Advertisment

ওরে হাল্লা রাজার সেনা...

ভারতের উত্তরপূর্ব ভূখণ্ডে জঙ্গি হিংসায় সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনাগুলো ফিরে দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আসমুদ্র হিমাচল নড়ে যায় নি তখন। অধিকাংশ ঘটনাতে সাধারণ নাগরিক মাথাই ঘামান নি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
mamata, মমতা

মোমবাতি মিছিলে মমতা। ছবি: জয়প্রকাশ দাস।

পুলওয়ামায় জঙ্গিদের আত্মঘাতী আক্রমণে আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানের মৃত্যু নিয়ে দেশ তোলপাড়। সোশ্যাল মিডিয়াও ব্যতিক্রম নয়। শোক, ক্ষোভ, ক্রোধ উগরে দিচ্ছেন নেটিজেনরা। অনেকেই চাইছেন এক সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে এই হিংসার উৎসস্রোত বন্ধ হোক। এর পাশাপাশি শুরু হয়ে গিয়েছে ঘৃণার ব্যাপারীদের পসরা সাজানোও। বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখারও বিরাম নেই দেশজুড়ে।

Advertisment

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে খেলাধূলা এবং চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও জড়িয়ে পড়েছেন ঘৃণা ছড়ানোর এই বিপজ্জনক খেলায়, কেউ না বুঝেই, কেউ বা শুধুই পাদপ্রদীপের আলোয় আসার জন্য। সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত তীব্র ভাষায় বিষোদ্গার করেছেন শাবানা আজমি এবং জাভেদ আখতারের উদ্দেশ্যে, তাঁদের দাগিয়ে দিয়েছেন দেশদ্রোহী বলে। ঘোলা জলে মাছ ধরার এই বাজারে ব্যক্তিগত ক্রোধ এবং পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বীতা মিটিয়ে নিতে পারলে মন্দ কী?

আরও পড়ুন: পুলওয়ামা হামলার নেপথ্যে পাকিস্তানই, দাবি সেনার

ছোটোখাটো জঙ্গি হানায় সারা দেশে বছরভর মৃত্যুর ঘটনা প্রায়শই শোনা যায়। পুলওয়ামায় মৃতের সংখ্যা কিছুটা ব্যতিক্রমীভাবে বেশি। তবে জঙ্গি হানায় এরকম ব্যাপক সংখ্যায় মৃত্যুও প্রথম নয়। উদাহরণস্বরূপ, মাওবাদী হানায় সিআরপিএফ জওয়ানদেরই মৃত্যু হয়েছে একাধিকবার। এবং কখনো কখনো বেশ বড়ো মাত্রাতেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি পুলওয়ামা কাণ্ডের চেয়েও বেশি মানুষ মারা গেছেন। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে ছত্তিশগড় রাজ্যের দক্ষিণ বস্তারের দান্তেওয়াড়া জেলায় মৃত্যু হয় ৭৬ জন সিআরপিএফ জওয়ানের। এ ছাড়াও শিলদা'র ঘটনা এবং সেরকমই একাধিক উদাহরণ আছে।

পুলওয়ামের ঘটনাটি নিয়ে যে হারে দৃষ্টি আকর্ষণ করানো হচ্ছে, বা তোলা হচ্ছে যুদ্ধের জিগির, সেই ঘটনার তুলনার অধিকতর ভংয়কর মৃত্যুমিছিল, অন্ততঃ সংখ্যার বিচারে, এর আগেও ঘটেছে। তাহলে পুলওয়ামার বিশেষত্ব কী?

বিশেষত্ব এই, যে হামলা চালিয়েছিল বিশেষ একটি ধর্মের মানুষের দ্বারা গঠিত জঙ্গি সংগঠন। এবং অভিযোগ এটাই, যে সেই জঙ্গি সংগঠনটি একটি প্রতিবেশী দেশের মদতপুষ্ট, কাশ্মীর নিয়ে যে দেশের সাথে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী বিবাদ সর্বজনবিদিত। বিশেষত্ব আরোই, যে আমাদের দেশের সরকারের সমর্থকদের একটি বৃহৎ অংশের নির্দিষ্ট ধর্মভিত্তিক এজেন্ডা আছে, যে এজেন্ডায় সর্বাগ্রে রয়েছে বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের টার্গেট করে ভোট বৈতরণী পার করা। সামনেই সাধারণ নির্বাচন, পুলওয়ামার দুঃখজনক ঘটনা-পরবর্তী পর্যায়ের অন্য মাত্রা আছে বৈকি।

Pulwama terror attack crpf পুলওয়ামা স্মরণে কলকাতায় মোমবাতি মিছিল দাউদি বোহরাদের। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

জঙ্গি হানায় সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা এ দেশে নতুন নয়। পুলওয়ামার থেকে বেশিই প্রাণ গেছে এরকম একাধিক হানায়। এটিও ঘটনা নয় যে জঙ্গি হানা মাত্রেই বিশেষ এক ধর্মের মানুষ জড়িত। ভারতের উত্তরপূর্ব ভূখণ্ডে জঙ্গি হিংসায় (২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আসামে মৃত্যুমিছিলের কথাই ধরা যাক উদাহরণ হিসেবে) সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনাগুলো ফিরে দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষ এভাবে নড়ে যায় নি তখন। অধিকাংশ ঘটনাতে সাধারণ নাগরিক মাথাই ঘামান নি, অনেকে হয় তো খবরও রাখেন না সেইসব দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর।

পুলওয়ামা বিশেষ মাত্রা পেয়েছে এই কারণে, যে এটি সেনাবাহিনীর (আধা সামরিক বাহিনীর, প্রকৃত প্রস্তাবে) ওপরে হামলা। ফৌজিদের অন্য চোখে দেখে থাকেন এই উপমহাদেশের মানুষ। অন্য চোখে দেখতে মস্তকধৌতি করা হয় কার্যত। রাষ্ট্র অতি সূক্ষ্ম কৌশল প্রয়োগ করে এই মস্তকধৌতির কাজ চালিয়ে আসছে স্বাধীনতা ইস্তক। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রয়োজন আছে ফৌজিদের 'লার্জার দ্যান লাইফ' ইমেজ তৈরী করার। কেন সেই প্রয়োজন, এবং রাষ্ট্র কীভাবে তা হাসিল করে থাকে সুচতুর কৌশলে, সেই আলোচনায় ঢোকার আগে দেখে নেওয়া যাক 'দেশপ্রেমের' নিরিখে সেনা বা আধাসেনার প্রকৃত অবস্থান।

আরও পড়ুন: পুলওয়ামা হামলার জেরে গুলির লড়াইয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৯

সবার আগে আমাদের যেটা মাথায় রাখতে হবে, সেনা বা আধাসেনায় যাঁরা চাকরি করেন তাঁরা চাকরিই করেন মাত্র। এর সাথে দেশপ্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই। সেনাবাহিনীর (বা আধাসেনার, বা পুলিশের) চাকরি, একটি সরকারি চাকরিই। তার বিশেষ পদ্ধতি আছে নিয়োগের। সেখানে কোনো 'দেশপ্রেমের' পরীক্ষা হয় না, পরীক্ষা হয় শারীরিক সক্ষমতা (খেলাধুলা করতে গেলেও যেটির প্রয়োজন, অনেক 'এনডিউরেন্স স্পোর্টস' আছে যেখানে একজন সাধারণ সেনার থেকে বেশি শারীরিক সক্ষমতা প্রয়োজন হয় অনেক সময়, সেই খেলায় অংশগ্রহণকারীর) এবং টুকিটাকি আরো কিছু জিনিসের, লিখিত পরীক্ষাও থাকে। অন্যান্য অনেক সরকারি চাকরির পরীক্ষা যেমন হয়ে থাকে, তেমনই। অর্থাৎ যাঁরা সেনা হতে চলেছেন, তাঁরা সখৎ দেশভক্ত কিনা, সেটি বাজিয়ে নেওয়ার কোনো পদ্ধতি নেই রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে।

তাহলে কি চাকরি করতে করতে দেশভক্তি তৈরী হয় তাঁদের? সেই সম্ভাবনাও কম। কারণ, এটি দিনের শেষে চাকরিই মাত্র। সেই চাকরির শর্ত হিসেবেই বিপজ্জনক কাজে অংশগ্রহণ করতে হয় এঁদের, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের প্রাণ বাঁচানো থেকে শুরু করে জঙ্গি হানার মোকাবিলা করা, অর্থাৎ যে যে কাজে প্রাণের ঝুঁকি থাকে, সেসবই করতে হয় একজন ভারতীয় সেনাকে (বা আধাসেনাকে, অথবা উপদ্রুত অঞ্চলে পোস্টেড পুলিশ কর্মচারীকে)। এই যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষের মাল ও জানের রক্ষকের ভূমিকা পালন করা, এটি কিন্তু চাকরিরই শর্ত। এর সাথে দেশপ্রেমের কোনো যোগ তৈরির চেষ্টা বাতুলতার নামান্তর মাত্র।

একজন দমকল কর্মী যখন নিজের জীবন বাজি রেখে জ্বলন্ত বহুতল থেকে বাঁচিয়ে আনেন (ধরে নেওয়া যাক সেই বাড়িটিতে আগুন লেগেছিলো জঙ্গি হানায়) সাধারণ মানুষজনকে, কোন হিসেবে তখন তিনি একজন সেনার থেকে কম দেশপ্রেমী হলেন? সরকারি ব্যাঙ্কের এক সাধারণ দারোয়ান যখন জনগণের সম্পত্তি রক্ষার জন্য পুরোনো গাদাবন্দুক নিয়ে মুখোমুখি হন আধুনিক রিভলভার এবং বোমায় সজ্জিত ব্যাঙ্ক ডাকাতদের, কী কারণে তখন তিনি সহি দেশভক্ত নন?

kashmir, কাশ্মীর, Pulwama সেনাবাহিনীর চাকরিও চাকরিই মাত্র

এই প্রতিবেদকের বাড়িতে কাজ করতেন এক বিধবা মহিলা, যাঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন ডাকাতের হাতে। সেই ভদ্রলোক, বর্ধমানের কাটোয়াতে এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাগাল খাটা কর্মী, মালিকের ধানের বোঝা বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন হাটে, রাস্তায় তাঁকে ধরে ডাকাতদল। মালিকের সম্পত্তি বাঁচাতে সেই ভদ্রলোক প্রাণ দেন ডাকাতের ছুরির আঘাতে। কারণ তিনি সৎ কর্মী ছিলেন, তিনি মনে করেছিলেন চাকুরীদাতার সম্পত্তি রক্ষা তাঁর কর্তব্য, প্রাণের বিনিময়েও। তিনি কি একজন সেনার থেকে কম দেশপ্রেমী?

একজন সেনা কী করেন? নিজের প্রাণের ঝুঁকি নেন অন্যের মাল ও জান বাঁচাতে, এটাই তো? তাহলে কেন একজন দমকলকর্মী, দারোয়ান বা ভাগচাষি বাগাল খাটা মজুর দেশপ্রেমী নন সেই বিচারে? প্রত্যেকেই তো চাকরির শর্ত মানতেই করছেন যা করার, এবং মাঠ ছেড়ে পালাচ্ছেন না, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও যা ওঁদের কর্তব্য, তা পালন করে যাচ্ছেন, প্রসংশনীয় ভাবে। তফাৎটা ঠিক কোনখানে তাহলে?

আরও পড়ুন: পুলওয়ামা কাণ্ড: তুলে নেওয়া হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের নিরাপত্তা বলয়

কোনো তফাৎ নেই। এই দেশপ্রেমের তকমা, এই 'লার্জার দ্যান লাইফ' জলছাপ, রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত মাত্র। সুচতুরভাবে। কারণ যে সেনাবাহিনী বা আইনরক্ষকদের তুলে ধরা হয় দেশবাসীর রক্ষক হিসেবে, সেই সেনাবাহিনীকে আসলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে থাকে তারই ক্ষমতার বলয় সুরক্ষিত রাখার জন্য, সেই বলয়ে যাতে ঢুকে পড়তে না পারেন সাধারণ মানুষ, প্রশ্ন তুলতে না পারেন অবিচার অসাম্য দেখলে, সেটিই নিশ্চিতকরণের প্রক্রিয়া হলো সেনার ওপরে দেশভক্তের লার্জার দ্যান লাইফের 'সম্মান' আরোপ। এতে করে দুই পক্ষকেই ঠকানো যায় অতি চতুরভাবে।

সেনাবাহিনী সম্পর্কে সিভিলিয়ানদের সম্ভ্রম উদ্রেক করিয়ে তাঁদের যেমন ভয় পাইয়ে রাখা যায়, তেমনি সেনাবাহিনীকেও বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায় আমজনতা থেকে। দেশবাসীর দুঃখদুর্দশা কষ্টের ভাগীদার যদি  হতে চান সেনারা, প্রশ্ন তোলেন দেশবাসীর সুরে সুর মিলিয়েই, তাহলে ক্ষমতার বড় বিপদ। টলে যাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের আসন। তাই সেনা ও সিভিলিয়ানদের সুকৌশলে বিচ্ছিন্ন রাখাটা জরুরি। সেই কারণেই  দেশভক্তির আরোপন। একটু তলিয়ে দেখলে পাটিগণিতটা বুঝে উঠতে পারা খুব কিছু কঠিন কাজ নয়।

সেনা বা আধাসেনার সিংহভাগই আসেন সাধারণ ঘর থেকেই, অনেকেই আসেন গ্রামের দরিদ্রতম পরিবার থেকে। তাঁরা দারিদ্রের রূপ কী তা জেনেছেন। পেটের দায়ে, একমাত্র বিশুদ্ধ পেটের  জ্বালাতেই, তাঁরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও, কারণ জীবনের ঝুঁকি বনাম দারিদ্র, অসুস্থ বাবা বা অবিবাহিত বোনের টানাপোড়েনে, জিতে গেছে জীবনের ঝুঁকিই। না, দেশপ্রেমের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া থাকে না সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার, অন্ততঃ সাধারণ ঘর থেকে আসা মানুষগুলোর জন্য তো বটেই। তাঁরা জানেন অতি কম দামে রেশন, চিকিৎসা, এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা পাবেন ফৌজি হলে। কারণ রাষ্ট্র তা দেবে জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কাজে যোগ দেওয়ার লোক জোগাড় করতে।

Pulwama CRPF attack পুলওয়ামার দুর্ঘটনাস্থলে সুরক্ষা কর্মীরা। ছবি: শোয়েব মাসুদি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

মার্চেন্ট নেভিতে যেমন মাধ্যমিক পাশ রেডিও অফিসারের মাইনে একসময় আইআইটির বিটেক পাশ ইঞ্জিনিয়ারের থেকেও বেশি হতো, না হলে বছরে ছ'মাস জলে ভেসে থাকার ওই চাকরি নেবে কে? আজ যদি ব্যাঙ্কে বা সরকারের অন্য দপ্তরে সেনাবাহিনীকে দেওয়া বিশেষ সুযোগ সুবিধাগুলো চালু হয়, একদম স্থির নিশ্চিত বলা যায়, হু হু করে কমে যাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার হার। রাষ্ট্র তা জানে। তাই সে উৎকোচ দেয়, বিশেষ সুযোগ সুবিধার উৎকোচ, দেশপ্রেমের তকমার উৎকোচ। নাহলে ক্ষমতার সোপান ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা।

তাই দেশপ্রেমের জিগির তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের হাঁক দেওয়ার আগে ভাবুন, কারা মরলেন আসলে? না, কোনো দেশপ্রেমী ভারতমাতার সন্তান মরেন নি, মৃত্যু হয়েছে আমার আপনার ভাইয়ের, পাশের শহরে থাকা, পাশের গ্রামে থাকা, পাশের বাড়িতে থাকা ভাইয়ের। বিধবা হয়েছেন আমাদের বোনরা। পিতাকে হারিয়েছেন আমাদেরই সন্তানসম বালক বালিকারা। যাঁরা মারা গেছেন তাঁরা হতভাগ্য সাধারণ মানুষ, আমার আপনার মতো। তাঁদের অধিকাংশই ভাতের জন্য, শুধুমাত্র ভাতেরই জন্য সেনায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা আলাদা করে দেশভক্ত নন, হতে চান নি, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশভক্তির ভারী বোঝা তাঁদের ঘাড়ে, ধোপার পুঁটলির মতো, সেই পুঁটলিতে যা আছে, তার ভাগিদার রাষ্ট্রই মাত্র, মৃতেরা নন। কোনোদিন ছিলেন না। তাঁরাও সাধারণ দেশবাসীর মতোই বঞ্চিতই ছিলেন আসলে, ছিলেন শোষিত।

ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্র তাঁদের শোষণ করতে ছাড়ে নি। ভুলে গেলে চলবে না সেনা অফিসারদের তোলা অভিন্ন পেনশনবিধির দাবি, আর্মি ক্যান্টিনে অখাদ্য খেতে বাধ্য হওয়া বিএসএফ জওয়ানদের  অভিযোগ, ভুলে গেলে চলবে না গত পাঁচ বছরে অবসাদজনিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় এক হাজার জওয়ান, যে সংখ্যাটা এনকাউন্টারে মারা যাওয়া জওয়ানদের সংখ্যার প্রায় সমান সমান।

আরও পড়ুন: পুলওয়ামার জের: পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক ২০০ শতাংশ

ভুলে গেলে চলবে না, পাঁচ বছর আগে দান্তেওয়াড়ায় জঙ্গি হানায় মৃত সিআরপিএফ কোবরা জওয়ান চন্দ্রকান্ত ঘোষের স্ত্রী শ্রাবনী ঘোষ সরকারের দোরে দোরে ঘুরেও এখনো একটা চাকরি পেয়ে উঠতে পারেন নি। কেন? সেখানে জঙ্গি মাওবাদীরা বলে? সেখানে জঙ্গি হানায় খেলা যাবে না ধর্মীয় ভেদাভেদ, বিচ্ছিন্নতাবাদের, দেশপ্রেমের তাস, সেজন্যই কি রাষ্ট্রের এই অবহেলা?

দিনের শেষে তাই মৃত সেনারা হাতভাগ্যই মাত্র। বৃহৎশক্তির দাবা খেলার বোড়ে ছাড়া কিছু নন, দুর্ভাগ্যবশত। এটা বুঝেছিলেন গুরমেহর কৌর।  বুঝেছেন বাউড়িয়ার বাবলু সাঁতরার স্ত্রী। এঁরা যুদ্ধ চান না। চান না কোল খালি হোক আরো বহু মায়ের, এবং তার বিনিময়ে ফায়দা তুলুক রাষ্ট্র, সীমান্তের এপারে, এবং ওপারেও। গুরমেহরকে চরম হেনস্থা করা হয়েছিলো তখন। এক বিখ্যাত ক্রিকেটার পর্যন্ত নেমে পড়েছিলেন গুরমেহরকে ট্রোল করার খেলায়। কে জানে ভবিষ্যতে 'দেশভক্ত'-দের হাতে এই হেনস্থা শ্রীমতি মিতা সাঁতরার জন্যও তোলা আছে কিনা।

এবং সেনার দুঃখজনক মৃত্যু ভাঙিয়ে রাজনৈতিক  ফায়দা তোলার চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম হত্যাকারীদের দেশপ্রেমীর ছাপ দিয়েছে। এপারে জিগির তোলা হয়েছে যুদ্ধবিরোধীদের বেইমান বলে দেগে দেওয়ার। চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে বিশেষ এক ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দেওয়ার - হায়, মৃত সেনাদের তালিকায় দ্বিতীয় নামটিই সেই সম্প্রদায়ের মানুষের। তাও আমরা অন্ধ, বধির, মূক।

Pulwama attack crpf বাড়ি ফেরা। ছবি: শশী ঘোষ

প্রধান বিষয়টি, সুতরাং, বিদেশিদের হাতে দেশরক্ষকদের মৃত্যু যত না, তার থেকেও বেশি তার 'আফটারমাথ'। এই অসম্ভব দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুমিছিল, এই কাপুরুষের মতো জঙ্গি হানা, তার সমস্ত আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ছদ্ম (বা অজ্ঞান) দেশপ্রেমের হিড়িকে। আজ যেখানে রাষ্ট্রের দেখার প্রয়োজন কিভাবে ভবিষ্যতে থামানো যায় মৃত্যুমিছিল, তার বদলে রাষ্ট্র তার অনুচরদের লাগিয়ে দিয়েছে ঘৃণার পসরা ছড়াতে। যুদ্ধ হলে সাধারণ মানুষ সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক নেতাদের দুর্দশা ভোগ করতে হয়নি যুদ্ধের কারণে। ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে যুদ্ধের জিগির একটা তুলিয়ে দিতে পারলে, রাষ্ট্রেরই সবথেকে বড়ো লাভ (এবং অন্যদের ক্ষতি), সেটা সীমান্তের এপারেও যেমন, তেমনি ওপারেও।

এই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন অনেকেই। তাই এতদিন ধরে 'গৈরিক রাষ্ট্র'-কে গালপাড়া বহু 'প্রাগতিশীল'-কে হঠাৎ করে দেশভক্ত হয়ে যেতে দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরিস্থিতির রাজনৈতিক চাপ এমনই, যে কোনো কোনো বাম মনোভাবাপন্ন দলকেও তড়িঘড়ি মিছিল ডেকে ফেলতে হয়েছে দেশপ্রেমীদের ওপর হামলার নিন্দায়।

রাজনীতি বড় বালাই।

আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, আমাদেরই ঘর থেকে মৃত্যুমিছিলে যোগ দেয় ফৌজিরা রাষ্ট্রের প্ররোচনায়, আমাদেরই ঘর থেকে উঠে আসে আত্মঘাতী জঙ্গিরা, তাও সেই রাষ্ট্রের প্ররোচনাতেই, সীমান্তের এপারের অথবা ওপারের। আমরা কি এভাবেই তাবৎকাল রাষ্ট্রের ক্রীড়নক হয়েই থেকে যাবো? এখনো কি সময় আসেনি অন্ধত্ব থেকে বেরিয়ে আসার?

(লেখক বর্তমানে ইন্ডিয়ান স্ট্যটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট কলকাতার সঙ্গে যুক্ত মহাকাশবিজ্ঞানী। মতামত ব্যক্তিগত)

Maoist CRPF kashmir militants
Advertisment