ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের বর্তমানে বিচার্য বিষয় হল কেন্দ্রের নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প। যার সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন আবেদন জমা পড়েছে। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারী বিজ্ঞাপিত এই প্রকল্প এমনই, যেখানে দেশের যে কেউ বেনামে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ দিতে পারে।
নির্বাচনী বন্ড কী?
২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় বাজেট অধিবেশনের সময় প্রথম এই বন্ডের ঘোষণা করা হয়েছিল। ‘নির্বাচনী বন্ড’ হল একটি আর্থিক বন্ড বা সুদমুক্ত ব্যাঙ্কিং। দেশের যে কোনও নাগরিক বা দেশে নিযুক্ত সংস্থা সেগুলি কেনার যোগ্য। এইসব বন্ড স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) নির্দিষ্ট শাখাগুলিতে ১,০০০ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন মূল্যে পাওয়া যায়। এর অর্থ রাজনৈতিক দলগুলির কাছে বেনামে অর্থ পৌঁছে যাওয়া। এই বন্ডগুলি কেওয়াইসির নিয়ম মেনে অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অনুমোদিত এসবিআই শাখা থেকে কেনা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলি এই সব বন্ড পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তা ভাঙাতে পারে। ওই অর্থ দিয়ে তাদের নির্বাচনী ব্যয় বহন করতে পারে। তবে, সারা বছর এগুলো কেনা যায় না। শুধুমাত্র জানুয়ারি, এপ্রিল, জুলাই এবং অক্টোবর মাসে ১০ দিনের জন্য এই সব বন্ড কেনার ছাড় দেওয়া হয়।
পাঁচ বছরে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি পেয়েছে 5,272 কোটি টাকা এবং কংগ্রেস 952 কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে। এমনই তথ্য জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস। এডিআর আরও জানিয়েছে যে বছরের পর বছর নির্বাচনী বন্ড আকারে জাতীয় দলগুলির অনুদানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। 2017-18 থেকে 2021-22 অর্থবছরের মধ্যে অনুদান 743 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
নির্বাচনী বন্ড-এর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়া আবেদনের শুনানি হয়। এই সময়, আদালত নির্বাচন কমিশনকে ২০১৯ সালের অন্তর্বর্তী আদেশের পর থেকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলির প্রাপ্ত অর্থের রেকর্ড সংরক্ষণ করতে বলেছে। ইতিমধ্যে ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত এডিআরের তথ্য সামনে এসেছে। যেখানে প্রকাশ করা হয়েছে যে 2021-22 অবধি, সমস্ত রাজনৈতিক দল মিলে নির্বাচনী বন্ড থেকে 9,188 কোটি টাকারও বেশি অনুদান পেয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হল ভারতীয় জনতা পার্টি ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে সর্বাধিক অনুদান পেয়েছে, যার পরিমাণ মোট অনুদানের 57 শতাংশ, অন্যদিকে কংগ্রেস এই পরিমাণের 10 শতাংশ অনুদান পেয়েছে।
এডিআর তথ্য অনুসারে, 2016-17 এবং 2021-22 এর মধ্যে, সাতটি জাতীয় দল এবং 24 টি আঞ্চলিক দল নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে মোট 9,188.35 কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে। এর মধ্যে বিজেপি পেয়েছে 5,272 কোটি টাকা এবং কংগ্রেস পেয়েছে 952 কোটি টাকা।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) আরও জানিয়েছে যে বছরের পর বছর নির্বাচনী বন্ড আকারে জাতীয় দলগুলিতে অনুদান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। 2017-18 এবং 2021-22 অর্থবছরের মধ্যে এর পরিমাণ 743 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে, আমরা যদি জাতীয় দলগুলির কর্পোরেট অনুদানের পরিসংখ্যান দেখি তবে তা বেড়েছে মাত্র 48 শতাংশ।
উল্লেখ্য, 2016-17 থেকে 2021-22 এর মধ্যে, সাতটি জাতীয় দল এবং 24টি আঞ্চলিক দল প্রায় 16,437 কোটি টাকার অনুদান পেয়েছে। এর মধ্যে 9,188.35 কোটি টাকা শুধুমাত্র নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে এসেছে। এই অনুদানের পরিমাণ ছিল মোট অনুদানের প্রায় 56 শতাংশ।
উল্লেখযোগ্যভাবে, নির্বাচনী বন্ড স্কিমটি 2017 সালে একটি আর্থিক বিলের মাধ্যমে চালু করা হয় এবং 2018 সাল থেকে তা প্রয়োগ করা হয়। রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই স্কিমটি চালু করা হয়েছে। এই স্কিমের বিধান অনুসারে, নির্বাচনী বন্ড ভারতের যে কোনও নাগরিক বা ভারতে প্রতিষ্ঠিত কোনও সংস্থা ক্রয় করতে পারে। একজন ব্যক্তি নির্বাচনী বন্ড ক্রয় করতে পারেন, এককভাবে বা অন্যদের সঙ্গে যৌথভাবে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) 1,000, 10,000 টাকা, 1 লক্ষ, 10 লক্ষ এবং 1 কোটি টাকা মূল্যের বন্ড ইস্যু করে৷
নভেম্বরে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হতেই স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অক্টোবরে মোট 1,148.38 কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি করেছে, যার সর্বোচ্চ পরিমাণ বিক্রি হয়েছে হায়দ্রাবাদ শাখায় (33 শতাংশ)। হায়দ্রাবাদের পরে শীর্ষে কলকাতা জোন। স্টেট ব্যাঙ্কের কলকাতা জোনে মোট নির্বাচনী বণ্ড বিক্রির অঙ্ক 255.28 কোটি টাকা। এরপর রয়েছে মুম্বই (177.90 কোটি টাকা)। মুম্বইয়ের পর রয়েছে দিল্লি (130.68 কোটি টাকা) এবং চেন্নাই (95.50 কোটি টাকা)।
রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে এই বন্ড চালু হলেও, তা নিয়ে অভিযোগ বিস্তর। বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, এই বন্ডের মাধ্যমে শাসক দলগুলোই বেশি পরিমাণে অর্থ পায়। যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দলগুলোর মধ্যে আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। পাশাপাশি, দলগুলোর তহবিলে আর্থিক অস্বচ্ছতাও বাড়িয়ে তোলে। যা নিয়েই আদালতের কাছে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে।