সেদিন লোকসভায় অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ হলো, অস্থায়ী অর্থমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল পেশ করলেন। বললেন, তাঁরা কৃষকদের জন্য খুব ভাবছেন। তাই তাঁরা ৭৫,০০০ কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করছেন।সেই প্রকল্পের নাম 'প্রধানমন্ত্রী কৃষি সম্মান নিধি যোজনা'।
এই ঘোষণাতে কী বলা আছে? বলা আছে যে ছোট এবং মধ্য কৃষক, যাঁদের দুই হেক্টরের বেশী জমি নেই, তাঁদের বছরে ৬,০০০ টাকা, অর্থাৎ মাসে ৫০০ টাকা, বা দিনে ১৬ টাকা, বা মাথা পিছু ৩.৩০ টাকা দেবে সরকার। এই বিতর্কে আর না যাওয়াই ভালো, যে এই টাকাতে এক কাপ চা-ও হয় কী না। বরং অন্য একটা প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
এই সুবিধে পেতে পারেন, এমন কৃষকদের একটা তালিকা তৈরী করতে বলা হয়েছে সমস্ত রাজ্য সরকারকে। বলা হয়েছে যে ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে মার্চ ২০১৯ সালের মধ্যে এই কৃষকদের আপাতত ২,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। সেই কৃষকদের ভোটার কার্ড, নরেগা (NREGA) জব কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স বা অন্য কোনো পরিচয়পত্র দেখালে টাকা মিলবে। এরপর আসছে আসল বিষয়। দ্বিতীয়বার টাকা পেতে হলে কিন্তু আধার কার্ড লাগবে। আধার ছাড়া আর পাওয়া যাবে না এই সুবিধা।
আরও পড়ুন: কেন এই তিনটি পরীক্ষায় ব্যর্থ ইভিএম?
অনেকে ভাবতেই পারেন, এতে অসুবিধা কোথায়? আসল প্রশ্নটা কিন্তু এখানেই। যে মানুষটা একবার টাকা পেলেন, তিনি কিন্তু আধার না দেখালে আর পাবেন না। তাহলে পাবেন কারা? পাবেন না অনেকেই, যাঁদের হাতের ছাপ বা অন্য কিছু মিলবে না, কিন্তু টাকাটা পাচার হয়ে যাবে অন্য কোনো আধার সংযোগ করা অ্যাকাউন্টে, আর তারপর বলা হবে, আধারের ফলে "এত এত" টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
আধারের জন্য আর কী কী চাওয়া হয়েছে? নাম, লিঙ্গ, এসসি/এসটি কিনা, কতটা জমি আছে, এই সব তথ্য চাওয়া হয়েছে। তার মানে সরকারের কাছে সমস্ত তথ্য এসে গেল। মুকেশ আম্বানি কয়েকদিন আগে 'গুজরাট সামিট'-এ বলেছেন, ভারতীয়দের তথ্য যেন ভারতীয়দের কাছেই থাকে। আর কে না জানে, তথ্য বা 'ডেটা' এখন তেলের চেয়েও দামী।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, যে এই প্রকল্প নিয়ে দুর্গাপুরে তাঁর সাম্প্রতিক ভাষণে অনেক কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কিন্তু সযত্নে এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। আরো উল্লেখ করা উচিত যে সেদিন তিনি 'আয়ুষ্মান ভারত' প্রকল্প কেন পশ্চিমবঙ্গ গ্রহণ করে নি, তা নিয়েও মমতাকে বিঁধতে ছাড়েননি। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে এসেছেন। রাজ্যের 'স্বাস্থ্য সাথী' প্রকল্পেও হয়তো আধার লাগে, কিন্তু 'আয়ুষ্মান ভারত' প্রকল্পে আধার বাধ্যতামূলক।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং আধার
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেবেন, কালো টাকা ফেরত আনবেন, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু।
এবারও তাঁর সরকার বলেছে, কৃষকদের জন্য বছরে ৬,০০০ টাকা দেবে। শ্রমিকদের জন্য ৬০ বছরের পর পেনশন চালু করবে। একইরকম ভাবে বিরোধী দল কংগ্রেস বলেছে যে তারা গরীবদের জন্য 'মিনিমাম ইনকাম গ্যারান্টি' করছে। হয়তো শুনতে খুব সুন্দর, লোভনীয়, কিন্তু যদি একটু খেয়াল করা যায়, তাহলে দেখা যাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, সবেতেই বরাদ্দ কমছে। নরেগা প্রকল্পতেও টাকা কমছে। এই রকম অবস্থায় গরীবদের/কৃষকদের সরাসরি টাকা পাঠানোটা আরও বড় ভাঁওতা, এবং লোক ঠকানো ছাড়া কিছু নয়।
যেহেতু আধার-যুক্ত বন্দোবস্ত, তাই এর মধ্যে দিয়ে প্রাপকদের বাদ দেওয়াটা সুবিধাজনক হবে। আরও একটা বিষয়, যেহেতু এই সরাসরি ব্যাঙ্কে টাকা পাঠানোর প্রকল্পটা বর্তমানে চালু সুবিধাগুলোর বদলে প্রযোজ্য হবে, সেহেতু গরীব মানুষেরা এই সুবিধা পেতে বেশ কিছু বেসরকারী যন্ত্র এবং ঠগবাজ লোকের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবেন। কিন্তু ঘোষণা করে দিলে ভোট তো আসে।
আরও পড়ুন: ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, মোবাইলের সঙ্গে কি আধার সংযুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক হতে চলেছে আবার?
কতগুলো উদাহরণ দেওয়া যাক:
১। আশা দেবী গনজুর আধার কার্ডে নাম এসেছে। ২০১৬ সাল থেকে পেনশন পাচ্ছেন না, ব্যাঙ্কের দরজায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত।
২। গাংগী টুটির আধার কার্ড নেই, কারণ তাঁর গ্রামের সবাই যখন আধার কার্ড বানাচ্ছিলেন, তখন তিনি অসুস্থ, ফলে তাঁর রেশন কার্ডের সাথে আধার যুক্ত করা যায় নি, ২০১৭ সাল থেকে রেশন বন্ধ।
৩। হরিয়ানার ইন্দিরা চক্রবর্তী গ্রাম, সেখানে কুষ্ঠ রোগীরা থাকেন। তাঁদের আঙ্গুল নেই বলে আধার সংযুক্তিকরণ হয় নি, ফলে রেশন, পেনশন, সবকিছু বন্ধ।
৪। মামণি - পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট নিবাসী। সম্পূর্ণ বিকলাঙ্গ এই মহিলা বেঁচে আছেন ৬০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতার উপর, কিন্তু তাঁর চোখের আইরিস (মণির আশপাশের অংশ) মিলছে না বলে ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাঙ্ক।
সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার জন্যই সবকিছুর সঙ্গে আধার যুক্ত করা হয়েছে। এরপরে এই কৃষকদের টাকা দেওয়ার বিষয়টিও একই রকমের একটা ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাহুল গান্ধী কিন্তু এই বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেন নি। কারণ তাঁর প্রতিশ্রুত মিনিমাম ইনকাম গ্যারান্টির সঙ্গেও আধার যুক্ত হবে। গরীবরা যদি সুযোগ পেতেন, তাহলে হয়তো বলতেন, "ভিখ চাই না মা, কুকুর সামলান।"
আধার এমন একটা দুর্নীতি, যা নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন কেউ করলে হয়তো লাভবানই হতেন। যেভাবে ইংল্যান্ডে সমতুল একটি প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছিল, সেভাবে ভারতেও আধার ধ্বংস হতো।
(লেখক সমাজকর্মী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত বাস্তুকার। মতামত ব্যক্তিগত)