‘I took a deep breath and listened to the old bray of my heart. I am. I am. I am.‘
-Sylvia Plath
আমি আমি আমি... অস্তিত্বের এই অনুভব মানুষের চিরকালীন। আর অস্তিত্ব নিয়েই দ্বন্দ্ব। অস্তিত্ব আর পরিচয় দুটো আলাদা শব্দ। তবু সমাজে দ্বিধা দ্বন্দ্ব হিংসা এই পরিচিতি ও অস্তিত্ব নিয়েই। সেই পুরাকাল থেকে শুরু করে আজও সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীবিভাজনের মধ্যে নারীও পুরুষ এই দুই বিভাজন সর্বাপেক্ষা প্রধান বিভাজন। এর স্বপক্ষে প্রথম এবং প্রধান যুক্তি প্রকৃতগত পার্থক্য। আজ এই বিভাজন নিয়ে আলোচনা অপ্রয়োজনীয়। কারণ বিভাজন রয়েছে। থাকবে। এখন দেখার বিষয় হল এই বিভাজনে বঞ্চিত কে? শোষিত কে? অত্যাচারিতই বা কে? নারী মানেই বঞ্চিত, শোষিত অত্যাচারিত এই যুক্তি যতটা হাস্যকর ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ নারী ও আকাঙ্ক্ষা এই দুটো শব্দের মধ্যে কতটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে সে বিষয় পর্যালোচনা। আকাঙ্ক্ষা শব্দটার সাথে যদি উচ্চ শব্দটা জুড়ে দিই তাহলে হয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটা মানুষের মধ্যেই রয়েছে। সাধুর মতো সংসারের সর্ববিষয়ে নির্লিপ্ত একজনের আকাঙ্ক্ষা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে মুক্তির বা নির্বেদের। তবে এই মুক্তি বা নির্বেদকে হয়ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলে দাগিয়ে দেওয়া অনেকেরই ভুল মনে হতে পারে। কিন্তু তাহলে আকাঙ্ক্ষা না বলে লক্ষ্য বলা যেতে পারে। প্রতিটা মানুষেরই তাহলে লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট। এক্ষেত্রে নারীর নিজস্ব কোনও লক্ষ্য, আকাঙ্ক্ষা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলে তা সমালোচিত হবে কেন?
কিন্তু নারীর আকাঙ্ক্ষা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা সমালোচিত হয়ে আসছে আবহমান কাল ধরে। শুধু সমালোচনা বললে হয়ত যথার্থ বলা হয় না। কারণ আক্রমণ ও হিংসা এই দুটোই নারীর প্রতি ব্যবহার করলে এই সমালোচনাই তখন সমাজের হাতিয়ার। মি টু আন্দোলন কতটা এর প্রলেপ হয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ‘মি টু’ এই শব্দটা ভীষণভাবে আর্বান। ইংরাজি অক্ষরগুলোর জন্য নয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে কয়েকটা উদাহরণ দিতে হয়- প্রখর রৌদ্দুরে মাঠে কাজ করছে যে মাঝবয়সী বউটা। তার ঘামে জবজবে শরীরটাকে খুব ভাল করে জরিপ করতে করতে হয়তবা যথেচ্ছভাবে ছুঁয়ে দিয়ে দুটাকা বেশী মজুরী দেবে বলেও নায্য পাওনাটুকু দিল না জমির মালিক। সেক্ষেত্রে বধূটি কিভাবে প্রতিবাদ করবে? গ্রাম পঞ্চায়েত বা প্রধানের কাছে যাবে? ধরা যাক, সে গ্রাম পঞ্চায়েত বা প্রধানের কাছে গেল। সব শুনে বছর ষাটের প্রধান তার লুঙ্গির খুঁট আরও একবার শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘দুটা লাউ আইন্যা দে তো। আজ লাউবড়ির ঝোল খাইতে ইচ্ছে করছে।’ পরিশ্রামসাধ্য ফসল আনাজপাতি উৎকোচ দান করেও মেয়েটি কিন্তু বিচার পেল না। বরং পরের বার আবার ফসল ফলানোর মরশুমে সেই একই বিশ্রি অনুভূতি হওয়াতে সে কি হাতের খুরপিটা দিয়ে পালটা একটা আঘাত করবে? তাহলে কি সে আর সাধারণ গ্রাম্য ক্ষেতমজুর থাকবে? না শ্রেণীশত্রু মারার কারণে নকশাল বলে চিহ্নিত হবে? বধূটির মি টু আন্দোলন কীভাবে হবে?
আরও পড়ুন, আন্তর্জাতিক নারী দিবস কি শ্রম দিবস হিসেবেও পালিত হয়?
সুনীতা সিং উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্তগ্রাম থেকে চরম দারিদ্র্যে ও দেনায় জর্জরিত হয়ে দিল্লিতে রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজে এসেছে। জীবনসংগ্রাম সুনীতাকে প্রেম আর লোভের পার্থক্য করতে শিখিয়ে দিয়েছে। তাই বারবার না করেও বাবার বয়সী ঠিকাদার ও সহকর্মী রাজেশকে আটকাতে পারেনি। শেষপর্যন্ত হয়ত ঘৃণা বিতৃষ্ণায় সুনীতার শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল। কাউকে বলে লাভ নেই ভাবতে ভাবতে রাতের চুলা জ্বালিয়েছিল ও। অথচ পরদিন কাজটা চলে গেল। একটা মিথ্যে চুরির বদনামে সুনীতার কাজ চলে যায়। আজ সুনীতা ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজ করে। যেখানেই বাবুদের চোখে সেই একই লোভ দেখতে পায় আগে দেনাপাওনা ঠিক করে নেয়। মি টু আন্দোলনের নাম পর্যন্ত কোনোদিন সুনীতা জানতে পারবেনা।
তাহলে মি টু কাদের জন্য? যৌন হেনস্থা প্রায় সমস্ত সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন মহিলারাই শিকার। কখনও যৌনতা জনিত কোনও হয়রানি হয়নি এমন মেয়ে গরীব, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত যেকোনো অর্থনৈতিকক্ষমতাসম্পন্ন পরিবারের কোনও বাড়িতেই পাওয়া যাবে না। শুধু বাইরে নয় ঘরের ভেতরও মেয়েরা বিভিন্নভাবে এর শিকার। এসব নিয়ে বহু আলোচনা সিনেমা সাহিত্য হয়ে আসছে তবুও চিত্রটা একটুও বদলায়নি কোথাওই। আজ একটু উলটো চিত্রটাও দেখা যাক। উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেকসময় বেশ কিছু মেয়েদের নিজেদেরই বাধ্য করে সমর্পণে। উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন পুরুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পরেও হয়ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ হল না। সেক্ষেত্রে মেয়েটির মনে হতে পারে এইবার একটা মি টু রব তোলার প্রয়োজন।
‘সূক্ষ্ম মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কত বেশী বিপদসংকুল
তারও চেয়ে বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ
এ সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে সঞ্চারিত হতে চাই
চিরকাল হতে অভিলাষী
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভাল লাগে বলে
তবুও কেন যে আজও হায় হাসি হায় দেবদারু
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’ –বিনয় মজুমদার
আমরা শুধু ভাবি নিকটে গেলেই প্রকৃত সারসখানি উড়ে যায়। কিন্তু এরও আগের কথাগুলো অনেক বেশী প্রয়োজনীয়। চিরকাল আমরা বিপদ জেনেও ‘সাগরে আকাশে সঞ্চারিত’ হতে চেয়েছি। আর এই চিরকালীন অভিলাষ নিকটে নিয়ে যায়। হয়ত মানুষের, হয়ত ঘটনার বা হয়ত পরিণতির। সেক্ষেত্রেও আমরা দোষী বা ভিকটিম বলে সঠিক চিহ্নিত করে উঠতে পারি না। যেকোনো ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে যৌন হেনস্থার শিকার হলে অবশ্যই তা শুধু মি টু নয় আইনের নির্দিষ্ট ধারায় দোষীকে শাস্তিপ্রদান করাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যে মেয়েটার মাসমাইনেতে হয়ত স্কুলে বাচ্চার ফি জমা পড়ে অথবা বাড়িতে অসুস্থজনের চিকিৎসা হয়। সেই মেয়েটা কতটা পারবে সমস্ত গ্লানিকে প্রকাশ্যে এনে উচ্চতর পদমর্যাদাবিশিষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষটির বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলতে? বিচারব্যবস্থাই বা কত দ্রুত সমাধান দিতে পারবে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে? প্রশ্ন থেকে যায়। গণতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থায় তাও অভিযোগের একটা জায়গা রয়েছে। চিনের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বা সোভিয়েত রাশিয়ায় মেয়েরা কী আদৌ পারে? কোথাও কোনও অভিযোগ জানাতে? রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি পদক্ষেপ কতটা সুরক্ষিত রাখে সে দেশের মেয়েদের? চিনের মিডিয়া সরকার নিয়ন্ত্রিত। তাই আভ্যন্তরীণ কোনও খবর জানা সম্ভব নয়। যেটুকু টুকরোটাকরা খবর পর্যটকগণের বর্ণনায়। রাশিয়ার পতনের পর সাইবেরিয়ার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মেয়েদের ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা জানতে পেরেছে গোটা বিশ্ব। অবশ্য রাষ্ট্র কর্তৃক যেকোনো দমন বা নিয়ন্ত্রণে প্রথম নিপীড়নের শিকার মেয়েরাই।
মি টু আন্দোলনে তারাই সামিল হতে পারছে যারা সমাজে আগে থেকেই সমস্ত সুযোগসুবিধা সম্পন্ন মর্যাদায় রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রেই একমাত্র এই আন্দোলন সফলতা লাভ করেছে। সব ক্ষেত্রে যে যৌন হেনস্থা সত্যিই ঘটছে তা নয়। হয়ত উভয়ের সম্মতিতে একটা সম্পর্ক। কিন্তু তার মানেই বিনা অনুমতিতে ছোঁয়া যায় না পরস্পরকে। কিন্তু পারস্পরিক সম্মতি অনুমতিতে যে সম্পর্ক স্থাপন হল পরবর্তীকালে সম্পর্ক ভেঙে গেলে অথবা উচ্চাশা পরিপূরণ না হলে মি টু-র দাবি তোলা যুক্তিসংগত নয়। আবার অনেকক্ষেত্রে সেই সময়ে চুপ করে থেকেও পরবর্তীকালে অনেকদিন পর মিডিয়ায় হইচই করে প্রতিবাদের ঝড় তোলা ও নিজেকে মি টু-র শিকার এইরকম ভাবমূর্তি তোলা এগুলোর যুক্তিও অদ্ভুত মনে হয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচ্য হওয়া উচিত এই মেনে নেওয়ার সময় মেয়েটির পরিস্থিতি কতটা প্রতিকুল ছিল সেইসময়। সাম্প্রতিক সংবাদপত্রের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি প্রতিকুল না থাকা সত্ত্বেও মেয়েটি মেনে নিয়ে চুপ করেই ছিল এবং এর পরিবর্তে চাকরি বা প্রতিষ্ঠার বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা নিয়েছিল সেই সময়। এইসব ক্ষেত্রেও কি মি টু সিমপ্যাথি কাজ করা উচিত?
বিপদসংকুল পথে সাফল্যের স্বাদ নেওয়া হয়ে গেলে ঘুরে তাকিয়ে যেগুলো পড়ে থাকে তা স্মৃতি অথবা বিস্মৃতি। মি টু অনেক বড় একটা ধারণা হওয়া উচিত। সমাজের সমস্ত স্তরে না ছড়িয়ে পড়ে শুধুমাত্র কমফোর্টজোনে থাকা আর্বান এলিটদের নিয়ে মি টু আন্দোলন হয় না। হয়নি আজ পর্যন্তও। এই সত্য আমাদের অন্তত নারী দিবসে স্বীকার করা উচিত। তাহলেই আগামীর অঙ্গীকার সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা।
(লেখক অধ্যাপনারত। মতামত ব্যক্তিগত)