দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। আজ লোকসভার নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হবে। রুদ্ধশ্বাস একটা নাটকের যবনিকা পতন। আমরা সবাই অপেক্ষা করে আছি, কী হবে? নরেন্দ্র মোদী আবার প্রধানমন্ত্রী থাকবেন কি থাকবেন না! একটা আলোচনা শুরু হবার আগে আরেকটা আলোচনা সেরে ফেলা যাক বাঙালি পাঠকদের সঙ্গে।
এবারের যে ভোটটা হয়ে গেল এবং তিনমাস ধরে যে প্রচারটা হলো, ভারতের এত নির্বাচন আমি দেখেছি, কিন্তু এইরকম নির্বাচন দেখি নি। তার কারণটা হচ্ছে, যে ভাষায় রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীরা কথা বলছেন, বিরোধী এমনকি শাসকদলেরও, নেতা মন্ত্রীদের মধ্যে এত কু-আলোচনা হয়েছে যেগুলো হয়ত ভারতবর্ষের মানুষের প্রয়োজনীয়তা থেকে অনেক দূরে। আমজনতা যে রুটি-কাপড়া-মকান চায়, যে সাধারণ চাকরি চায়, একটা নতুন ভারতবর্ষ চায়, সেই মানুষ একজন আরেকজনকে গালিগালাজ করছে যে ভাষায়, সে ভাষা রাজনীতির ক্ষেত্রে একেবারেই অনভিপ্রেত। এবং এটা হওয়া কাম্য নয়।
আমি সেদিন রামচন্দ্র গুহর লেখায় পড়ছিলাম, নেহরু ১৯৫৭ সালের প্রথম নির্বাচনে কোনো এক জায়গায় ভোটের প্রচারের শেষে দর্শকদের বলেছিলেন, "আপনারা উঠে যাবেন না। এরপর এখানে জয়প্রকাশ নারায়ণ আসবেন, এবং তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন। তাঁর এবং আমার বক্তব্যের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু আমি চাইব আপনারা তাঁর বক্তব্য শুনুন। এবং দুজনের বক্তব্য শুনে তারপর আপনারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিন।" এই যে মানসিকতা, মনোভঙ্গী, তা শুধু নেহরু নয়, সে সময় অনেকেরই ছিল।
পি. সুন্দরাইয়া, যিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্যসভার সংসদীয় দলনেতা হয়েছিলেন, একবার মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রী লেডি মাউন্টব্যাটেন স্বাধীনতার পর ভারতে আসছেন জানার পর উপরাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণনের সামনে সংসদের ভিতরে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে তিনি নেহরুকে দেখতে আসছেন। যেহেতু সেই সময় লেডি মাউন্টব্যাটেনকে নিয়ে একটা গুজব সংবাদ মাধ্যমে ছিল, সেই কারণে নেহরু খুব রেগে যান এবং পি. সুন্দরাইয়াকে এমন কিছু কথা বলেন যার জন্য সুন্দরাইয়া রাজ্যসভা ছেড়ে চলে যান এবং একটা কটু পরিস্থিতি তৈরী হয়। কিন্তু তারপরই দুপুরবেলায় যখন খেতে আসেন, তখন উপরাষ্ট্রপতি ফোন করে তাকে বলেন, "নেহরুর বাড়িতে নেহরু সাংসদদের চা-চক্রে ডেকেছেন, আপনি যান। গিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে নিন।"
আমি সুন্দরাইয়া ও তাঁর স্ত্রী, যিনিও একজন কমিউনিস্ট নেত্রী ছিলেন, তাঁদের দুজনের আত্মজীবনী পড়ে জেনেছি, সুন্দরাইয়া তাঁর স্ত্রীকে ঘটনাটি বলে মত চান, তিনি যাবেন কিনা। সুন্দরাইয়ার স্ত্রী বলেন অবশ্যই তাঁর যাওয়া দরকার। তিনি গেলেন। নেহরু বাড়ির লনে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন।সুন্দরাইয়া ক্ষমা চেয়ে বললেন, ব্যক্তিগত ব্যাপারে তাঁর বলা উচিত হয় নি। নেহরু উলটে তাকে বলেন যে তাঁরই ওভাবে সুন্দরাইয়াকে বলা উচিত হয় নি। এটি একটি নন ইস্যু। এটাতে আমার রেগে যাওয়া উচিত হয় নি।
এমনই ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতি। যেটা এখন মিসিং। ভোটের প্রচারের সময় আমি কারো পক্ষে কিংবা বিপক্ষে প্রচার করতেই পারি। মেনে নিচ্ছি, মে মাসের কলকাতার প্রচন্ড গরমে খুব ঘাম, উত্তরভারতে ভয়ংকর দাবদাহ, এতে রেগে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার মানে প্রতিপক্ষকে নোংরা, অশ্রাব্য, অশালীন কথা বলা? জয়াপ্রদা একজন মহিলা সাংসদ। তাঁর সম্বন্ধে আজম খান এমন কথা বললেন যা আমার পক্ষে এখন পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব নয়। এই যে মানসিকতা, তা কিসের? মধ্যপ্রদেশের ভোপালে ভোটের শেষলগ্নে বিজেপি প্রার্থী গডসে সম্পর্কে যে কথা বললেন, সেটাও কি ঠিক কাজ করলেন? এখন তিনি বলছেন প্রায়শ্চিত্ত করবেন। নীরবতা বজায় রাখবেন। এমনকি ওঁর এই মন্তব্য মোদী, অমিত শাহকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। এই যে বাক অসংযম, যা এবারের ভোটের অন্যতম দিক, তা নিন্দনীয়।
তার পাশাপাশি আরেকটি দিক, প্রচুর টাকা পয়সার খরচ। এবারের ভোটে জলের মত পয়সা খরচ হতে দেখলাম। তবে এবারের নির্বাচনে ফ্ল্যাগ, পোস্টার ব্যানারের ছড়াছড়িতে যে কদর্য চেহারা হত, কলকাতাকে তো আমরা গ্রাফিতি শহরই বলতাম, দেওয়াল লিখন, সবই কমে গেছে। জনসভা এখনও হচ্ছে। সেটা ভাল। এই গরমে এটা লক্ষ্য করে দেখলাম, যতই টিভি, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া হোক, মানুষ সরাসরি প্রত্যক্ষ সংযোগ করতে চাইছেন। কিন্তু ভোটের খরচ কমে গেছে বলতে পারব না। কে বেশি টাকা আর কে কম টাকা খরচ করছে তার কোনো তুলনামূলক সংখ্যতত্ত্বে আমি যাচ্ছি না, কিন্তু এইটুকু বলতে পারি নির্বাচন পোস্টার, ব্যানার ইত্যদিতে যেমন খরচা কমিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিজের পক্ষে আনবার জন্য সেগুলো সবসময় সৎ তাও নয়, সেসব উপায়ের পেছনে যে খরচা হয়েছে, তাও কম নয়।
আমাদের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন, যিনি বাঙালি গণিতজ্ঞ ছিলেন, তাঁকে নেহরু লন্ডন থেকে ডেকে আনেন। সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত - আগে শুধু ব্যালট পেপারে ভোট হতো, এখন বিতর্ক চলছে ইভিএম-এ কারচুপি হয় কিনা! আর একটা কথাও বলব, পশ্চিমবঙ্গে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দেখেছি, তা ভারতবর্ষের আর কোথাও দেখি নি।
কিন্তু বিরোধী পক্ষের অনেক দুর্বলতার/ভুলের কারণেই মোদী অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেছেন। এবারের ভোটে দেখলাম, মোদী থাকবেন কি থাকবেন না, মোদী হটাও এর প্রচারটা যেমন হয়েছে, তেমনি মোদী বাঁচাও, এই অভিযানটাও সংগঠিত হয়েছে। ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচীর কথা বিরোধী কোন নেতার মুখে যদি শোনা যেত, কিংবা কোনো অ্যাজেন্ডা পেপার তৈরি করত। এগুলো না করে শুধু মোদী বিরোধিতা। অথচ দেখুন, রাহুল গান্ধী কেরালায় বামেদের বিরুদ্ধে প্রার্থী হলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে জোট হলো না, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী অখিলেশ মহাগঠবন্ধন কংগ্রেসকে নিল না। কংগ্রেস সব আসনে প্রার্থী দিল। অন্যদিকে কেজরিওয়ালের সাথেও রাহুল কোনো রকম সমঝোতা করলেন না। ফলে মোদী হটাও অভিযান ঠিকমত হলো না।
অন্যদিকে, বিরোধীরা যে মোদী খেদাও-এর রাজনীতি করলেন, তার ফলে মোদী একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ালেন। তার ফলে রাফালের মত বিষয়, কৃষকদের আন্দোলন, রাহুল গান্ধীর ন্যায়ের স্লোগান, কোনো কাজ করল না। তিন বছর পরে সে সময়ে মোদীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দিল। মোদীর বিরুদ্ধে এই অসন্তোষের কথা আমি কিন্তু দীর্ঘ এক বছর আনন্দবাজারে লিখেছি।
তারপর মোদী যখন আসরে নামলেন, he is a great communicator, ফলে এমনভাবে মোদী কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি করলেন রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা, উন্নত রাষ্ট্র, সব মিলিয়ে মোদী এক এমন ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ালেন যেন মনে হল আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের বহুদলীয় নির্বাচন কম হল। মোদীও তাঁর কথা বললেন, কিন্তু প্রতিপক্ষ একে মোদী-কেন্দ্রিক নির্বাচনে পরিণত করল। এগুলো মনে হচ্ছে এবারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য। এর ফল কি হবে জানি না। এবারের সব এক্সিট পোল বলছে, মোদীর নেতৃত্বেই সরকার গঠন হবে। আমি জ্যোতিষীও নই, সেফোলজিস্ট ও নই। আমি কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করব না। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষণে আমার মনে হয় নরেন্দ্র মোদীর যে প্রচারপর্ব, সেটা খুব শক্তিশালী।
কিন্তু সবাই যে কাদা ছোড়াছুড়ি করেছে, এই সংস্কৃতির অবসান হওয়া দরকার। একটা পলিটিক্যাল ডিসকোর্স, তার রাজনৈতিক মান বাড়া উচিত। আমি মানছি, ভারতে দু ধরনের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে। একটা ছিল নেহরুপন্থী লেফট লিবারেল ন্যারেটিভ, তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন। যেখানে ছিল বহুত্ববাদের কথা। কিন্তু তার প্রতিপক্ষ হিসেবে একটা হিন্দু জাতীয়তাবাদ, যেটা কংগ্রেসের সময় থেকেই ছিল। বালগঙ্গাধর তিলক থেকে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ, কিংবা গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, এঁরা ছিলেন। পাশাপাশি ছিলেন ই.এম.এস নাম্বুদিরিপাদ বা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী।
তারপর কংগ্রেস ভেঙে যাওয়ার পর বিজেপির বৃদ্ধি যখন হলো, যখন বিজেপি ২৮২টি আসন পেল, তখন নরেন্দ্র মোদী সুকৌশলে সেই কাউন্টার ন্যারেটিভকে ব্যবহার করলেন। সেই দর্শনের পটভভূমি ভোটের সময়, প্রচারের সময়, ৩৭০ ধারা থেকে শুরু করে রামমন্দির ইস্যু, সব জায়গায় কার্যকরী করেছেন। সুতরাং এটা খুব চিত্তাকর্ষক নির্বাচন। ভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন, ভোটের বৈশিষ্ট্যগুলো, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ, যেগুলোর হয়তো বিশ্লেষণ আগামী দিনে হবে।