অল্প বয়সেই স্বামীকে হারিয়ে উত্তরপ্রদেশের সুনীতা কুমারীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে কী ভাবে দিন কাটাবেন বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। তার স্বামী ছিলেন বিএসএফের এক কনস্টেবল। প্রথমে সন্তানকে নিয়ে স্বামীর ঘরে থেকে যাওয়ার কথা ভাবলেও কিছুদিন পরেই সুনীতা বুঝতে পেরেছিল, যাদের ওপর সে নির্ভর করে আগামীর স্বপ্ন দেখছে তারা কেউই ভরসার পাত্র নয়। অগত্যা উপায় না দেখে সুনীতা বিএসএফে যোগদান করেন। এই বছর প্রজাতন্ত্র দিবসে সুনীতা রাজপথ থেকে টেলিভিশনের পর্দায় লাইভ ছিলেন। ৩৮ বছর বয়সী সুনীতা বিএসএফ-এর সীমা ভাওয়ানি দলের সদস্য হিসাবে মোটরসাইকেল প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন রাজপথের বুকে যা রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সহ দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। সুনীতা সেই ১৪ জন মহিলার মধ্যে একজন যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে বিএসএফে যোগদান করেন। ১৫০ জন সদস্য নিয়ে তাদের নতুন পরিবার। সেখানে সুনীতা ছাড়াও রয়েছে ডলি, মঞ্জু আরও অনেকেই।
বিএসএফ ডিজি পঙ্কজ সিং দ্য সানডে এক্সপ্রেসকে দেওয়া একান্ত এক সাক্ষাতকারে বলেন, “আমরা আমাদের নারীবাহিনী নিয়ে গর্বিত। তারা সবাই নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এবং এমনকি তাদের প্রশিক্ষণও শেষ করেনি। তবুও তারা এত ভালো পারফর্ম করেছে। বিএসএফ বিশ্বাস করে যে একটি সুযোগ দেওয়া হলে এমন কিছু নেই যা নারীরা অর্জন করতে পারে না। আমরা কেবল তাদের জীবন পুনর্গঠনে সাহায্য করার জন্যই নয়, আরও অনেক কিছু অর্জন করতে আমাদের কাজ চালিয়ে যাব”।
সুনীতা ২০২০ সালের আগস্টে বিএসএফ-এ যোগ দেন। এই বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের মাত্র ১৫ দিন আগে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কুচকাওয়াজে অংশ নেবেন কিনা? কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলে দেন সুনীতা। তিনি স্কুটি ছাড়া আর কিছুই সেভাবে চালাতে পারতেন না। তবুও বাইক চালানো শেখা তার কাছে ছিল এক নেশার মতই। ১৫ দিনের কঠোর পরিশ্রম শেষে অবশেষে সাফল্য। ভোর ৪ টের সময় ঘুম থেকে উঠেই ৬ টায় মাঠে গিয়ে প্র্যাকটিস। এই ছিল সুনীতার প্রতিদিনের রুটিন। কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে কেমন লাগছে? সুনীতার কথায়, আমাদের প্রশিক্ষক খুব ভাল ছিল, সবসময় আমাদের আত্মবিশ্বাস দিয়ে গেছেন। আমি অনেকবার নিচে পড়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু যতক্ষণ না আমি এটি সঠিকভাবে পেয়েছি ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে গেছি। আজ, আমার সন্তানরা আমাকে নিয়ে গর্বিত। আমি কখনই কল্পনা করিনি যে আমি একদিন রাজপথে থাকব এবং লোকেরা আমাকে টিভিতে দেখবে,” ।
বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে ১৯ বছরের ডলিও যোগ দেন বিএসএফে। বিএসসি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি বিএসএফে যোগদেন। ডলিও ছিলেন স্কোয়াডের অন্যতম সদস্য। তার কথায়, “আমাকে যখন ডাকা হয়েছিল তখন প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল, প্রথমটাই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, পরে মনকে স্থির করি এবং প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। আমি যখন দেখেছিলাম ৪০ বছর বয়সেও অনেকেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন আমি ভাবলাম আমি কেন নয়, প্রজাতন্ত্র দিবসে, ডলি একটি মানব শৃঙ্খল পিরামিডের শীর্ষে জাতীয় পতাকা ধরে রেখেছিলেন। একাধিক মোটরসাইকেল সুসংগতভাবে চলছিল। ডলি বলেন, আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, মা বললেন, ‘তুমি আমার বড় ছেলে’। তার পারফরম্যান্স মুগ্ধ করেছে আসমুদ্র হিমাচলকে।
হরিয়ানার ঝাজ্জারের বিএসএফ কনস্টেবল মঞ্জু বালা কখনো কল্পনাও করেননি যে তিনি ৪০ বছর বয়সে একটি সাহসী দলের অংশ হবেন। ২০১৯ সালে তার স্বামী, একজন বিএসএফ কনস্টেবলের মৃত্যুর পর তিনি বিএসএফে যোগ দিয়েছিলেন। ১৫ দিন আগে মোটরসাইকেল দলে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল, তখন সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার কথায় প্রথমে ভেবেছিলাম “আমার যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে কে আমার সন্তানদের যত্ন নেবে? কিন্তু পরে আমি ভাবলাম যদি আমাকে উপরে উঠতে হয় তবে আমাকে অবশ্যই এটি করতে হবে, আমি রাজি হয়ে যাই”। তিনি আরও বলেন, “আমার সন্তানরা এর আগে কখনও প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড দেখেনি। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাকে টিভিতে দেখছিল এবং মোবাইল ফোনে আমার পারফরম্যান্সের ভিডিও বানাচ্ছিল। আমার খুব গর্ববোধ হচ্ছিল”।
অপর এক কনস্টেবল জ্যোতি, ২০১৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর বিএসএফে যোগ দেন। হরিয়ানার ভিওয়ানির একটি কৃষক পরিবার থেকে,উঠে আসা জ্যোতি জানান “আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি আমার শ্বশুরবাড়ি, আমার মা এবং বিএসএফের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়েছি। আমার মেয়ের বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। প্রজাতন্ত্র দিবসের এক সপ্তাহ আগে আমাকে বাইক প্রদর্শনীর জন্য ডাকা হয়েছিল। অংশ নিতে পেরে আমি খুব গর্বিত”।
প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর হিমাংশু সিরোহি জানিয়েছেন, “সীমান্ত থেকে নারীবাহিনীকে ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তারা প্রশিক্ষণের জন্য সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি। তাই আমরা এই মহিলাদের দিল্লিতে কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণে ডেকেছিলাম। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সহজ ছিল না, কারণ যাদের বয়স ৩৫ এর ওপরে ছিল তারা বিশেষভাবে ভয় পেয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে একাধিক পন্থায় অনুশীলন করিয়েছি। আমরা প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা অনুশীলন করেছি। ধীরে ধীরে, তারা ভয় কাটিয়ে উঠল এবং পুরো বিষয়টির অংশ হতে পেরে বেশ উত্সাহী এবং খুশি হয়েছিল,”।