Advertisment

 শ্রমিক স্পেশালে ২৪ ঘণ্টা: এক যাত্রায় আর পৃথক ফল নয়

বাচ্চাটা কাঁদছিল, গরমে, ক্লান্তিতে। তার মায়ের ঘুমপাড়ানি গানে ছিল নিজেদের দুরবস্থার কথা আর কর্তৃপক্ষকে অভিসম্পাত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Shramik Special 24 hours journey

শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন (প্রতীকী ছবি)

(গান্ধীনগরের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্র আনন্দ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে শিক্ষানবিশের কাজ করেছেন। এই যাত্রা বর্ণনা তিনি দিয়েছেন কেদার দেশপাণ্ডেকে।)

Advertisment

"একবার ট্রেন তেলেঙ্গানা ঢুকে পড়লেই কেসিআর (মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও) আমাদের বিয়ার আর বিরিয়ানি খাওয়াবে।" সুরাট-ওয়ারাঙ্গল শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে আমার পাশে বসা এক পরিযায়ী শ্রমিক বললেন। আমি হেসে ফেললাম, অন্যরাও। যেভাবে উনি কথাটাবললেন, তাতে মজা ছিল। ততক্ষণে ১৪ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, আমরা সুরাটের উধনা স্টেশন থেকে রওনা দিয়েছি, আমাদের কারোরই পেটে প্রায় কিছুই পড়েনি। বাড়ি, বিরিয়ানি আর বিয়ার- এই তিনটে কথা ভেবে একটু খুশি হয়ে উঠল আমাদের অন্তরাত্মা।

আমি হায়দারাবাদের ছেলে। গুজরাটের গান্ধীনগরে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ি। যখন লকডাউন হল আমাদের ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেল, হস্টেলের আমরা কয়েকজন ছাড়া সবাই বাড়ি চলে গেল। ক্যান্টিন বন্ধ থাকায় খাবারের সমস্যা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা তেলেঙ্গানার তিনজন, আমি, আমার এক ব্যাচমেট ও একজন পিএইচডি ছাত্র ঠিক করলাম, আমরাও চলে যাব।

গান্ধীনগরের এক নোডাল অফিসারের সঙ্গে দেখা করে আমরা ২৩ মে-র স্পেশাল ট্রেনের একটা স্লট পেলাম। ট্রেনটা সুরাটের কাছে সাবার্ব স্টেশন উধনা থেকে ছেড়ে ওয়ারাঙ্গল যাবে।

২৩ মে ভোর ৫.৪৫-এ আমরা হোস্টেল থেকে বেরোলাম। গান্ধীনগরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর আমাদের আমেদাবাদ অবধি নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখান থেকে আরও পাঁচজনের সঙ্গে আমরা উধনা পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেখানে আমাদের স্ক্রিনিং হল, এবং ট্রেনের টিকিট দেওয়া হল।

স্ক্রিনিংয়ে প্রায় একঘণ্টা লাগল। গরম অসম্ভব। স্ক্রিনিং সেন্টার থেকে আমাদের উধনা জংশন যাওয়ার জন্য বাসে উঠতে বলা হল। ২০ সিটের বাস পুরো ভর্তি, অন্তত ৪০ জন লোক তাতে। সোশাল ডিসট্যান্সিং কথাটা একটা নিষ্ঠুর রসিকতার মত লাগছিল তখন। আমাদের মতই আরও বাস ছিল, সবই ভিড়ে ঠাসা।

স্টেশনে পৌঁছে আমাদের ড্রাইভার নেমে বাসে আমাদের চাবি বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন। সব গাড়ির চাবি খোলা হবে ট্রেনে যাত্রীদের ওঠার সময় হলে। আমরা দুঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করলাম। বাস ততক্ষণে তপ্ত উনুনে পরিণত হয়েছে।

একজন অল্পবয়সী মা তাঁর কোলের শিশুটাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাচ্ছিলেন, বাচ্চাটা গরমে আর ধকলে কাঁদছিল, ভদ্রমহিলা গান গাইছিলেন তেলুগুতে। আমি গানটা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম, তাঁর গানে ছিল ওঁরা দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন তার কথা আর কর্তৃপক্ষকে অভিসম্পাত।

টিকিটের দাম ৫২০ টাকা করে হলেও আমি ৭০০ টাকা দিয়েছিলাম। এসবে রাগ হয়, কিন্তু কী করার আছে! সকলের মতই আমিও তো বাড়ি ফিরতে মরিয়া।

শেষ পর্যন্ত আমাদের বাসের তালা খোলা হল এবং আমরা স্টেশনের দিকে দৌড়লাম। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনে আমাদের তুলে দেওয়া হল। লোকে কীভাবে কামরায় উঠবে তার কোনও পদ্ধতি নেই। প্ল্যাটফর্মে পুলিশ রেলের লোক সকলেই ছিলেন, কিন্তু কতজন প্রত্যেক কামরায় চড়বেন, সে সব কেউ দেখার ছিল না। রাত যখন সাড়ে আটটা তখন আমি ইঞ্জিনের কাছে একটা কামরায় উঠতে পারলাম।

কামরায় সব কাঠের বেঞ্চ, রেক্সিনের যেরকম সিট দেখতে আমরা অভ্যস্ত তেমন নয়। কোনও বার্থ নম্বর বা সিট নম্বর নেই। মারপিট শুরু হয়ে গেল, একে অন্যরম মুখে, সিটের নিচে ব্যাগ ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিল।

বেঞ্চগুলোর উপর ধুলোর আস্তরণ, টয়লেট দুর্গন্ধে ভরা। কিন্তু ট্রেন যখন চলতে শুরু করল, তখন কিছুটা স্বস্তি। শেষ পর্যন্ত সকলেই সামান্য হলেও বসার জায়গা পেল।

আমি জানালার ধারে জায়গা পেয়েছিলাম, আমার বন্ধুরা আমার পাশেই বসেছিল। আমাদের সামনে একটা দল সিট নিয়ে ঝগড়া করছিল। আমরা আমাদের সিট ওদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ঝগড়া থামেষ এখন তিনজনের সিটে আমরা ৫-৬ জন। আমার ভয় করতে শুরু হল। আমি অসুস্থ হলে কী হবে? আমার যদি কোভিড পজিটিভ হয়? এ ভাবে পৌঁছে আমি পরিবারের লোকজনকে বিপদে ফেলছি না তো?

হঠাৎই কামরা জুড়ে খাবারের গন্ধ। আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের কিছু জলখাবার দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়ে গেছে। আমাদের একজন যাত্রী, সুরাটের কাপড়কলের শ্রমিক রবি, তার খাবার আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে বলল। হৃদয় ছুঁয়ে গেল আমাদের। রাতের খাওয়ার পর আমরা বসে গল্প করছিলাম। কিন্তু আমাদের মনে প্রশ্ন, তেলেঙ্গানা পৌঁছনোর পর আমাদের কী হবে? আমাদের কি বাড়ি যেতে দেওয়া হবে নাকি ইনস্টিট্যুশনাল কোয়ারান্টিনে রাখা হবে?

ঘুমোনোর সময় হল, মানুষ যে যেখানে পারে শুয়ে পড়ল, কেউ দুটো সিটের মাঝে, কেউ করিডোরে, কেউ সিটে। আমি ও আমার বন্ধুরা কিছুক্ষণ গল্প করলাম। পরে আমরাও পালা করে সিটের উপর ঘুমিয়ে পড়লাম। কষ্টকর ব্যাপার, কিন্তু হায়দরাবাদে গিয়ে ভাই ও অন্যদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ভেবে আরাম পেলাম। আমার বাবা-মা মাহবুবনগর জেলায় গ্রামের বাড়িতে থাকেন।

পরদিন সকালে সবাই দুটো বাথরুমের সামনে ভিড় করতে লাগল, কিন্তু দুটোর একটাও ব্যবহার করার যোগ্য ছিল না। টয়লেট ভাসছিল, দুর্গন্ধ অসহনীয় ছিল।

সকাল ৯টা নাগাদ ট্রেন থামল মহারাষ্ট্রের আকোলায়। কর্তৃপক্ষ কলা দিল আর জল দিল প্ল্যাটফর্ম থেকে ছুড়ে। আমার বচসা শুরু হল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না এরকম ব্যবহার কেন করা হচ্ছে। আমার অত্যন্ত অপমানিত লাগছিল।

কিছুক্ষণ পর, ট্রেন থেমে গেল। সেটা ঈদের আগের দিন, স্থানীয় বাসিন্দারা ট্রেনে এসে আমাদের রঙিন ভাত আর বিস্কুট দিলেন। আরেকজন আমাদের জলের বোতল ভরে দিলেন। আমাদের মন খুশিতে আর কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল।

সেদিন দুপুর সাড়ে বারোটায় বালহর্ষ স্টেশনে রেলওয়ে আধিকারিকরা আমাদের জানালা দিয়ে ১০০ গ্রাম খিচুড়ি আর জলের বোতল দিলেন, সব কামরার জানালা দিয়ে। আবার ঝগড়া শুরু হল।

সাড়ে ছটা নাগাদ আমাদের ট্রেন ওয়ারঙ্গলে পৌঁছল। এর আগে আমি ভাবছিলাম যাদের সঙ্গে আমি ট্রেনে চড়েছি, মূলত যারা দিনমজুর, তাদের থেকে আমি আলাদা। কিন্তু এই যাত্রা আমাদের এক করে দিয়েছিল। ট্রেন থেকে আমরা যখন প্ল্যাটফর্মে পা রাখলাম, তখন আমরা সবাই এক, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, আমাদের সকলের মনে শুধু বাড়ি পৌছনোর ভাবনা।

পরবর্তী স্ক্রিনিংয়েও প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগল, কিন্ত এবার যেন সময়টা আরও বেশি মনে হচ্ছিল। এবার আমার হাতে হোম কোয়ারান্টিনের স্ট্যাম্প মেরে হায়দরাবাদগামী রাজ্য পরিবহণের বাসে তুলে দেওয়া হল।

আমি বাড়ি পৌঁছলাম রাত সাড়ে দশটা নাগাদ। ভাইকে ফোন করে বললাম হোম কোয়ারান্টিনের ব্যাপারে কী কী করতে হবে। গান্ধীনগর থেকে যে ব্যাগগুলো এনেছিলাম সেগুলো এখনও বাড়ির বাইরে পড়ে আছে। কোয়ারান্টিন শেষ হলে মাহবুবনগরে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাব।

COVID-19
Advertisment