেন।
আমার সাংবাদিকতার গুরু প্রয়াত বরুণ সেনগুপ্ত বহু বছর আগে বলেছিলেন, ভারতীয় সমাজে এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের উত্তরাধিকার আইনে মেয়েদের থেকে ছেলেদেরই প্রাধান্য। সমাজ যতই আধুনিক হোক, ভারতীয় রাজনৈতিক উত্তরাধিকারে এখনও পুরুষদের আধিপত্য অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত বরুণবাবুর কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়।
কংগ্রেস নেতারা অবশ্য বলছেন, আসলে বারাণসী আসনে ইতিমধ্যে সমাজবাদী দলের প্রার্থী শালিনী যাদব মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। তিনি যদি মনোনয়ন প্রত্যাহার করতেন, আর মায়াবতীও যদি এই প্রত্যাহার মেনে নিতেন, তবে প্রিয়াঙ্কা লড়তেন। এই তত্ত্ব সম্পর্কেও আমার মত একটু অন্য রকম। আমার মত হলো, যদি সত্যিই ভোটযুদ্ধে প্রিয়াঙ্কাকে লড়ানোর কৌশল থাকত, তাহলে তো উচিত ছিল অনেক আগে থাকতেই কৌশল রচনা করা। অখিলেশ যাদবের সঙ্গে রাহুল কথা বলতে পারতেন। তাই না? যেখানে আপনার বিরোধী প্রার্থী অন্য কেউ নন, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী, যিনি সমস্ত পদক্ষেপ ভাবনা-চিন্তা করে নেন। আজও যার জনপ্রিয়তা এবং কৌশল সাংঘাতিক। রাজনীতিতে মোদীর মত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এহেন ছেলেমানুষি, তাও আবার ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়?
যেদিন নরেন্দ্র মোদী বারাণসীতে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেন, তার আগের দিন এই বারাণসী শহরেই হয় এক অভূতপূর্ব রোড-শো। আর সেদিন কংগ্রেস বারাণসীতে তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করল। কে হলেন কংগ্রেস প্রার্থী? তার নাম অজয় রাই। এই ভদ্রলোক গতবারও নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন, এবং তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। গতবার অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী। এবার তো লড়াইয়ের ময়দানে তিনিও নেই। এই ঘটনায় কংগ্রেস শিবিরে এখন হতাশা নেমে এসেছে। বিজেপি প্রচার শুরু করে দিয়েছে যে প্রিয়াঙ্কা ভয় পেয়ে গেছেন।
আবার একথাও তো রটেছে যে প্রিয়াঙ্কা চাইলেও রাহুল চান নি। কংগ্রেসের কিছু নেতা একথাও বলছেন যে, রাহুল চান নি যে তাঁর বোন জীবনের প্রথম নির্বাচনে হেরে যান। কিন্তু ভোটে জেতা বা হারা নয়, মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে হেরে গেলেও প্রিয়াঙ্কার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হত, একথাও অনেকে মনে করছেন। অনেকের বক্তব্য, সুষমা স্বরাজ বেলারিতে সনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হন, কিন্তু হেরে গিয়েও সুষমার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়নি। বরং এক-একটা নির্বাচন কেন্দ্রকে এক একজন ভিআইপির নামে চিহ্নিত করে সেখানে শক্তিশালী প্রতিপক্ষর চ্যালেঞ্জ তৈরি না করা, সেও এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। আসলে প্রিয়াঙ্কার ভোটে লড়ার বেলুন ওড়ানো, তারপর ভোটে না দাঁড়ানো, এ তো দুদিক থেকেই লোকসান হল কংগ্রেসের।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি এবার কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক কৌশলটাই বুঝতে পারছি না। ২০১৪ সালে মোদীর বিপুল ভোটে জয়লাভের পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ অটুট এমনও তো নয়। বরং মোদীর বিরুদ্ধেও সাধারণ মানুষের অসন্তোষ ছিল ক্রমবর্দ্ধমান। তিন বছরের মাথায় দেখেছিলাম, রাহুল গান্ধী সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। যে রাহুল গান্ধীকে মানুষ 'পাপ্পু' সম্বোধন করতেন, সেই রাহুলই পরিণতমনস্ক হয়ে উঠেছেন, এমনটাই তো মনে হচ্ছিল। কৃষক আন্দোলন, দলিত সমাজের বিদ্রোহ, চাকরির অভাব, এসমস্ত মনে হচ্ছিল এক বড় প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আর আজ যখন ভোট যুদ্ধ চলছে, তখন রাহুল গান্ধী কী করছেন? ভোটের আগেই কার্যত কংগ্রেস নেতারা যেন হার স্বীকার করেই নিয়েছেন। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা তো বলেই বসলেন, ২০১৪ সালে কংগ্রেস ৪৪টি আসন পেয়েছিল, এবার তা বাড়লে কত হতে পারে? ১০০? ১২৫? বুঝুন। এ হলো দলের শীর্ষ নেতার অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ।
এই যদি পরিস্থিতি হয়, তবে কি রাহুল গান্ধীর উচিত ছিল না, ভোটের অনেক আগেই অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির সাথে বোঝাপড়া গড়ে তোলা? আমার মনে আছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি এসে রাহুল গান্ধীকে বলেছিলেন, যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক দল আছে তাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আর দিল্লিতে একটা ফেডারেল ফ্রন্ট না হোক, সর্বভারতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সে কমিটির একজন আহ্বায়ক হতে পারেন। তখন কংগ্রেস জোট তো দূরের কথা, একলা চলো নীতি নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে কংগ্রেসের পুনরুত্থানের স্বপ্ন দেখছেন।
উত্তরপ্রদেশে গতবার কংগ্রেস জিতেছিল দুটি আসনে। ছয়-সাতটি আসনে কংগ্রেস দ্বিতীয় হয়েছিল ৮০টি আসনের মধ্যে। অথচ সেই কংগ্রেস এবার ভোটে গঠবন্ধন নয়, সর্বত্র প্রার্থী দেওয়ার কৌশল নিল। অখিলেশ-মায়াবতী জোট হল। মায়াবতী কংগ্রেসকে নিতে রাজি হলেন না। এ অবস্থায় যদি মহাগঠবন্ধনকে মর্যাদা দিয়ে কংগ্রেস সম আসনে প্রার্থী দিয়ে মায়াবতীর সঙ্গে আরও বোঝাপড়ার চেষ্টা করত, তবে সেটাই বোধহয় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হত। কর্ণাটকে আপোস করে কংগ্রেস বিজেপিকে সরাতে পেরেছে। রাজ্যস্তরে কিন্তু রাহুল গান্ধী যে এখনও জোট সংস্কৃতিতে দড় নন, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে মমতা থেকে মায়াবতীর মতো নেতৃত্বের সঙ্গে বোঝাপড়ার রাজনীতি দেখে।
সনিয়া গান্ধী পাঁচমারির অধিবেশনে জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, দল সেই রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে। রামবিলাস পাসোয়ানের জনপথের বাড়িতে সনিয়ার হেঁটে চলে যাওয়া আজও সকলের মনে আছে। ওই হেঁটে যাওয়া যে খুব জরুরি ছিল তা নয়, কিন্তু সেটা ছিল প্রতীকী। সনিয়া এই বার্তা দিয়েছিলেন যে, পুরনো জমিদারি সামন্ততান্ত্রিক একদলীয় আধিপত্যের মানসিকতা ছেড়ে কংগ্রেস শরিক দলকে বিশেষ মর্যাদা দিচ্ছে।
আর রাহুল কী করছেন? বিহারে যতবার গেছেন, তেজস্বী যাদবকে দেখা যায় নি। তিনবার বিহার সফরের পর অনেকের পরামর্শ মেনে তেজস্বীকে ফোন করে রাহুল যৌথ সভা করেছেন বটে, কিন্তু এই ঐক্য খুব সহজ, স্বাভাবিক নয়। শরদ পাওয়ারের সঙ্গেও সম্পর্কে যথেষ্ট জটিলতা। দেবগৌড়া ও তাঁর পুত্রের সঙ্গেও নানা বিষয়ে, বিশেষত কর্ণাটকে রাজ্য শাসন নিয়ে মতান্তর হচ্ছে। একমাত্র তামিলনাড়ুর স্টালিন প্রকাশ্যে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী করার কথা বলেছেন। এআইএডিএমকে-র বিজেপি সঙ্গের প্রতিবাদে। এমনকি সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বাধীন সিপিএম সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়বার তাগিদে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে জোট গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল, সেই বাম শিবিরকেও রাহুল চটিয়ে দিলেন কেরালায় সিপিআই প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন লড়ে। এর ফলে সিপিএমের মধ্যেও প্রকাশ কারাত লবি, যা ঘোরতর কংগ্রেস বিরোধী, তার হাত শক্ত হয়েছে। অস্বস্তির স্বীকার হয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি।
আর রাহুল যখন মহাগঠবন্ধনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তখন মোদী বারাণসীতে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেন এনডিএর শীর্ষ শরিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে। নীতীশ কুমার, আকালি নেতা বাদল থেকে শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরে, এমনকি উত্তরপূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হাজির। মনে হচ্ছিল, মোদীই উল্টে এনডিএর ঐক্য দেখিয়ে যেন মহাগঠবন্ধনের জবাব দিচ্ছেন। এসব দেখে-শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছি। সর্বশেষ প্রশ্ন, প্রিয়াঙ্কাকে যদি যুদ্ধে নামাতেই হত, তবে আরও আগে তার প্রস্তুতি কংগ্রেস নিল না কেন?