জার্মান উইকিপিডিয়ান লা ক্রিৎজোলিনা ও তার স্বামী আরমিন স্টাইজেনবার্গার, যিনি একজন খ্যাতনামা কবিও বটে, যখন কলকাতা ঘুরতে আসেন, তাঁদের দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম উত্তর কলকাতায় নগেন্দ্রনাথ বসুর বাড়িখানা। আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে এই কর্মবীর বাংলায় ২২ খণ্ডের বিপুল তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন। সে স্মৃতিতে এ রাস্তার নামটাও বিশ্বকোষ লেন।
আরও পড়ুন, শুভঙ্করের ফাঁকি: ‘উনিশ’ থেকে ‘একুশ’ গেলে কত থাকে বাকি?
ভাবছিলাম বিশ্বকোষ রচয়িতার উত্তরসূরী অর্থাৎ বাঙালিরা অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়ার দুনিয়ায় বর্তমানে ঠিক কতটা পিছনে? বিদেশি উইকিপিডিয়ান হয়ত ভাবছিলেন ৯০-৯৫ মিলিয়ন জার্মানভাষীদের উইকি নিবন্ধ সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ!
আর আমরা?
বিশ্বের প্রায় ২৬১ মিলিয়ন লোক বাংলায় কথা বলেন। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির একটা রিপোর্ট বলছে 'Bengali is usually counted as the sixth most spoken native language in the world by population' পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ বা আসামের বরাক উপত্যকার বিপুল সংখ্যক মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। আন্দামানের অন্যতম প্রধান ও কর্ণাটক রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত বাংলায় উইকিপিডিয়া নিবন্ধের সংখ্যা কত?
এই লেখা প্রকাশ করার আগে পর্যন্ত মাত্র ৬৪,৬৪৬টি। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও।
নিবন্ধের সংখ্যা অনুসারে প্রায় শ তিনেক উইকিপিডিয়ার মধ্যে বাংলার অবস্থান ৮০ তম।
বিশ্বের কতজন মানুষ জাপানি ভাষায় কথা বলেন? বাংলার ধারেকাছে আসবে না সংখ্যাটা, আর সে ভাষায় তৈরি নিবন্ধ সংখ্যা সাড়ে এগারো লক্ষ! ৪৫ মিলিয়ন লোক কথা বলেন পোলিশ ভাষায়, আর তাদের নিবন্ধ সংখ্যা অবাক করা, ১৩ লক্ষ ২১ হাজার।
মালায়লম বা তামিল উইকিপিডিয়াও আমাদের চাইতে এগিয়ে রয়েছে পরিসংখ্যানে।
বর্তমানে সর্ববৃহৎ বহুভাষিক অনলাইন এই বিশ্বকোষ সারা পৃথিবীর স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তামূলক কর্মকাণ্ডে তৈরি। শুধুমাত্র স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই সুবিশাল এনসাইক্লোপিডিয়া যে বাংলাতেও আছে, আছে তার 'সিস্টার প্রোজেক্ট' গুলি বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা এ খবরটা হয়ত খুব বেশিজন রাখেননা। কেনই বা রাখবেন? কারণ দরকার পড়লে আমরা ইংরেজি উইকিতে খুঁজে, পড়ে নিতে পারি অভীপ্সু বিষয়টি। অথচ ইংরেজি ছাড়া আরো অজস্র ভাষায় উইকিপিডিয়া আছে, আছে উন্নততর নিবন্ধ যা হয়ত কোথাও কোথাও ইংরেজি প্রবন্ধটির চাইতেও সমৃদ্ধ!
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে শুরুটা হয়েছিল। পথ দেখিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০০৯-১০ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের বাঙালিরা অবদান রাখতে শুরু করেন। স্বেচ্ছাসেবীরা বাংলা ভাষার বিষয়বস্তু সমৃদ্ধি ও বাংলায় একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্ত বিশ্বকোষ সৃষ্টির লক্ষে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। হয়ত একটি নিবন্ধ প্রথমে কেউ একজন তৈরি করেন, পরবর্তীতে সবাই মিলে সেই সেটায় তথ্য যুক্ত করছেন। অন্যান্য সমস্ত উইকির মত এখানেও নিবন্ধ কোন নির্দিষ্ট একজনের অবদান নয় বরং সম্মিলিতভাবে সবাই পূর্ণতা দানের চেষ্টা করেন। পাশাপাশি তথ্যসূত্র যোগ, পাতা সুরক্ষা, গুণসম্পন্ন চিত্র নির্ধারণ, নিরপেক্ষতা নির্ধারণ, নিবন্ধ পরিষ্কারকরণ, অবিশ্বকোষীয় উপাদান বা ধ্বংসপ্রবণতাকে চিহ্নিত করার জন্য প্রশাসক বা সক্রিয় সম্পাদকেরা রয়েছেন।
বাংলাদেশে বিভাগীয় পর্যায়ে কিছু কমিউনিটি আছে। ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম কমিউনিটি যথেষ্ট কার্যকরী। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উইকি কর্মশালা, মিট আপ, ভাষা দিবসে দেশব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি নিয়ে থাকেন তাঁরা। অথচ পশ্চিমবঙ্গ উইকিমিডিয়া দলে তুলনায় কাজের লোকের সংখ্যা হাতে গোনা এবং কলকাতা নির্ভর। যদিও সাধ্যমতো চেষ্টা চলে কর্মশালা ও প্রচারের। উইকিবই (Wikibooks) উইকি অভিধান (Wiktionaries) উইকিভ্রমণ (Wikivoyage) এবং উইকিসংকলন (Wikisource) ইত্যাদিকে নিরন্তর সমৃদ্ধ করার মানুষ এপার ওপার দুই বাংলাতেই আছেন। তবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোক নিশ্চই আমাদের কম, নইলে পাল্লা দিতে পারিনা কেন।
মাতৃভাষায় নিবন্ধ পড়তে নাক সিঁটকান যাঁরা এবং বলেন বাংলা উইকিতে তেমন কিছুই থাকেনা, থাকলেও ভুল, হাল নাগাদিকৃত নয়, তাঁরা ভুলে যান ইংরেজি নিবন্ধগুলোও আকাশ থেকে পড়েনা। কোনো না কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সময় ও শ্রমদান করছেন বলেই তিল তিল করে গড়ে উঠেছে তথ্যভাণ্ডার। পেয়ে যাচ্ছি হাতে গরম তথ্য, ঝেড়ে দিচ্ছি নিজের গবেষণাপত্রে।
তাহলে নাক না সিঁটকে হাত লাগালেই হয়।
আসল প্রশ্নটা নিজের ভাষার প্রতি দরদের। ভালবেসে কাজে নামায়। ভুল আছে বলে এড়িয়ে যাওয়াতে নয়, ভুলের ভূগোলটা ছিঁড়ে ফেলাতে।
কাজটা একদম সিংহম সিনেমায় অজয় দেবগণের মত 'ভুল যে হচ্ছে সেটা জানাতে ফারাক হয়না, ফারাক হয় ভুলটাকে ঠিক করাতে'
আরও পড়ুন, অন্ধকার দূর হয়ে যাক সে আলোর মহাজাগরণে
উইকিতে লিখতে গেলে বিশেষজ্ঞ হতে হয়না, শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগেনা, লাগে উৎসাহ, সদিচ্ছা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা গড়ে তুলতে পারে সকলের জন্য উন্মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডার। জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা।
ফেসবুকে ৫০০ শব্দের স্ট্যাটাস দেওয়ার পাশাপাশি যদি বাংলা উইকিপিডিয়ায় রোজ একটা লাইনও কেউ লেখেন তবে বছরে ৩৬৫ লাইন লেখা হয়ে যায়।
আসলে আমরা দিনপঞ্জিতে বাংলার হিসেব নিই শুধু বোশেখ মাসে। পয়লা আর পঁচিশে। তাছাড়া আমাদের ছেলেপুলেদের 'বাংলাটা ঠিক আসেনা'
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটা একুশের শহিদের স্মৃতিতে সে যতই চেল্লাই না কেন, হিন্দি বলতে, ইংরেজি আওড়াতে এবং সর্বোপরি মাতৃভাষা ভুলতে কিঞ্চিৎ গর্ববোধ করি। আভিজাত্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে হাল্কা শ্লাঘা বোধ হয়।
বাংলা ভাষাকে ভাল না বাসলে তার বিশ্বকোষও কোনোদিন উন্নত হবেনা। কেবল মাঝে মাঝে স্মরণ করে যাব ২১ ফেব্রুয়ারি আর অল্পস্বল্প ১৯ মে। ঐতিহ্য বলে কথা!
ভাষা শহিদদের পূজার ছলে ভাষাকেই ভুলে থাকা।
হায় আমার দুখিনী বর্ণমালা!