রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন ২০১৪ সালে তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কোনও দিন এনআরসি নিয়ে কথা বলেনি। বাস্তব অবশ্য সে কথা বলছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং বিজেপি কার্যকরী সভাপতি জেপি নাড্ডা সহ দলের মন্ত্রী নেতারা বার বার জনসমক্ষে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন সারা ভারতে এনআরসি চালু হবে। এসবের এক মাস পার হবার আগেই মোদীর মুখে শোনা গেল অন্য কথা।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বিজেপি তাদের ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেশের অন্য জায়গায়ও এনআরসি চালু করা হবে। "অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে" শিরোনামে ইস্তেহারে লেখা হয়েছিল "যেখানে যেখানে বেআইনি অভিবাসনের ফলে মানুষের জীবনযাত্রা ও রোজগার ব্যাহত হয়েছে, সেখানে দল এনআরসি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। ইস্তেহারে বলা হয়, ভবিষ্যতে আমরা দেশের অন্য জায়গাতেও ধাপে ধাপে এনআরসি লাগু করব।"
কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি শুক্রবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, "এনআরসি কেবল আসামেই লাগু। দেশের অন্যত্র এনআরসি-র পরিকল্পনা নেই। আপনারা ভূমিষ্ঠ না হওয়া শিশু নিয়ে কথা বলছেন।"
লোকসভা ভোটের সময়ে পশ্চিম বঙ্গে বেআইনি অভিবাসী ইস্যুতে সুর চড়িয়ে অমিত শাহ চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে হিন্দু ভোট জড়ো করতে।
# ১১ এপ্রিল দার্জিলিংয়ে এক জনসমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে অমিত শাহ বলেন, "আমরা আমাদের ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলে সারা দেশে এনআরসি লাগু হবে। বিজেপি প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে তাদের ছুড়ে ফেলে দেবার কাজ হাতে নেবে। কিন্তু সমস্ত হিন্দু ও বৌদ্ধ শরণার্থীদের চিহ্নিত করে তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।"
# ১ মে পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি ভোটসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে অমিত শাহ বলেন, ক্যাবের পর এনআরসি লাগু করা হবে। "প্রথমে আমরা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল লাগু করব এবং প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আসা সমস্ত উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করব। এর পর এনআরসি হবে এবং আমরা মাতৃভূমি থেকে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠাব।"
# বিজেপির সরকারি ওয়েবসাইটে গত ২৩ এপ্রিল একটি ইউটিউব ভিডিও আপলোড করা হয়। সেখানে অমিত শাহকে বলতে শোনা যাচ্ছে, "প্রথমে ক্যাব আসবে। সমস্ত শরণার্থীরা নাগরিকত্ব পাবেন। তার পর এনআরসি হবে। সে কারণেই শরণার্থীদের চিন্তিত হবার দরকার নেই, তবে অনুপ্রবেশকারীদের চিন্তিত হতে হবে। ব্যাপারটা পরপর বুঝুন- প্রথমে ক্যাব, তারপর এনআরসি। এনআরসি শুধু বাংলার জন্য নয়, গোটা দেশের জন্য।"
# এসবের আগে, ২০১৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নয়া দিল্লির ডক্টর আম্বেদকর ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে বিজেপির জাতীয় কার্যকরী সমিতির বৈঠকে অমিত শাহ বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "এনআরসি নিয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করা হবে এবং তাদের ভারত থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে।"
# এর কয়েকদিন পর ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীকে এনআরসি ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নিয়ে তাঁর অবস্থান নিশ্চিত করতে বলেন। এঁরা যে জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক সে কথা উল্লেখ করে অমিত শাহ এঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।
# স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবার পরেও আসামের বাইরে এনআরসি লাগু করার কথা বলতে থেকেছেন বিভিন্ন সময়ে।
# লোকসভায় ক্যাব নিয়ে বিতর্কের সময়ে গত ৯ ডিসেম্বর অমিত শাহ সুনির্দিষ্ট ভাবে বলেন, "সারা দেশে এনআরসি লাগু করা হবে। আমাদের এনআরসির প্রেক্ষিত তৈরি করবার প্রয়োজন নেই। আমরা সারা দেশে এনআরসি লাগু করব। একজন অনুপ্রবেশকারীকেও ছাড়া হবে না।"
# দুদিন পর রাজ্যসভায় বিতর্কের সময়ে তিনি এনআরসি প্রসঙ্গে নীরব ছিলেন। তবে ২১ নভেম্বর রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের জবাব দেবার সময়ে অমিত শাহ বলেন, "সারা দেশে এনআরসি লাগু করা হবে। যিনি যে ধর্মেরই হোক না কেন, চিন্তার কিছু নেই। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া যাতে সকলে এনআরসিভুক্ত হতে পারে।"
# অক্টোবর মাসে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ভোটে অমিত শাহ বারবার বিভিন্ন সভায় সারা ভারতে এনআরসি লাগুর কথা বলেন।
# ঝাড়খণ্ডের ভোটের প্রচার সময়ে তিনি কিছুটা স্বর নরম করেন। ২ ডিসেম্বর পশ্চিম সিংভূমে অমিত শাহ বলেন, "কংগ্রেস বলে ওরা এনআরসি লাগু করতে চায় না, অনুপ্রবেশকারী পাঠাবেন না। এনআরসি আমরা সারা ভারতে লাগু করব এবং প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে ২০২৪ সালের ভোটের আগে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেব।"
# ১৪ ডিসেম্বর ঝাড়খণ্ডের এক নির্বাচনী সভায় রাজনাথ সিং বলেন তারা দেশে এনআরসি অবশ্যম্ভাবী এবং সরকার এনআরসি লাগু করা থেকে পিছু হঠবে না। তিনি বলেন, "এনআরসি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সবাই মিলে বসে এ দেশের বেআইনি অভিবাসীদের ভবিষ্যৎ স্থির করব মানবিকতার সঙ্গে। অন্য দেশে তাঁদের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করা হয়, তেমন ভাবে নয়।"
# ১৯ ডিসেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভের মধ্যেই নাড্ডা বলেছিলেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন লাগু করা হবে এবং এনআরসি লাগু হবে। তিনি বলেন, "ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে এবং এগিয়ে যাবে। ক্যাব চালু হয়েছে, ফলে ভবিষ্যতে এনআরসি লাগু হবে।"
# ২০ জুন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সপ্তদশ লোকসভায় সাংসদদের উদ্দেশে প্রথম ভাষণে বলেন, "আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা বিশাল বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে । এর ফলে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, এবং জীবনযাপনের ব্যাপারে অত্যন্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। আমার সরকার স্থির করেছে সারা দেশের যেখানে যেখানে অনুপ্রবেশ সমস্যা রয়েছে, সেখানে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এনআরসি চালু করা হবে। অনুপ্রবেশ আটকাতে সীমান্ত পাহারা জোরদার করা হবে। রাষ্ট্রপতির ভাষণ সরকারি নীতিরই ঘোষণা বলে মান্য।"
একদিকে মোদী বলছেন দেশে কোনও ডিটেনশন সেন্টার নেই আর গত ১১ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন সমস্ত রাজ্যকে ডিটেনশন সেন্টার তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, "২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি সমস্ত রাজ্য সরকারকে মডেল ডিটেনশন সেন্টার তৈরির ব্যাপারে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। সরকার আসামের গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায় ডিটেনশন তৈরির জন্য ৪ কোটি ৬৫ লক্ষ ১২ হাজার ৫৬৩ টাকা মঞ্জুর করেছে সরকার।"