ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল গতরাতে ৬.৪ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। শুক্রবার মধ্যরাতে পশ্চিম নেপালের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কমপক্ষে ১২৮ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি জানিয়েছে, রাত ১১.৪৭ মিনিটে ৬.৪ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে বিস্তৃর্ণ এলাকা, যার কেন্দ্রস্থল ছিল জাজারকোট জেলা। যেটি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ২৫০ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত।
ভূমিকম্পের প্রভাব কাঠমান্ডু, এর আশেপাশের জেলা এবং এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি সহ উত্তর ভারতের অনেক অংশে অনুভূত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালিত নেপাল টেলিভিশনের মতে, পশ্চিম নেপালের জাজারকোট এবং রুকুম জেলা ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নেপালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে যে দুটি জেলায় কমপক্ষে ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৪০ জন। ভূমিকম্পে কত ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নেপালের ভুমিকম্পের প্রভাব পড়ে ভারতেও। চলতি বছর এ পর্যন্ত ভারতে ৩২ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বছরের শুরুই হয় ভূমিকম্প দিয়ে। নতুন বছরের প্রথম দিনে দিল্লি ও আশপাশের এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৩.৮। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজির মতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৬ বার ভূমিকম্প হয়েছে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক এ বছর কোন দিনে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে
- ভারতের প্রতিবেশী রাজ্য নেপালে ৩রা নভেম্বর রাতে সংঘটিত ৬.৪ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করেছে। যার প্রভাব পড়েছে ভারতেও। ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দিল্লি-পাটনা সহ একাধিক এলাকা।
- রবিবার, ১৫ অক্টোবর দিল্লি এনসিআর-এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল৷ দিল্লি, গুরুগ্রাম এবং নয়ডা সহ অনেক এলাকায় কম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল হরিয়ানার ফরিদাবাদের কাছে। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৩.১
- উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীর কাছে ৫ অক্টোবর ৩.২ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়৷ ভারতের ন্যাশনাল সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের মতে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী থেকে ৩৩ কিলোমিটার উত্তর-উত্তর-পশ্চিমে (NNW)। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ কিলোমিটার গভীরে ভারতীয় সময় ভোর ৩টে ৪৯ মিনিটে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়।
- ৩ অক্টোবর মঙ্গলবার দিল্লি-এনসিআর সহ উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। দিল্লি, নয়ডা, গাজিয়াবাদ, জয়পুর সহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় কম্পন অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা মাপা হয়েছে ৬.২। একই সময়ে, আফটার শকও অনুভূত হয় ওই সকল এলাকায়।
- ২ অক্টোবর, সোমবার সন্ধ্যায় অসম ও মেঘালয়ে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৫.২। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজির মতে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মেঘালয়ের উত্তর গারো পাহাড়ের ১০ কিলোমিটার গভীরে। অসম ও মেঘালয় ছাড়াও ত্রিপুরায়ও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
- ১২ সেপ্টেম্বর আন্দামান সাগরে ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছিল। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৪.৪।
- ১১ সেপ্টেম্বর বঙ্গোপসাগরে ৪.৪ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল।
- ১৪ আগস্ট মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির কাছে একটি ৫.৪ মাত্রার শক্তিশালী কম্পন অনুভূত হয়।
- শনিবার, ৫ আগস্ট দেশের অনেক এলাকায় শক্তিশালী কম্পন অনুভূত হয়। ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পার্বত্য অঞ্চলে।
- ২৯ শে জুলাই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা মাপা হয়েছে ৫.৯।
- রাজস্থানের জয়পুরে, ২১ জুলাই শুক্রবার সকালে কম্পন অনুভূত হয়। ১৬ মিনিটের মধ্যে ঘটে যাওয়া তিনটি আফটারশকে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে
- ১৭ জুন জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল।
- জম্মুতে ১৪ জুন এক দিনে ৪ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর তীব্রতা ছিল ৫.৪, যার কারণে প্রশাসন স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়।
- ১৩ জুন জম্মু ও কাশ্মীরে ৫.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। উত্তর ভারতেও কম্পন অনুভূত হয়।
- ৫ জুন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ৩.৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল।
- ২৯ মে অসম, মেঘালয়, উত্তরাখণ্ডে শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজির মতে, সোমবার সকালে তেজপুরের কাছে রিখটার স্কেলে ৪.৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
- ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি অনুসারে, ২৮ মে রবিবার সকালে আফগানিস্তানের ফৈজাবাদের কাছে ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। আফগানিস্তানে ভূমিকম্পের জেরে দিল্লি সহ উত্তর ভারতে কম্পন অনুভূত হয়েছে।
- জম্মু ও কাশ্মীরের ৩০ এপ্রিল শ্রীনগরের কাছে রিখটার স্কেলে ৪.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
- ১৭ এপ্রিল গুয়াহাটিতে ৩.৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
- ১২ এপ্রিল বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছিল। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ৪.৩ রেকর্ড করা হয়েছে।
- ২৪ মার্চ অরুণাচল প্রদেশের চাংলাং-এর কাছে রিখটার স্কেলে ৪.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল।
- ২২ মার্চ দিল্লি-এনসিআর সহ উত্তর ভারত জুড়ে কম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৬.৬। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল হিন্দুকুশ পার্বত্য অঞ্চল।
- ২৪ ফেব্রুয়ারি মণিপুরের বিষ্ণুপুরের কাছে ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছিল।
- ১৩ ফেব্রুয়ারি সিকিমের ইউকসোমের কাছে রিখটার স্কেলে ৪.৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল।
- ১২ ফেব্রুয়ারি অসমের কিছু অংশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
- ৫ ফেব্রুয়ারি তেলঙ্গানার নিজামবাদে ৩.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়ে।
- ৪ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের আমরেলিতে ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়। এর তীব্রতা ছিল ৩.২।
- ৩ ফেব্রুয়ারি, হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রের কাছে রিখটার স্কেলে ৩.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
- ৩০ জানুয়ারী গুজরাটের কচ্ছে কম্পন অনুভূত হয়েছিল। আইএসআর জানিয়েছে, ভোর ৫.১৮ মিনিটে ৩.২ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে এলাকা।
- ২৪ জানুয়ারি দিল্লি-এনসিআরে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল পশ্চিম নেপাল। এর তীব্রতা ছিল ৫.৮ ।
- হিমাচল প্রদেশে ১৪ জানুয়ারি ৩.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
- ৬ জানুয়ারি আফগানিস্তানে ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। দিল্লি-এনসিআরেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ৫.৯ ।
- নতুন বছরের প্রথম দিনে দিল্লি এবং আশেপাশের এলাকায় ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে । ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৩.৮। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি জানিয়েছে, হরিয়ানার ঝাজ্জারে ৩.৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে।
- নেপালে গত এক মাসে তিনবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
নেপালে শুক্রবার (০৩ নভেম্বর) গভীর রাতে হওয়া ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দিল্লি এনসিআর সহ উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় ৬.৪ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছে। বিহারের রাজধানী পাটনা এবং উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনউতেও ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের মতে, শুক্রবার মধ্যরাতের ঠিক আগে উত্তর-পশ্চিম নেপালের জাজারকোট জেলায় একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে কমপক্ষে ১২৮ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে এর দূরত্ব ৫১৯ কিলোমিটার।
নেপালে কেন ভূমিকম্প হয়?
বিশেষজ্ঞদের মতে, নেপাল পাহাড় এবং মালভূমি দ্বারা বেষ্টিত, যার কারণে প্রায়শই টেকটোনিক প্লেটগুলির নড়াচড়া করে। এমনকি শুক্রবার রাতে নেপালের জাজারকোটের যে এলাকায় ভূমিকম্প হয়েছে সেটি পাহাড়ি এলাকা। সূত্র জানায়, প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার জনসংখ্যার এই এলাকায় এর আগেও ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছে। এবার এর তীব্রতা বেশি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছে।
ভূবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা বলছেন, বছর দুয়েক ধরে নেপালে পরপর যে সব ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে গোটা হিমালয়ের ভূস্তর আরও অস্থির হয়ে গেছে। এর ফলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের পরেও শক্তিশালী আফটার শক অনুভূত হচ্ছে। ভূবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, হিমালয় অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে রেষারেষির জেরেই এই এলাকাটি অতি মাত্রায় ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে। আবহাওয়া বিজ্ঞানী সজীব কর বলেছেন, নেপালের মাত্র ১৪ শতাংশ এলাকা সমতল । বাকি অংশ পাহাড় বা ঘন বনে মোড়া। সমতল এলাকা তরাই নামে পরিচিত। একই সময়ে, এর উত্তর প্রান্তে রয়েছে উচ্চ হিমালয় পর্বতমালা। কেন নেপাল এত ঘনঘন ভূমিকম্প হয় তা বোঝার জন্য আমাদের এর ভূতাত্ত্বিক দিকটা জানতে হবে।
পৃথিবীর চারপাশে জল আর জমি ছাড়াও ভূত্বক বড় টেকটোনিক প্লেট দিয়ে গঠিত। পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশ এই স্থলভাগের অন্তর্ভুক্ত। এই টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে প্রতিনিয়ত চলছে ক্রিয়াকলাপ। এরকম দুটি বড় টেকটোনিক প্লেটের ধারে নেপালের অস্তিত্ব রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, নেপাল ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। এই দুটি প্লেটের সংঘর্ষ হলে নেপালে ভূমিকম্প হয়।উভয় প্লেট প্রতি বছর ৫ সেন্টিমিটার হারে একে অপরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যার কারণে নেপালে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। এই গতি আপনার কাছে ছোট মনে হলেও এর প্রভাব বিশাল। এই দুই প্লেটের সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বত তৈরি হয়েছিল ৫ কোটি বছর আগে।
গতকালের কম্পন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ভারতের রাজধানী দিল্লিসহ উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও তা অনুভূত হয়েছে। নেপালে রাত ১১.৩২ মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে মানুষজনকে । ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি ছাড়াও নেপালের ভূমিকম্পের কম্পন বিহারের পাটনা এবং লখনউ এবং উত্তর প্রদেশের আশেপাশের এলাকায়ও অনুভূত হয়েছে।