এনকাউন্টার বলতে ওঁদের মনে পড়ে ক্রমাগত ভয়ংকর হাড় কাঁপানো বন্দুকের গুলির শব্দ, ঘরের বাইরে পরিবারের লোকদের আর্তনাদ, দৌড়ে পালানোর পায়ের আওয়াজ।
এক ঘন্টা পর যখন গুলির আওয়াজ থামল, রাতের আঁধারে দিনের আলোর মত পরিষ্কার করতে নিরাপত্তা বাহিনী প্যারা বম্ব ছুড়েছিল। কিন্তু তাতেও কেউ ঘরের বাইরে বেরোননি। পরদিন সকালে গ্রামের মানুষেরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে বাসাগুড়া থানায় যান। ছত্তিসগড়ের বিলাসপুর জেলার সরকেগুড়া থেকে থানার দূরত্ব ছিল তিন কিলোমিটার। তখন ১৬ জনের লাশ বস্তাবন্দি। সকালে আরও একজন মারা যাওয়ায় মৃতের সংখ্যা ১৭।
তার পর সাড়ে সাত বছর কেটে গিয়েছে। তখন কেন্দ্রে ছিল ইউপিএ সরকার আর রাজ্যে রমন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। দুই সরকারেরই দাবি ছিল এ ঘটনা রাজ্যের বৃহত্তম মাওবাদী এনকাউন্টার। কয়েকদিন আগে যে দাবিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে মধ্য প্রদেশ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভিকে আগরওয়ালের নেতৃত্বাধীন এক সদস্যের কমিশনের রিপোর্ট।
এনকাউন্টার: কে ফ্যাসিবাদী, কে নয়?
ওই রিপোর্টে কমিশন বলেছে, সেদিন গ্রামবাসীরা কোনও গুলি চালায়নি, তারা যে মাওবাদী ছিল তার কোনও প্রমাণ মেলেনি, গ্রামবাসীদের খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে মারা হয়েছে, নিরাপত্তাকর্মীরা ভয় পেয়ে গুলি চালিয়ে থাকতে পারে, এবং একজনকে গুলি করে মারা হয় সকালবেলা, এনকাউন্টারের ঘটনার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর। রিপোর্ট এখানেই শেষ নয়। বলা হয়েছে, ৬ জন নিরাপত্তাকর্মী গুলিযুদ্ধে ঘায়েল হয়েছেন বলে যে দাবি নিরাপত্তাকর্মীরা করেছেন, তা অসত্য বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ আঘাতের যে নথি দেওয়া হয়েছে, তা অসংগতিপূর্ণ এবং যদি সত্যিও হয়, তা একেবারেই বন্ধুত্বপূর্ণ গুলির আঘাত বলেই মনে হয়।
বিজাপুর জেলার অনেকটা অন্দরে সরকেগুড়া। রাজ্যের রাজধানী রায়পুর থেকে ৪৬৯ কিলোমিটার দূরে। জেলাসদর থেকে দূরত্ব ৫৩ কিলোমিটার। বিজাপুর অতিবাম অধ্যুষিত। গত সাত বছরে গ্রামের অনেক কিছুই বদলেছে। তখন বিজাপুর থেকে সরকেগুড়ার রাস্তা ছিল কাঁচা, এখন কালো পিচের থেকে পাথর আর ধুলো বেশি চোখে পড়ে।
তখন বাসের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। এখন যেমন আভাপল্লির রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে ঘরে ঘরে ডিশ অ্যান্টেনা চোখে পড়ে, তখন তার একটাও ছিল না। ক্ষেতও পাল্টেছে। গত কয়েকবছরে এলাকার মানুষ কালভার্ট বানিয়েছেন ক্ষেতে জলের জোগান দেবার জন্য। মাঠের মাঝে একটা বিদ্যুতের খুঁটিও বসেছে গত বছর।
একটা জিনিস বদলায়নি। পুলিশের গল্পের প্রতি নাক সিঁটকোনো ভাবটা এখনও একই রকম। পুলিশ বলেছিল, ২০১২ সালের ২৮ জুন সিআরপিএফ ও ছত্তিসগড় পুলিশ খবর পায় একদল সশস্ত্র মাওবাদী বিজাপুর জেলার সিলগের এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে।
খবর পেয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল সিলগের রওনা দেয়। এদের মধ্যে একটি দল ছিল ১৫ কিলোমিটার দূরের বাসাগুড়া থানার। সে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সিআরপিএফ ডিআইজি এ এলাঙ্গো। তাঁদর বয়ান এবং ঘটনার অব্যবহিত পরে করা এফআইআরের বয়ান মিলে গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, সরকেগুড়া, কোট্টাগুড়া এবং রাজপেন্টার মধ্যেকার জঙ্গলে তাঁরা কিছু সন্দেহজনক আওয়াজ শুনতে পান। নিরাপত্তাবাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী জঙ্গলের রাস্তা পেরোবার সময়ে তাঁরা চিৎকার শোনেন, "পুলিশ পুলিশ", "গুলি চালাও"। এর পরেই তাঁরা মাওবাদীদের গুলির নিশানায় পড়েন।
তদন্তকারীদের কাছে সিআরপিএফ ও পুলিশের আধিকারিকরা জানান "পাল্টা গুলি"তে ১৭ জন মারা যান ও ১০ জন আহত হন। এঁদের অনেকেই মাওবাদী বলে অভিযুক্ত বলে জানিয়েছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকেগুড়া, কোট্টাগুড়া এবং রাজপেন্টা তিনটি গ্রামই সরকেগুড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। সেদিন একটা সভা ডাকা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তাঁরা। তবে সে সভা কোনও মাওবাদী মিটিং নয়, বীজ পান্ডুম- এখানকার জনজাতিদের স্থানীয় উৎসব।
ওঁরা বলেছেন, তাঁদের কাছে কোনও অস্ত্র ছিল না, ওঁরা কেউ মাওবাদী নন। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, যে ১৬ জন রাতে মারা গিয়েছিলেন, তাঁরা ছাড়া আরেকজনকে সকালবেলা বাড়ি থেকে বের করে ঘটনাস্থলে টেনে নিয়ে গিয়ে গুলি করা হয়।
কমলা কাকা, সরকেগুড়ার বাসিন্দা। সে রাতের ঘটনার পর যাঁরা ন্যায়বিচারের জন্য সরব হয়ে ওঠেন, তাঁদের অন্যতম কমলা। "আপনি যদি এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন শুধু, কারোর সঙ্গে কথা বলতে হবে না, তাহলেই বুঝবেন পুলিশ মিথ্যে কথা বলছে। ওরা জজকে বলল এটা দুটো পাহাড়ের মধ্যে একটা বন। এই দেখুন ক্ষেত, এখানে চিরকাল ক্ষেত ছিল। গুলির সময়ে গরমকাল ছিল, তখন ফসলও ছিল না ক্ষেতে।"
যে এলাকাটাকে নিরাপত্তাবাহিনী জঙ্গল বলে বর্ণনা করেছিল, সেটা একটা হকি ফিল্ডের আয়তনের জায়গা। মোট ৬টা গাছ রয়েছে সেখানে। আগরওয়াল রিপোর্টে বলা হয়েছে, জেরার সময়ে এই ক্ষেতের জিপিএস কোঅর্ডিনেট দেখানো হয় ডিআইজি এস এলাঙ্গোকে। তিনি স্বীকার করেন, ওখানে কোনও জঙ্গল ছিল না, ছিল দুটো গ্রামের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা।
বস্তার এলাকার একটা ছোট্ট জায়গা সারকেগুড়া। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চিরপ্রাচীন বটে, কিন্তু একের পর এক ঘটনায় এ জায়গা আক্রান্তও হয়েছে। তার একটিও প্রাকৃতিক নয় অবশ্য। ২০০৫ সালের পর, রাষ্ট্র পোষিত সালওয়া জুড়ুম গোষ্ঠী মাওবাদীদের উৎখাত করার জন্য যখন একের পর এক গ্রাম ধ্বংস করে দিচ্ছিল, সে সময়ে সারকেগুড়ার বহু মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে তেলেঙ্গানায় পালিয়ে গিয়েছিলেন।
এনকাউন্টারে যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁদের একজন ইরপা নারায়ণ। তাঁর তুতোভাই মহেশ ইরপা বললেন, "আমরা নিজেদের ফসল নিজেরা চাষ করতাম। তারপর আমাদের কিচ্ছু রইল না। আমরা চলে গেলাম চেরলায় (তেলেঙ্গানার খাম্মাম জেলায়), সেখানে আমরা লংকা ক্ষেতে কাজ শুরু করি।"
২০১০ সালে নাগাদ হিমাংশু কুমারের বনবাসী চেতনা আশ্রম এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে গ্রামবাসীদের ফেলে আসা ঘরে ফিরিয়ে আনতে শুরু করেন। মহেশ বললেন, "সবে আমরা ফিরতে শুরু করেছিলাম, আবার বাড়ি তৈরি করছিলাম। যেখানে গুলি চলে, সেখানে আমরা চাষের কাজ শুরু করেছিলাম। ওই ঘটনার পর থকেে পুলিশ মাসের পর মাস নিত্য আমাদের গ্রামে আসত। আমরা মার খাওয়ার ভয়ে বাড়ির বাইরে বেরোতাম না, এমনকি গরু-ছাগল চরাতে বনেও যেতে পারতাম না।"
সময় সরকেগুড়ার বাসিন্দাদের কাছে শুশ্রূষাকারী ভূমিকা নিয়ে আসেনি।
রত্না মকরম এখন গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী। তিনি বলছিলেন নিজের ভাই রাম বিলাস মকরম আর কমলা কাকার ভাইপো রাহুল কাকার কথা। দুজনেরই বয়স তখন ছিল ১৫। "ওরা দুজনেই তখন বাসাগুড়ার সরকারি স্কুলে পড়ত। দুজনে ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরা সবসময়ে একসঙ্গে থাকত। দুজনেই খুব ভাল ছাত্র ছিল। রাহুল বলত ও ইঞ্জিনিয়ার হবে। রাম বিলাস কী হবে ঠিক করতে পারেনি, কিন্তু বলত সারা পৃথিবী ঘুরবে। আমরা বলতাম এত বড় স্বপ্ন না দেখতে। কিন্তু ওরা যখন বলত, তখন আমরাও ওদের সঙ্গে স্বপ্ন দেখে ফেলতাম।"
হায়দরাবাদের এনকাউন্টার ও পরিতোষের বুলেট
রত্নার পাশেই বসেছিসেন ইরপা রামা। পকটে হাত ঢুকিয়ে তিনি বের করে আনেন মেয়ের পাসপোর্ট সাইজের ফোটো। এ কয়েক বছরে সরকেগুড়া শিখে গিয়েছে ফোটো রেডি রাখতে হয়। রামা কথা বলেন ডোরলি ভাষায়, যে ভাষায় ডোরলি জনজাতির বেশিরভাগ মানুষই কথা বলেন। কিন্তু শেষ চারটে শব্দ ছিল হিন্দিতে। "উয়ো তো বচ্চি থি।" বাড়িতে তাকে সবাই ডাকত সরস্বতী বলে। তার বয়স ছিল ১২। এনকাউন্টারে যে ৬ জন নাবালক-নাবালিকার মৃত্যু ঘটেছিল তার মধ্যে সরস্বতীর বয়স ছিল সবচেয়ে কম।
২০১২ সালের সে রাত মৃত্যুর পদচিহ্নই শুধু রেখে যায়নি। যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের জীবনকেও ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে। এনকাউন্টারের সময়ে ইরপা অরুণের বয়স ছিল ১০। তার এখনও মনে আছে একটা চারপাইয়ের নিচে কেমন করে সে আর দুই ভাইয়ের সঙ্গে লুকিয়েছিল সে, জড়াজড়ি করে। দুই ভাইয়েরই বয়স ছিল ৫-এর নিচে। অরুণের বাড়ি ছিল ক্ষেতের সবচেয়ে কাছে। সব কথা ভাল করে মনে নেই। তবে মনে আছে বাবা সে রাতে বাড়ি ফিরছিলেন। আর মনে আছে গুলির শব্দ বন্ধ হবার পর ঘুম এসে গিয়েছিল।
এবং তার পরেও সকালবেলা আরেকবার গুলির শব্দের কথাও মনে আছে অরুণের। এবারের গুলি ছিল ইরপা রমেশকে। ইরপা অরুণের বাবা ইরপা রমেশ- শিকার নং ১৭। কমিশন জানিয়েছে ইরপা রমেশকে হত্যা করা হয় পরদিন সকালে।
গ্রামবাসীদের মনে আছে রমেশ উঁকি মেরে ক্ষেতের দিকে দেখছিলেন, তখনই তাঁকে বাড়ির মধ্যে থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হয় বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। এর পর অরুণকে দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিতেই হল, তার শৈশব বলে আর কিছু রইল না। তিন সন্তানের খাবার জোগাড় করতে না পেরে, বুকভরা বিষাদ নিয়ে তাদের মা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন।
অরুণের কথায়, "আমি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। আমার আর ভাইদের খাবার মত কিছু ছিল না। আমি ক্ষেতের কাজ শুরু করি। আমার দুই ভাই স্কুল যেত, ওদের জন্য আমাকে কাজ করতেই হত। আর কোনও উপায় ছিল না।"
কাকা চেন্টিও গোলাগুলির কাছেই ছিলেন। সেদিনের মিটিংয়ে ছিলেন তিনি। নিরাপত্তাবাহিনী গোটা মিটিং ঘিরে ফেলে গুলি চালাতে শুরু করলে, তিনি দৌড়তে শুরু করেন। একটা গাছের পিছনে প্রায় লুকিয়ে পড়েওছিলেন তিনি। কিন্তু ঠিক তার আগে বাঁ থাইয়ে একটা যন্ত্রণা- একটা গুলি তাঁর থাই এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল। তার পরের ঘটনা আর তাঁর খুব মনে নেই, শুধু যন্ত্রণা।
এরপর তাঁর মনে পড়ে অ্যাম্বুলেন্স, হেলিকপ্টার এবং ২৫ দিন ধরে রায়পুর হাসপাতালে চিকিৎসা। ২৬ তম দিনে তিনি পৌঁছন জগদলপুর জেলে। অভিযোগ তিনি মাওবাদী। অভিযোগ, নিরাপত্তাবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর। চেন্টি এর পর পাঁচ বছর জেলে কাটান। ২০১৭ সালে আদালত তাঁকে সমস্ত অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়। "আমার বয়স তখন ছিল ২০। এখন ২৮ বছর বয়স। পাঁচ বছর জেলে কাটিয়েছি। সে সময়টা আমাকে কে ফিরিয়ে দেবে?"
কোট্টাগুড়া গ্রামের বাইরে একটা ফাঁকা জায়গায় ওঁরা যখন নিজেদের কথা বলছিলেন, সে সময়ে সহসা ভিডিওর আওয়াজ। এ ভিডিওটা ওঁরা প্রায়ই দেখেন। এতে ওঁদের ক্রোধের কথা রয়েছে, রাষ্ট্র কীভাবে গ্রামবাসীদের প্রশমিত করার চেষ্টা চালিয়েছিল রয়েছে সে কথাও।
উন্নাও বুঝিয়ে দিল, এনকাউন্টার সমাধান নয়
ওই ভিডিওটা ঘটনার চারদিন পরের। কমলা কাকা গ্রামের একদল লোকের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের লোকজনের উদ্দেশে চিৎকার করছেন। ওঁরা এসেছিলেন রেশন নিয়ে।
কমলা যাঁদের উদ্দেশে চিৎকার করছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহকুমা পর্যায়ের এক ম্যাজিস্ট্রেটও। "তোমরা বলছ আমরা সবাই নকশাল। তোমরা নকশালদের রেশন দাও? ওদের (মৃতদের) মধ্যে একটা ১২ বছরের মেয়ে ছিল। ও কি ভাষণ দিচ্ছিল যে ওকে সবার আগে গুলি করলে? আমরা তোমাদের সাহায্য চাই না।"
তাঁর ক্রোধ যত বাড়তে থাকে, ততই বেশি সংখ্যক মহিলারা ভিডিওর পর্দা জুড়ে আসতে থাকেন, সামনে ঠেলে দিতে থাকেন নিজেদের সন্তানদের। তাঁরা অফিসারদের বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, বলতে থাকেন, "চাইলে ওদেরও মেরে ফেল।"
ভিডিওটা যখন চলছে, তখন কমলা হেসে ফেলেন। "কে চালাল এ ভিডিও? অনেক হয়েছে।" তারপর বলেন, "কিন্তু ওই রাগটার জন্যেই কমিশনের এই রিপোর্টটা।"
কমলা কাকার লড়াইটা ছিল দীর্ঘ, কষ্টকর। একবার বিচারবিভাগীয় কমিশন বসার পর গ্রামের লোকজনকের প্রথম জগদলপুর, তারপর রায়পুর এমনকি ভোপালেও যেতে হয় শুনানির জন্য। "প্রথমবার আমাদের সবাইকে জগদলপুর যেতে হয়েছিল, সবাই যেতেও চেয়েছিল। ফলে আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।"
"তারপর বেশি লোক আর যেতে পারত না। অতদূর যাওয়া মানা দিনের রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমি, রত্না মকরম আর রীতা কাকা (আরেক গ্রামবাসী) প্রায় সব শুনানির দিন যেতাম। ফিরে এসে সবাইকে বলতাম কী হল।"
কমলা তখন ছিলেন গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী। নার্সিং কোর্স শেষ করার পর এখন তাঁর পোস্টিং দান্তেওয়াড়া জেলার গিদামে। গ্রাম থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে। "কঠিন ছিল, কিন্তু হাল ছাড়িনি আমরা। আমার যখন কোর্স চলছিল, তখনও আমি শুনানিতে যেতাম। কমিশন আমাদের যাতায়াতের খরচ দিত, কিন্তু আমাদের অন্য খরচও করতে হত। আমি লোকাল বাজারে নিজের বালা বিক্রি করে দিয়েছিলাম।"
প্রথমবার ওঁরা যখন রায়পুরে গিয়েছিলেন কমিশনের সামনে হলফনামা দিতে, তখন ওঁদের কাগজপত্র নিতে অস্বীকার করা হয়। "ওরা বলেছিল আমাদের কাগজপত্রের ঠিক নেই। আমাদের উকিল বলেছিল যে আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি, অত ভিতরে এত কম সময়ে সব কাগজপত্র পাওয়া যায় না। কিন্তু ওরা শোনেনি। শেষে আমাদের উকিলরা সব কথা জজদের বলার পর ওঁরা বিষয়টা বোঝেন।"
গ্রামবাসীদের আইনজীবীদের একজন শালিনী ঘেরা। তিনি বললেন, "অনেক সমস্যা ছিল, কিন্তু নিরাপত্তাবাহিনী যখন ওদের সাক্ষী হাজির করল, যাদের অধিকাংশই আত্মসমর্পণকারী মাওবাদী, তখন ওরা প্রচুর অভিযোগ জানাতে শুরু করে। সেটা সামলানো যে কারোর পক্ষেই মুশকিল ছিল।"
কমলার আদালতের দিনগুলোর কথা স্পষ্ট মনে রয়েছে। যখন বারবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল যারা মারা গেছে তারা মাওবাদী কিনা তখন ওঁর সারা শরীরে রাগ পাক খেত। "আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম, কিন্তু তাতে আমার সরাসরি কথা বলতে সুবিধে হয়েছিল।"
ধর্ষণ, মৃত্যুদণ্ড, খাপ পঞ্চায়েত কালচার
"এর পর আমাকে সরাসরি কেউ হুমকি না দিলেও, স্থানীয় চেনা লোকজনের কাছ থেকে ফোন পেতে শুরু করি। ওরা আমাকে গ্রাম ছাড়তে বলত, এমনকি ছত্তিসগড় ছেড়ে চলে যেতে বলত, এখানে নাকি আমার প্রাণের ভয় রয়েছে। আমার বাবা-মা বলতেন, তুইও যদি মরে যাস কী হবে? কিন্তু আমরা লড়ে গেছি। এখন একজন জজ (আগরওয়াল) বলেছেন যেটা ঘটেছিল সেটা ভুয়ো সংঘর্ষ।"
এত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও যাঁরা ওঁদের সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার সীমা নেই সরকেগুড়া গ্রামের। কোন্টার অনেকবারের সিপিআই বিধায়ক মণীশ কুঞ্জম, সমাজকর্মী হিমাংশু কুমার, আইনজীবী যুগ চৌধুরির মত মানুষের কথা পরম মমতায় উচ্চারণ করেন ওঁরা। এই সাহায্যকারীরা সকলেই পুরুষ হলেও, ন্যায়ের জন্য এই লড়াইয়ের নেতৃত্বে থেকেছেন কিন্তু মেয়েরা- সে গ্রামে হোক কি গ্রামের বাইরে।
এমনকী রায় বেরোনের পরেও গ্রামে যাঁদের কথার মূল্য সবচেয়ে বেশি সেই তিনজনের নাম কমলা কাকা, রত্না মরকম এবং রীতা কাকা। ওঁরা যখন কথা বলেন, তখন সকলে শোনে। সেই ২০১২ সালের ভিডিওর মত।
কমলা বলছিলেন, "কেন জানি না, ন্যায়বিচারের লড়াই সবসময়ে মেয়েরা লড়ে। তার কারণ হয়ত আমরা সবাই মা। কিংবা আমরা কথা বলতে, লড়াই করতে কম ভয় পাই। আমাদের উকিলদের মধ্যে শালিনী ঘেরা, সুধা ভরদ্বাজ সবচেয়ে বেশি করেছেন।"
গত সাত বছরে রাষ্ট্রের উপর সারকেগুড়ার বিশ্বাস এতটুকুও বাড়েনি। বিদ্যুতের খুঁটি অথবা মোবাইল নেটওয়ার্ক দিয়ে কিছু এসে যায়নি।
তবু, এ সপ্তাহটা আগের চেয়ে একটু ভাল, কমলা বলছিলেন গ্রামের জনা পনের বাসিন্দাকে। "এ সপ্তাহে দেশের লোক জেনে গিয়েছে, ওরা মিথ্যে বলেছিল। জেনে গিয়েছে, এখানকার কেউ মাওবাদী নয়, এখানে কেউ গুলি চালায়নি। ভুলে গেলে চলবে না আমাদের।" ওঁদের মধ্যেই একজন বললেন, ওই জায়গাটায় ১৭ জন মৃতের স্মৃতিতে একটা ফলক বসানো হোক।
আরেকজন প্রস্তাব দিলেন, একটা ফলক হোক আরেকটা ফল-ফুলের বাগান হোক। jকমলা সম্মত হলেন। বললেন, "এতে সারকেগুড়ায় যারাই আসবে, তারাই সত্যিটা জেনে যাবে। আমরা সবাই মিলে টাকা জোগাড় করব, গ্রামের লোকজনকেও বলব সাহায্য করতে।"
একটা মৃদু আপত্তি উঠল এ প্রস্তাবে। যেখানে এনকাউন্টার ঘটেছিল, সে জমিটা ইরপা মহেশের। এখানে চাষ করতেন তিনি।
সবাই বলল, অন্য জায়গায় ওঁকে জমি দিয়ে দেওয়া হবে। উনি যে জমি দিয়েছেন, সে কথাও ফলকে লেখা থাকবে। মহেশ কিছু বললেন না বটে, কিন্তু মাথা নিচু করে রইলেন। জমি দেবার কারণে ওঁকে চিনে রাখা হবে- এ আশঙ্কার কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
কমলা কাকা বললেন, "আমরা এতদূর এসেছি কারণ আমরা সাহসী। সবাই যখন মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছে তখনও আমরা লড়েছি। আমাদের লড়াই শেষ হয়নি।"
যে ১৭ জন মারা গিয়েছিলেন:
কোট্টাগুড়া গ্রাম
১) সরস্বতী, ১২- কনিষ্ঠতম শিকার। কোনও নকশালপন্থার রেকর্ড নেই। বাবার নাম কাকা রামা। তিনি প্রান্তিক কৃষক, মূলত ধান ও তেঁতুল ফলান।
২) কাকা সামাইয়া, ৩৫-৪০- কোনও নকশাল রেকর্ড নেই। পরিবারে রয়েছেন চার সন্তান ও স্ত্রী কাকা নেগি। তাঁর বোন কাকা সরিতা এই অঞ্চলের প্রথম মেয়ে যিনি ক্লাস টুয়েলেভের বেশি পড়াশোনা করেছেন।
৩) কাকা নাগেশ ওরফে রাহুল (১৫)- পার্শ্ববর্তী বাসাগুড়ার আবাসিক স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র। এনকাউন্টারের পর সাংবাদিক সম্মেলনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম রাহুলকে গুরুত্বপূর্ণ নকশাল বলে উল্লেখ করেছিলেন। রাহুলের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছিল। ২০০৯ সালের ২৪ অক্টোবর তালপেরু নদীর কাছে সে নিরাপত্তাকর্মীকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় বলে জানিয়েছিল পুলিশ। দ্বিতীয় মামলা ছিল ২০১১-র ডিসেম্বরে। অভিযোগ নিকটবর্তী টিমাপুর গ্রামে পুলিশের একটি দলকে লক্ষ্য করে সে গুলি চালায়।
৪) মডকম রামবিলাস, ১৫- কোনও নকশাল রেকর্ড নেই। রাহুলের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ত। পরিবারের লোকের জানিয়েছেন, সে সবসময়ে ফার্সট ডিভিশন পেত, ইংরেজিতে ভাল ছিল
৫) মডকম দিলীপ, ২২- ক্লাস এইট অবধি পড়াশোনা। পুলিশ বলছে, ২০০৯ সালে ২৪ অক্টোবর তালপেরু নদীর কাছে পুলিশের একটি দলের উপর সে গুলি চালায়।
৬) ইরপা মুন্না, ২৩- কোনও নকশাল রেকর্ড নেই। তার বাবা ইরপা রাজু জানিয়েছেন, রাতে গুলি চালানোর সময়ে মুন্না একটা গাছে উঠে পড়েন। সকালে তিনি গাছ থেকে নেমে আসবার সময়ে তাঁকে গুলি করে মারে পুলিশ।
৭) মডকম সুরেশ, ৩৫- ২০০৭ সালে সালোয়া জুড়ুম আমলে হাজার হাজার জনজাতির মানুষদের সঙ্গে তাঁকে ও তাঁর মা শান্তাকে গ্রেফতার করা হয়। শান্তা পরে মুক্তি পান। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে দান্তেওয়াড়া জেলে ভেঙে যখন ২৯৮ জন বন্দি পালান, তখন পালিয়েছিলেন তিনিও। এর পর তিনি গ্রামে ফেরেন, বিয়ে করেন, তাঁর দুটি সন্তানও হয়। জেল ভাঙার মামলা ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে চারটি মামলা ছিল। একটি ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের, তিনটি ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসের। সবকটিতেই একই অভিযোগ- গুলি চালিয়ে পুলিশ খুনের চেষ্টা।
৮) মডকম নাগেশ, ৩২- গ্রামীণ উৎসবে ঢোল বাজাতেন। মডকম সুরেশ ও মডকম নাগেশ দুই ভাই। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশের উপর গুলি চালানোর অভিযোগ রয়েছে নাগেশের বিরুদ্ধে।
৯) ইরপা দীনেশ, ৩৫- পুলিশের খাতায় এঁর নাম ইরপা সোমুলু। গ্রামবাসীরা বলছেন ইরপা সোমুলু বলে গ্রামে কোনওদিন কেউ নেই। তিনি গ্রামে থাকতেন স্ত্রী ও তিন সন্তানের সঙ্গে। ছত্তিসগড় পুলিশ ও সিআরপিএফ দুজনেই বলছে এই ব্যক্তি একজন গুরুত্বপূর্ণ নকশাল। কিন্তু এনকাউন্টারের পর ছত্তিসগড় পুলিশ যে নকশালদের তালিকা বানিয়েছে, তাতে ওঁর নাম নেই।
সারকেগুড়া গ্রাম
১০) সারকে রামান্না, ২৫- কোনও নকশাল রেকর্ড নেই। প্রান্তিক কৃষক ছিলেন। পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী ও এক মেয়ে।
১১) মাডভি আয়ুতু, ৩৩- দুটি মামলা ছিল। ২০০৭ সালে এক এসপিও হত্যা এবং ২০১০ সালে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে লুঠপাট।
১২) কোরসে বিচাম, ১৮- বহু বছর আগেই পিতৃমাতৃহীন। ২০১১ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দুটি মামলা, দুটিই হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশদলের উপর হামলা।
১৩) ইরপা নারায়ণ (৪৫-৫০)- ২০১১ সালের ডিসেম্বরে পুলিশের একটি দলের উপর হামলায় অভিযুক্ত।
১৪) কুঞ্জম মাল্লা, ১৭- নকশাল রেকর্ড নেই
১৫) আপকা মিটঠু, ১৭- স্কুল ছুট, প্রান্তিক কৃষক
১৬) ইরপা ধর্মীয়া, ৪০- কোনও নকশাল রেকর্ড নেই
১৭) ইরপা সুরেশ, ১৮- পুলিশ যে সাতজন জখম ব্যক্তিকে নিজেদের সঙ্গে চিকিৎসা করানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিল তাদের একজন। সুরেশকে বিজাপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই মারা যান। কোনও নকশাল রেকর্ড নেই।