সকাল ন'টা। ভরপুর অফিস টাইম। অকুস্থল বারুইপুর স্টেশন। মহিলা কামরায় উঠে জানালার ধারে সিট পেয়ে অতি তৎপরতায় বসে পড়েছি। একটু সন্দেহ যে হয়নি তা নয়, এই সময় এত ফাঁকা! ভাবতে ভাবতেই একটি চেনা মুখ, সে আমায় কিছু বলতে যাবে, তখনই ওদের দলটি ওঠে। উঠেই, "এই ওঠ ওঠ! এখানে আমরা বসি, জানিস না? নতুন নাকি?" বলেই দুহাতের তালুতে গায়ের সমস্ত জোর একত্রিত করে তালি। পিত্তি জ্বলে যায়। একে তো অন্যায়ভাবে আমাকে উঠিয়ে দেওয়া। তার ওপর আবার তুইতোকারি! কিছু বলতে যাব, তার আগেই সেই চেনা মুখের মেয়েটি আমার ব্যাগ একপ্রকার কেড়ে নিজের কাছে নিয়ে, আমার হাত ধরে টেনে চললো পাশের কামরায়। তারপর প্রবল উত্তেজিত ও চাপা স্বরে বলল, "তোমার কি মাথা খারাপ, ওদের সঙ্গে লাগতে গেছ? আর একটু হলেই মারধর শুরু করে দিত।" বলে কী? এমনও আবার হয় নাকি?
প্রাথমিক উত্তেজনাটা কাটার পর স্থির হয়ে বসি এবং সহযাত্রীদের দ্বারা জ্ঞানপ্রাপ্ত হই। বৃহন্নলাদের এই দলটি রোজই উঠে ওই নির্দিষ্ট জায়গায় বসে। ওরা ভিড় পছন্দ করে না। তাই ওদের বসার পর জায়গা থাকলেও সেখানে আর কারও বসার অনুমতি নেই। এমনকি দাঁড়াবার অনুমতিও নেই। এক-দুজন ওদের খুব প্রিয় যাত্রী ছাড়া। তারা কী করে প্রিয় হল, সেই রহস্য নিয়েও গলা নামিয়ে আলোচনা করছিল ওরা। আমার আর শোনার আগ্রহ হলো না। রাগে আগুন মাথাটাকে শান্ত করবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, পুরো রাস্তা ধরে। হল না, বলাই বাহুল্য। কিন্তু কঠিন বাস্তবটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। এদের এড়িয়েই আমাকে নিত্যযাত্রাটা করতে হবে। প্রতিবাদ করে লাভ নেই। পাশে কাউকে পাব না।
আরও পড়ুন: জুন: মানবাধিকারের পক্ষে ভয়াবহ এক মাস
বৃহন্নলা। মহাকাব্যে উপেক্ষিত তো নয়ই। উল্টে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন নারীর ছদ্মবেশে বৃহন্নলা নামে বিরাট রাজার কন্যা উত্তরার নৃত্যগীতের শিক্ষক রূপে নিযুক্ত হলেন। সেই থেকেই না পুরুষ না নারী, অথবা একই দেহে নারী ও পুরুষ, ক্লীবলিঙ্গের মানুষকে বৃহন্নলা বলা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, সেকালে তাদের পেশাও ছিল ওই নৃত্যগীত সম্পৃক্ত। চলতি কথায় 'হিজড়া'। এই হিজড়া নামকরণ বা পেশার পরিবর্তন, সেটাও সামাজিক বিবর্তনের প্রেক্ষিতে ঘটে, বলাই বাহুল্য।
প্রচলিত ভাবে যাদের আমরা হিজড়া বলি, তারা একদা এক চিরন্তন প্রথাকে উপলক্ষ্য করে সমাজে কিছু গুরুত্ব পেলেও, পরে নানা কারণে পরিস্থিতি বদলায়। কতটা বদলায়, সাম্প্রতিক এক খবরেই মালুম হয় সেটা। গত চার বছরে সারা দেশে ৭৩ হাজার বৃহন্নলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তোলাবাজির অভিযোগে। তার মধ্যে শুধু ২০১৮ সালেই ২০ হাজার জন। জাতীয় স্তরে রীতিমত সাড়া ফেলে দেওয়া এ খবর জানা গেছে রেল মন্ত্রক সূত্রে। এই বৃহন্নলাদের বিরুদ্ধে জমা পড়া সীমাহীন অভিযোগের ভিত্তিতে এই পদক্ষেপ। এরা জোর করে টাকা আদায় করা শুধু নয়, টাকা না দিলে অশ্রাব্য গালিগালাজ থেকে শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত করে। অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি। লোকাল ট্রেন থেকে দূর পাল্লা, ভুক্তভোগী মাত্রই এটা জানেন।
যাওয়া যাক অতি শৈশবে। সেই প্রথম ওদের দেখা। জনা তিনেকের একটা দল অদ্ভুত ভঙ্গিতে তালি বাজিয়ে, গলায় ঢোল ঝুলিয়ে এল একদিন বাড়িতে। উপলক্ষ্য আমার ভাইয়ের জন্ম। এটা নাকি প্রথা। তারপর পাড়ায় প্রচুর বাড়িতে এই প্রথার পুনরাবৃত্তি দেখলাম। দেখলাম হিজড়াদের। কিছু জানলাম ওদের সম্পর্কে। রহস্যে ঢাকা থাকল অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে পাড়ার এক প্রবীণ মহিলার কথা মনে পড়ছে। বাল্য পার করে কৈশোরে পৌঁছেছি। তখনও লুকোচুরি খেলি। তেমনই এক খেলার মুহূর্তে ওই মহিলাকে দেখিয়ে এক বন্ধু ফিসফিস করে বলেছিল, "জানিস, ইতুপিসি (নামটা কাল্পনিক) না হিজড়া।" এসব কথা নাকি ফিসফিসিয়েই বলতে হয়। যাই হোক, ততদিনে আমি এটা জেনে গেছি, একটা বয়সের পর ওরা আর পরিবারের সঙ্গে থাকে না। ওরা 'ওদের মতো' বাকিদের সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে জীবন কাটায়। তাহলে ইতুপিসি কী করে থেকে গেল? জানতে পারি নি। আদৌ আমার বন্ধুটি ওঁর সম্পর্কে যে তথ্য দেয়, সেটার সত্যতা সম্পর্কেও নিশ্চিত নই। তারই বা কী বয়স তখন! কোথায় কী শুনেছে?!
আরও পড়ুন: ধর্না বিবাহ না কী রাক্ষস বিবাহ!
শৈশব-কৈশোরে এভাবেই আমাদের জ্ঞানের ভান্ডারে এই জাতীয় তথ্য জমা হয়। সেই সময় সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ছিল না। টিভি ছিল না। সংবাদ মাধ্যম বলতে খবরের কাগজ। সেটাও হাতে পাওয়ার ক্ষেত্রে বয়সের সুস্পষ্ট সীমারেখা ছিল। অর্থাৎ হিজড়াদের সম্পর্কে জ্ঞানের ভান্ডারটি ছিল এক কথায় অসম্পূর্ণ। শুধু এটুকুই, ওরা আমাদের থেকে আলাদা। কোনও বাড়িতে বাচ্চা হলে, নেচে-গেয়ে আশীর্বাদ করে টাকা, শাড়ি আরও কী কী নিয়ে বিদায় হয় ওরা। এটাই সামাজিক প্রথা। এটাই ওদের পেশা।
পরিণত বয়সে পৌঁছে হঠাৎ দেখলাম, পেশার কিছু রকমফের ঘটেছে। ওরা আজকাল ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে, দূর পাল্লার ট্রেনে উঠে চাঁদা তোলে। নানারকম অপরাধমূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত হয় ওদের নাম। হিজড়াদের জীবিকা ও জীবনযাপনের এই পরিবর্তন নিশ্চিতভাবে আমাদের সামাজিক বিবর্তনের অনুষঙ্গে ঘটেছে। পাড়াকেন্দ্রিক সমাজ ও সংস্কৃতি বদলেছে ফ্ল্যাট কালচারে। সেখানে হিজড়ারা তত সমাদর পায় না।
শোনা যায়, একটা সময় ছিল, যখন ওরা হাসপাতাল থেকে খবর পেত, কোন পাড়ার কোন বাড়িতে বাচ্চার জন্ম হয়েছে। জানার পর খুঁজে খুঁজে সেই বাড়িতে চলে যেত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। শহর ও শহরতলির ঝাঁ চকচকে জীবনে ব্রাত্য ওরা। এক্ষেত্রে ওদের সম্পর্কে আরও একটি অভিযোগও উঠে আসে, ইদানীং টাকার চাহিদা বেড়েছে ওদের। সেই চাহিদা পূরণে সক্ষম হন না অনেকেই। উভয় পক্ষ থেকেই কখনও রফা হয়, কখনও হয় না। আগেকার লোকজন ভাবতেন, ওদের চটালে অভিশাপ দেবে হিজড়ারা। আজকাল অভিশাপে লোকে তেমন বিশ্বাস করেন না। সবকিছুর নিটফল, হিজড়াদের চিরন্তন পেশার বাইরে যাওয়া।
শুনলাম কিছুদিন আগে এই রাজ্যেরই এক লোকাল ট্রেনে সহযাত্রীদের হাতে মার খায় বৃহন্নলাদের একটি দল। দীর্ঘদিনের অসহনীয় পরিস্থিতির ফসল এটা, বলাই বাহুল্য। তবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। উল্টো দিক থেকে এটাও সত্যি, জনতা যখন ক্ষেপে যায়, তখন যা ঘটে, তাকে কোনোভাবেই শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করা যায় না। শহরতলির নিত্যাযাত্রায় মহিলা কামরা এমনিতেই আগুন হয়ে থাকে। সেখানে বৃহন্নলারা কী পর্যায়ে বাড়তি অত্যাচারের যোগান দেয়, সে আমার নিজেরই দেখা। সবচেয়ে বড় কথা, আইনশৃঙ্খলা বিষয়টার গুরুত্ব কোথায়, সেটা বৃহন্নলাদেরও ভেবে দেখার সময় এসেছে।
আরও পড়ুন: বিরোধীর দায়িত্ব ও গুরুত্ব
সামাজিক অধিকাংশ সমস্যারই থাকে এক মনস্তাত্বিক অভিমুখ। বিষয়ের একটু গভীরে গেলেই সেটা উপলব্ধ হয়। বৃহন্নলারা কোনোদিনই সমাজের মূলস্রোতে সংযুক্ত হতে পারে নি। হতে দিই নি আমরা। এর ফলে সচেতন বা অসচেতন ভাবেই ওদের মধ্যেও একটা জটিল মানসিক প্রতিক্রিয়া ও প্রক্রিয়ার জন্ম হয়েছে। একটি শিশুর জন্মকে ঘিরে যখন ওরা কোনও একটি পরিবারে কিছু মুহূর্তের জন্যও পা রাখত, তখন পারিবারিক আবেগ হয়তো খানিকটা ছুঁতে সক্ষম হত ওদের। সেই দিন গেছে। বদলেছে আমাদের পারিবারিক পরিকাঠামো। এইসব প্রথা আর তেমন গুরুত্ব পায় না। অন্যদিকে বিপণন নির্ভর জীবনযাত্রার লোভনীয় হাতছানি। দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে হিজড়ারা বেছে নিয়েছে বিভ্রান্তির, নাকি অপরাধের পথ। এই পথ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাদের, সেটা ভাবার দায়িত্ব আমরাও এড়াতে পারি না। অর্থাৎ মূলস্রোতে না আনতে পারলেও মানুষের মর্যাদাটুকু দিতেই হবে।
লোকাল ট্রেনের আর একটি অভিজ্ঞতা জানিয়ে এ প্রতিবেদন শেষ করব। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। প্রবল ঝড়বৃষ্টির এক দিন। কাজের চাপে একটু রাতও হয়েছে। মহিলা কামরা একেবারে ফাঁকা। যে কয়জন আছেন, তাঁরা রোজকার আসা-যাওয়ায় চেনা মুখ। আমি বারুইপুর। তাঁরা আগেই নামবেন। সকলেই নামার আগে বলে যান, ফাঁকা ট্রেন, আমি নেমে যেন জেনারেল কামরায় চলে যাই। দ্বিধায় পড়ি। এই বৃষ্টিতে আবার নামা ওঠা? ঠিক এমন সময় আমার সামনে বসা মহিলাটি বলে ওঠেন, "কোত্থাও যেতে হবে না। বসো তো। আমি আছি। কেউ কিছু করতে পারবে না।" এঁকে চিনি আমি। হিজড়া, কিন্তু দেখে মোটেই বোঝা যায় না। ব্যবহারও শান্ত , স্নিগ্ধ।
গড়িয়ার পর থেকে পুরো ট্রেনে শুধু আমরা দু'জন। এক্ষেত্রে যা হয়, সময় কাটাতেই গল্প জমে ওঠে। এদিন বোধহয় প্রথম তিনি মনের কথা বলার একটা মানুষ পান। কথা তো নয়, বেদনার অসীম অভিঘাত। "ছোটবেলায় আমায় যখন বাড়ি থেকে নিয়ে গেল, খুব কেঁদেছিলাম জানো দিদি!" বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। কামরার ভিতরে আমরা দুটি প্রাণী। "এখনও দুর্গাপুজো এলে বড্ড কষ্ট হয় গো। লুকিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করি। বাবা আর ভাইরা বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। মা জড়িয়ে ধরে কাঁদে। আমিও কাঁদতে কাঁদতেই ডেরায় ফিরি। কী করব? এই কষ্ট নিয়েই মরতে হবে।" প্রবল এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তাঁর কথার শেষে, যা সমান আর্তিতে আমায় ছুঁয়ে মিশে যায় বাইরের বাদল বাতাসে।