হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ 'অপ্সরা' শব্দের অর্থ বলা হয়েছে - উর্বশী প্রভৃতি স্বর্গবেশ্যা। রামায়ণে আছে, সমুদ্রমন্থনে অপ্সরার উৎপত্তি। মহাভারতে অপ্সরার জন্ম কশ্যপপত্নী প্রধার গর্ভে। অভিধানচিন্তামণির টীকায়, ব্রহ্মা বিষ্ণু যম থেকে প্রভাবতী প্রভৃতি অপ্সরার উৎপত্তি। তৈত্তিরীয় মন্ত্রে আছে, অপ্সরারা মানুষকে উন্মত্ত করে। অমরকোষে বলা হয়েছে, 'স্ত্রীণাং বহুষ্বপ্সরসঃ স্বর্বেশ্যা উর্বশীমুখা' - স্ত্রীলোকের মধ্যে উর্বশী প্রমুখের ন্যায় অপ্সরারা হলেন স্বর্গবেশ্যা। দেবরাজ ইন্দ্রের অধীনস্থ তাঁরা।
বেশ্যা, পতিতা, গণিকা, বন্ধকী, বারাঙ্গনা, খানকি (গণিকার ৩০০ টি প্রতিশব্দ আছে) যে নামেই ডাকা হোক না কেন সেক্স ইন্ডাস্ট্রির এই কর্মীদের, তাতে কিছুই আসে যায় না। ক্লায়েন্ট বা খদ্দেরদেরও নানা নাম আছে। বেশ্যা বা 'প্রস্টিটিউট' নিজেকে বিক্রি করেন। তাঁর শ্রম ক্রয় করেন ক্লায়েন্ট। সেমিটিক পুরাণে আছে, এবেলকে কেইন হত্যা করার পর আদম ও ইভ শতাধিক বছরের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যান; এই সময় লিলিথ ও নামহ্ নামের দুজন পতিতা আদমের সন্তান ধারণ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে পবিত্র গণিকা থেকে সভাগণিকা নানা রকমের বারাঙ্গনার সন্ধান পাওয়া আয়। পুরাণে 'ইরা' নামের যে বারাঙ্গনার কথা পাওয়া যায়, তিনি দরিদ্রতা মোচনের জন্য গণিকাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। শ্রমদান করে অর্থ রোজগার করতেন ইরা। মহাভারতের শান্তিপর্বে সুপ্রসিদ্ধ গণিকা পিঙ্গলার সন্ধান পাওয়া যায়। বিন্দুমতী, শারদণ্ডায়নী প্রমুখ বারাঙ্গনাদের দেখা মেলে এই মহাকাব্যে।
আরও পড়ুন: বৈবাহিক ধর্ষণের অনুমতি দেয় কি ভারতীয় সংস্কৃতি?
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, গণিকাবৃত্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পেশা। গণিকালয় রাষ্ট্রের মালিকানায় যেমন থাকবে, তেমনি স্বাধীন বারাঙ্গনা রাষ্ট্রের সহায়তা না নিয়েও দেহব্যবসা করতে পারেন। কৌটিল্য বলছেন, রাষ্ট্র প্রধান-বারাঙ্গনাকে ১,০০০ পণ এবং তাঁর সাহায্যকারীকে ৫০০ পণ দিত ব্যবসা শুরু করার জন্য। অলঙ্কার, আসবাবপত্র, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি কিনে তাঁরা ব্যবসা আরম্ভ করতেন এবং অর্থভাণ্ডারের প্রধানকে শুল্ক দিতেন। স্বাধীন গণিকাদেরও রোজগারের এক ষষ্ঠাংশ কর হিসাবে কোষাগারে জমা দিতে হত। শহরের দক্ষিণে থাকে গণিকাপল্লী। রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকেও সঙ্গ দিতেন বহু গণিকা। শুধু দেহপ্রদান নয়; গণিকাদের নৃত্যগীত, কথোপকথন, আবৃত্তি, অভিনয়, কিছুটা মনোবিজ্ঞানের পাঠ, সুগন্ধী তৈরির তালিম, ছবি-আঁকা এবং মৈথুনশিল্পের তালিম দেওয়া হত। শীর্ষস্থানীয়া গণিকার পদমর্যাদা রাজার সচিবের সমকক্ষ এবং তাঁদের বেতন ছিল রাজার ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা, রাজবৈদ্য প্রমুখের সমান।
রাষ্ট্র শুধু গণিকাদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করত না, তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণও করত। গণিকাদের হেনস্থা করা হলে কঠিন শাস্তির বিধান ছিল। প্রত্যেক গণিকাকে খদ্দেরদের নাম নথিভুক্ত করতে হত এবং আয়ের খুঁটিনাটি জানাতে হত অর্থবিভাগের অন্তর্গত মুখ্য গণিকা-নিয়ন্ত্রককে। নারদস্মৃতি, পরাশর সংহিতা ও মনু সংহিতায় বারাঙ্গনাদের নিয়ে বেশ কিছু শ্লোক আছে। মনুস্মৃতির চতুর্থ অধ্যায়ে আছে, বারবণিতার আয়ের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন যাঁরা, তাঁদের কাছে থেকে প্রতিগ্রহ (উপহার) গ্রহণ করা যাবে না। অষ্টম অধ্যায়ে আত্মোপজীবিষু বা বেশ্যাজীবীর উপার্জনের কথাও রয়েছে। নারদস্মৃতির দ্বাদশ অধ্যায়ে অসচ্চরিত্র নারীর সঙ্গে সঙ্গমকে অনুমোদিত বলা হয়েছে।
ভারতে পতিতাবৃত্তি আইনত বৈধ। কিন্তু বারাঙ্গনাদের পেশার ক্ষেত্রে শ্রম-আইন কীভাবে প্রযুক্ত হবে, তা নিয়ে তেমন স্পষ্টতা নেই। তাছাড়া, পতিতাবৃত্তি বৈধ হলেও পতিতালয় আইনত অবৈধ। এমনকি যে সমস্ত পুরুষ বারাঙ্গনার খদ্দের বা ক্লায়েন্ট হবেন, তাঁদের আইনত অপরাধী হিসাবে শাস্তি দেওয়া হবে - এমন কথাও ভারতীয় আইনে স্বীকৃত। যৌনকর্মীদের কর্মস্থলকে অবৈধ ঘোষণা এবং খদ্দেরদের অপরাধী হিসাবে দেখলে পতিতাবৃত্তিকে কীভাবে আইনত বৈধ বলা যায়, তা ভাবনার বিষয়। যৌনকর্মীদের পেশা আইনত সিদ্ধ হলেও এই সমস্ত বিষয়ের জন্য তাঁদের পুলিশি হয়রানি, তোলাবাজি, স্বাস্থ্যহীনতা প্রভৃতির মুখোমুখি প্রতিনিয়ত পড়তে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা, সেটা হল পতিতালয় অর্থাৎ যৌনকর্মীদের কর্মক্ষেত্র যেহেতু অবৈধ, এই পেশাকে বৈধ বলেও কোনও লাভ হয়নি।
আরও পড়ুন: ‘দিল্লি আন্টি’ কোন ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত?
লাভ যাদের হয়েছে তারা হলো তোলাবাজ, বাড়িওয়ালা, পুলিশ প্রভৃতি। যৌনকর্মীদের উপার্জনের বেশির ভাগ এরাই খেয়ে নেয় বলে আকছার শোনা যায়। বহু সময় পুলিশ পতিতালয়ে অভিযান চালিয়ে গণিকাদের নির্যাতন করে। পুলিশ বা রাষ্ট্রের কাছে সুরক্ষা পাওয়ার বদলে এমন নানাবিধ নির্যাতন পতিতাদের পেশাকে অমানবিক করে তুলেছে, তাঁদের মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। পতিতাবৃত্তি ভারতে বৈধ, এমন আইনের প্রায়োগিক ক্ষেত্র তবে কী হবে?
ভারতের প্রাচীন গ্রন্থসমূহে যৌনকর্মীদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে নানা রকমের ইতিবাচক কথা থাকলেও ভারতীয় আইনে তাঁদের সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত ও অস্পষ্ট। যে আইনটি গণিকাদের পেশার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বলে মনে করা হয়, তা হল ইমমরাল ট্রাফিক (সাপ্রেশন) অ্যাক্ট ১৯৫৬। এই আইন অনুসারে, গণিকারা স্বাধীনভাবে তাঁদের পেশা নির্বাহ করতে পারেন কিন্তু তা করতে হবে গোপনে। ক্লায়েন্ট বা খদ্দেরদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা দরাদরির ব্যাপারে আইনটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ভারতে পতিতাবৃত্তি আইন নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের অনেকেরই অভিমত হল, আসলে ভারত নামক দেশে পতিতাবৃত্তি বেআইনি। কেন? এই দেশের গণিকা-আইন অর্থের বিনিময়ে শরীর বিক্রিকে সমর্থন করে না।
এখানে একটি প্রশ্ন ওঠে। অন্যান্য শ্রমজীবীরা কি দৈহিক শ্রমের দ্বারাই রোজগার করেন না? সেখানে যিনি শ্রম কিনছেন এবং শ্রম দিচ্ছেন, দু পক্ষই প্রকাশ্যে কথাবার্তা বলে সব কিছু ঠিকঠাক করছেন। কিন্তু এখানে তেমন হলে গণিকা ও ক্লায়েন্ট, দু পক্ষই শাস্তির মুখে পড়তে পারেন। গণিকাবৃত্তি আইনসিদ্ধ কিন্তু সেই বৃত্তির উপভোক্তা আইনের চোখে অপরাধী। ভোক্তা, মধ্যস্থতাকারী, পতিতালয়, যৌনবৃত্ত - গণিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি জিনিস বেআইনি। অথচ আইন বলে, কোনও মহিলা যদি স্বেচ্ছায়, এককভাবে তাঁর শরীরকে অর্থনৈতিক লাভের জন্য কাজে লাগান তাহলে তা বৈধ বলে পরিগণিত হবে। পক্ষান্তরে, আইনটি লিঙ্গনিরপেক্ষও নয় কারণ পুরুষ যৌনকর্মীদের কোনও স্বীকৃতি ভারতীয় আইনে নেই। এই আইন শুধু পতিতাদের জন্য। পুরুষ আবার পতিত হয় নাকি!
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পতিতালয়ের যেমন বর্ণনাই থাকুক না কেন, ইমমরাল ট্রাফিক (সাপ্রেশন) অ্যাক্ট ১৯৫৬ অনুযায়ী, পতিতারা পাবলিক প্লেসের ২০০ গজের মধ্যে তাঁদের পেশার কাজ করতে পারবেন না। অদ্ভুত কথা! পতিতালয়কে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, আবার পতিতারা পাবলিক প্লেসের ২০০ গজের ভিতর খদ্দেরদের সঙ্গে কাটাতে পারবেন না, এই কথা কি স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে না? পতিতা যেখানেই পেশা নির্বাহ করবেন, সেটাই পতিতালয়; ২০০ গজের বাইরে হলে কি পতিতালয় আইনি হবে? তাহলে 'ব্রথেল' বা 'হোরহাউস'-কে ভারতীয় আইনে অবৈধ বলা হয়েছে কেন? সাধারণ শ্রম আইন অনুযায়ী, যৌনকর্মীরা সুরক্ষিত নন। মজুরি এবং কাজের উপযুক্ত পরিবেশ, কোনোটাই নেই গণিকাদের। তাঁদের পুনর্বাসনের অধিকার আছে। পেশা দুর্বিষহ মনে হলে তাঁদের পরিত্রাতা হিসাবে কাউকে পাওয়া যায় না। সাধারণ নাগরিকদের মতোই সমস্ত অধিকারই তাঁদের প্রাপ্য।
আরও পড়ুন: সাধ্বীর বেলায় আঁটিশুটি!
ইমমরাল ট্রাফিক (সাপ্রেশন) অ্যাক্ট ১৯৫৬ আইনটি সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় দ্য ইমমরাল ট্রাফিক (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট ১৯৮৬, যেখানে বলা হচ্ছে, কোনও গণিকা যদি ক্লায়েন্টদের সলিসিট বা অনুরোধ করেন কিংবা সিডিউস বা প্রলুব্ধ করেন তাহলে তিনি শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন। এখন প্রশ্ন হল, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে গণিকারা কীভাবে যোগাযোগ করবেন, বা, খদ্দেররা কীভাবে বারাঙ্গনাদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করবেন? কল গার্ল/বারাঙ্গনারা প্রকাশ্যে তাঁদের ফোন নম্বর দিতে পারবেন না, এর অন্যথা হলে ছ'মাস অবধি কারাদণ্ড হতে পারে। খদ্দের যদি নির্ধারিত সীমার মধ্যে (পাবলিক প্লেস থেকে ২০০ গজ বা তার কম) গণিকার পরিষেবা নেন, তবে খদ্দেরের তিন মাস পর্যন্ত জেল হতে পারে। এখানে পাবলিক প্লেস বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? পতিতালয় তো নিষিদ্ধ ও অবৈধ। দালাল, বাবু (মালিক)-দের নিয়েও আছে আইন। পতিতালয় যেহেতু নিষিদ্ধ, তাই পতিতালয়ের মালিক বা তত্ত্বাবধায়ক ধরা পড়লে তার তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
যৌনকর্মীদের শ্রমিকের অধিকার দেওয়া যায় কিনা, এই বিষয়ে অর্থশাস্ত্রে স্পষ্ট বিধান থাকলেও ভারতীয় আইনে নেই। মনে রাখতে হবে, আদিম এই পেশা ভাল নাকি মন্দ, সেই নৈতিক বিচার এখানে করা হচ্ছে না। যেহেতু ভারতীয় আইনে পতিতাবৃত্তি বেআইনি নয়, তাই গণিকাদের সুরক্ষা ও অধিকারের প্রশ্নটি গুরুতর। পতিতাবৃত্তির বিষয়টি শ্রম অধিকারের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণিকাকে চার পাশ থেকে ঘিরে থাকে দালাল, পুলিশ, গুণ্ডা প্রভৃতি বাহিনী, এবং তাঁকে শোষণ করে। যে কোনও মানুষের আত্মসম্মান আছে, তিনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন। অপরাধীদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার অধিকারও আছে তাঁর। এমনকি একজন হত্যাকারীরও মানবাধিকার রয়েছে। গণিকার চার পাশে যারা তাঁকে শাসন ও শোষণ করে, তারাই মূল অপরাধী। সেই অপরাধের বৃত্ত থেকে গণিকাকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।