ফের কেরালায় ঢুকে পড়েছে নিপা ভাইরাস। ভাইরাসের সংক্রমণে দু জনের মৃত্যুর পর সতর্ক কেরল সরকার। সংক্রমণ রুখতে কেরলে কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞদের একটি দল পাঠানো হয়েছে। কেরলের কোঝিকোড়ে মৃত্যুর ঘটনা জানার পর স্বাস্থ্য বিভাগ চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করেছে। রাজ্যের আরও চারজনের নমুনা পরীক্ষার জন্য পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজিতে পাঠানো হয়েছে।
কেরালায় নিপা ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে, ২০১৮ এবং ২০২১ সালেও কোঝিকোড়ে এই ভাইরাসের কারণে মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে নিপা ভাইরাস কতটা প্রাণঘাতী এবং কেন কেরালায় বারবার এর কেস রিপোর্ট হচ্ছে?
কেরলে দু'জনের মৃত্যুর পর ৪০টিরও বেশি কন্টেনমেন্ট জোন ঘোষণা করা হয়েছে। ভয়ঙ্কর নিপা ভাইরাসে দু জনের মৃত্যুর পর কেরালার কোঝিকোড় জেলায় ৪০টিরও বেশি কন্টেনমেন্ট জোন ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুল, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। বুধবার স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে যে কোঝিকোড়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী সহ তিনজন সংক্রামিত হয়েছেন।
এখনও পর্যন্ত ১৩০ জনেরও বেশি লোকের পরীক্ষা করা হয়েছে। কোঝিকোডের জেলা শাসক এ গীতা বলেছেন যে সন্দেহভাজন নিপা সংক্রমণ রোগীদের সংস্পর্শে আসা লোকের সংখ্যা প্রায় ৭০২ এ পৌঁছেছে। এর মাঝেই পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির (এনআইভি) প্রধান বিজ্ঞানী ডঃ প্রজ্ঞা যাদব, জানিয়েছেন নিপা ভাইরাস করোনার থেকে অনেক বেশি মারাত্মক। এখন পর্যন্ত, নিপা সংক্রামিত রোগীদের মধ্যে দুটি উপসর্গ সনাক্ত করা হয়েছে, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ এবং স্নায়বিক দুর্বলতা।
নিপা ভাইরাস কি এবং এটি কতটা মারাত্মক?
এটি একটি জুনোটিক ভাইরাস, যা প্রাণীদের মাধ্যমে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার একটি গ্রামে নিপার প্রথম কেস রিপোর্ট করা হয়েছিল। মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর এটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। যারা পশুপালনের সঙ্গে জড়িত তাদের মধ্যেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে বেশি। শুধু মানুষের মধ্যেই নয়, কুকুর, বিড়াল, ছাগল এবং ঘোড়ার মত পোষা প্রাণীতেও সংক্রমণের রেকর্ডরপাওয়া গেছে।
WHO এর মতে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা মারাত্মক। সংক্রমণের পরে রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি, এই ভাইরাস মোকাবিলায়। উপসর্গ ভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয় রোগীকে।
নিপা ভাইরাসের সঙ্গে কেরলের সংযোগ?
আমরা যদি নিপা ভাইরাসের আগের ঘটনাগুলি দেখি, আমরা দেখতে পাব যে এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র কেরালায় রিপোর্ট করা হয়েছে। কেন এমন ঘটনা? নিপা ভাইরাস আবিষ্কারকারী অধ্যাপক স্টিফেন লুবি। অধ্যাপক লুবি, যিনি গত ১৫ বছর ধরে নিপা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছেন, বলেছেন যে নিপা ভাইরাস দক্ষিণ এশিয়ায় পাওয়া বড় আকারের বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই বাদুড়কে ফ্রুট ব্যাট বলা হয় কারণ এটি ফলের রস চুষে খায়। এই বাদুড়গুলো নিপা ভাইরাস ছড়াতে সাহায্য করে। কেরলে এদের সংখ্যা বেশি। এছাড়া ভারতের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায়ও এদের দেখা মেলে।
বাদুড় কেন সংক্রমিত হয় না?
অধ্যাপক লুবি বলেন, এর কারণ বাদুড় মধ্যে পাওয়া বিশেষ ধরনের অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডিগুলি বাদুড়ের জন্য একটি প্রতিরক্ষামূলক ঢাল হিসাবে কাজ করে, ফলস্বরূপ ভাইরাসটি তাদের দেহে উপস্থিত থাকে, কিন্তু তাদের সংক্রমিত করতে পারেনা। এই ভাইরাস বাদুড়ের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এছাড়া বাদুড়ের মল ও প্রস্রাবের মাধ্যমেও নিপা ভাইরাস মানুষের শরীরে পৌঁছাতে পারে।
কোন লক্ষণগুলি নজর রাখা দরকার এবং কীভাবে এড়ানো যায়?
নিপা ভাইরাস সংক্রমণ সহজেই একজন থেকে অন্য জনের দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই সতর্ক থাকা দরকার। সংক্রমণের পর রোগীদের মধ্যে অনেক ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা। উপসর্গ ২ সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। এমনটা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া একান্ত দরকার।
সংক্রমণ নিশ্চিত করতে সেরোলজি, সিরাম নিউট্রালাইজেশন টেস্ট, হিস্টোপ্যাথলজি, পিসিআর এবং ভাইরাস আইসোলেশন এবং এলিসা পরীক্ষা করা হয়। ঝুঁকি কমাতে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। গাছ থেকে পড়ে যাওয়া ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। অথবা পাখি দ্বারা আঁচড় দেওয়া ফল খাওয়া এড়িয়ে চলুন। জ্বর হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।