'মূল্যবান হীরা' নাকি অক্সিজেন! জীবনের জন্য কোনটি বেশি প্রয়োজন? করোনা মহামারী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, অক্সিজেন সংকটে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশের বকসওয়াহা 'হীরা খনির' বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি। আদিত্য বিড়লা গ্রুপের 'এসেল মাইনিং অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড' (ইএমআইএল) অধিগৃহীত হীরা খনির প্রকল্পের ফলে ২ লক্ষেরও বেশি গাছ কাটার পাশাপাশি বায়ু ও জল দূষণের 'ঝুঁকি'র সম্ভাবনা দেখা রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের বক্সওয়াহা অরণ্যকে বাঁচানোর আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্রতর হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রতিবাদ আন্দোলনের আঁচ পড়েছে।
ঐতিহ্যগত ভাবে এই অঞ্চলের মানুষজন কৃষিকাজের ওপরেই নির্ভরশীল। জেলায় একটিও বড় শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়নি, সরকারী রেকর্ড অনুসারে অঞ্চলটি অনুন্নত হিসাবে তালিকাভুক্ত। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অফিসিয়াল রেকর্ড অনুসন্ধান করে জেনেছে হীরা প্রকল্পের জন্য এই অঞ্চলের মোট ২ লক্ষ ১৫ হাজার ৮৭৫ টি গাছ কাটা দরকার। বকসওয়াহা বন একটি সংরক্ষিত এলাকা এবং এই সিদ্ধান্ত পুরো বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলের 'ইকো-সিস্টেমকে' প্রভাবিত করতে পারে বলেই আশঙ্কা। পাশাপাশি এই অঞ্চলে রয়েছে জলের সংকট। ভূগর্ভস্থ জলের স্তর অনেক নিচে রয়েছে।
এই খনি প্রকল্পের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৫.৯ মিলিয়ন ঘনমিটার জলের প্রয়োজন হবে। দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এই রাজ্যে সর্বাধিক সংখ্যক বনাঞ্চল রয়েছে। EMILসম্পূর্ণ যান্ত্রিক 'ওপেনকাস্ট মাইন' স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে৷ প্রায় ২৫০০কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চলেছে সংস্থাটি। সংস্থাটির দাবি, এই প্রকল্প শুরু হলে এটি এশিয়ার বৃহত্তম হীরার খনি হয়ে উঠতে পারে এই অঞ্চল। পাশপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান।
ডেকান হেরাল্ডের রিপোর্ট অনুসারে, রাজ্য সরকার হীরা খনির জন্য ৬২.৬৪ হেক্টর বনাঞ্চলকে চিহ্নিত করেছে। কোম্পানি দাবি করছে ৩৮৩ হেক্টর জমি জুড়ে হবে এই প্রকল্প। বক্সওয়াল একটি সংরক্ষিত বন। যদি কোন প্রকল্প ৪০ হেক্টরের বেশি হয় তবে কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। বন বিভাগের ভূমি ব্যবস্থাপনার অতিরিক্ত প্রধান বন সংরক্ষক সুনীল আগরওয়াল জানিয়েছেন যে প্রকল্পটি কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে কিন্তু অনুমোদন পাওয়া যায়নি।
প্রকল্পে স্থগিতাদেশের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয়। ২০২১ সালের জুনে, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল (এনজিটি) 'পরিবেশগত অনুমোদন' না আসা পর্যন্ত গাছ কাটার উপর একটি অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করেছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, সুপ্রিম কোর্ট পিটিশনকারীদের মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টে আবেদন করতে বলে। ২০২২ সালের অক্টোবরে,হাইকোর্ট প্রকল্পের উপর স্থগিতাদেশ দেয়।গত বছরের মার্চে, সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে, পরিবেশ মন্ত্রক বলেছিল যে ২০২০-২০২১ সালে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রায় ৩১ লক্ষ গাছ কাটা হয়েছে।
আবেদনে বলা হয়েছে এই প্রকল্পটি বুদেলখণ্ডের ইকো-সিস্টেমকে পুরোপুরি ধ্বংস করবে। পাশাপাশি বনের উপর নির্ভরশীল হাজার হাজার আদিবাসীদের জীবন-জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আবেদনে আরও বলা হয়, ইতিমধ্যেই এই এলাকায় প্রচুর জলের সংকট রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণভাবে, বক্সওয়াহের লোকেরা তাদের গাছ বাঁচাতে চায় কারণ তারা সেই বনে থাকে। এই বনগুলি বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে, যেখানে জলের অভাব রয়েছে। হীরার খনি নিয়ে পরিবেশগত বিতর্ক অনিবার্য, খনির এলাকা ঘিরে থাকা ১৫টি গ্রামের এই প্রকল্পের বিরোধিতাকারী কর্মী অমিত ভাটনাগর বলেছেন। এসব গ্রামের মোট জনসংখ্যা প্রায় আট হাজার।
বিজাওয়ার সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট (এসডিএম) রাহুল সিলাদিয়া বলেছেন, এই অঞ্চলে একটি সক্রিয় বনায়ন অভিযান চালানো হবে। উল্লেখযোগ্যভাবে, বক্সওয়াহায় ১৫ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে গাছ কাটার প্রস্তাব করা হয়েছে। রাহুল সিলাদিয়া আরও বলেন, হীরা খনির জন্য গাছ কাটা এবং নতুন গাছ লাগানো একই সঙ্গে করা হবে। এই এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এলাকার সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হবে এলাকার বাসিন্দাদের।
বীরেন্দ্র কুমার রিও টিন্টোর নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে এর আগে কর্মরত ছিলেন তিনি বলেন, “রিও টিন্টো সংস্থা এর আগে এই গ্রামগুলো থেকে ৩৬০ জন কর্মী নিয়োগ করেছে। সংস্থা যখন সেখান থেকে চলে যায় আমাদের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। তিন লাখ টাকা পেয়েছি। কিন্তু আমরা নতুন কোম্পানি সম্পর্কে কিছুই জানি না, সংস্থার তরফে কেউই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। স্থানীয় বাসিন্দা গণেশ প্রতাপ যাদব বলেন, “নতুন মাইনিং কোম্পানির উচিত আমাদের আরও ভালো শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা দেওয়া,”।
মধ্যপ্রদেশের বক্সওয়াহা রিসার্ভ ফরেস্ট-এ মাটির নিচে প্রায় সাড়ে তিন কোটি ক্যারেট হীরার মজুদ রয়েছে বলে খবর। এর আনুমানিক ব্যয় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। হীরা উত্তোলনের জন্য প্রায় আড়াই লাখ গাছ কাটা পড়বে। এই খনির অনুমতি বাতিলের জন্য আবেদন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বক্সওয়াহা সংরক্ষিত বনের ৩৮৪ হেক্টর এলাকা নিয়ে এবং সাগোরিয়া গ্রামের কাছে অবস্থিত। প্রকল্পটি জেলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে এবং রাজধানী ভোপাল থেকে ২৬০ কিলোমিটার দূরে।
বিড়লা গ্রুপের এক্সেল মাইনিং ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানিকে হীরা খনির জন্য ছাতারপুর জেলার বকসওয়াহা জঙ্গলের ৫০ বছরের ইজারা দেওয়া হয়েছে। এর আয়তন প্রায় ৩৮২.১৩ হেক্টর। কাটা হবে বনের প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার সবুজ গাছ-গাছালি। এত বিশাল সবুজের ওপর বিপদ ডেকে আনায় পরিবেশপ্রেমীরা ও তাদের সংগঠনগুলো আন্দোলন শুরু করেছে, বিক্ষোভও চলছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, 'মধ্যপ্রদেশ সরকার' এই বনাঞ্চলটি নিলাম করে। সরকার এই বনাঞ্চলটিকে ৫০ বছরের জন্য লিজে দেয়। তবে, আগামী পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ ও বন বিভাগের প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিতে হবে সংস্থাটিকে। এই অনুমোদনের কারণে বিষয়টি আটকে আছে, কারণ এখানকার স্থানীয় লোকজন বন কাটার বিরোধিতা করছেন। এটি বুন্দেলখণ্ডের সেই এলাকা, যেখানে ইতিমধ্যেই জলের অভাব রয়েছে। যদিও 'ডায়মন্ড প্রকল্পে' জলের ব্যবহার অনেক বেশি। ফলে এই অবস্থায় ওই এলাকায় জলের সংকটও বাড়তে পারে।
যদিও কোম্পানি ও সরকার বলছে, এসব গাছ একবারে কাটা হবে না, বরং ১২টি ধাপে কেটে তার জায়গায় ১০ লাখ 'গাছ লাগানো' হবে। এই বনাঞ্চলে অনেক ধরনের প্রয়োজনীয় গাছ রয়েছে। সেগুন, বাবলা, পিপল, অর্জুন সহ অনেক বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে এখানে। এসব গাছ ও সেগুলো থেকে প্রাপ্ত 'কাঠই' এখানকার মানুষের জীবন- জীবিকা নির্ধারণ করে। প্রায় ১৭টি গ্রাম এই প্রকল্পের ফলে প্রভাবিত হবে!বকসওয়াহ বনে রয়েছে ৩ কোটি ৪২ লাখ ক্যারেটের বেশি হীরা।
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ 'যন্ত্রণায়' কাতরাতে কাতরাতে মারা গেছেন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে 'হীরা প্রকল্পটি বেশি প্রয়োজনীয় নাকি অক্সিজেন'। একটি সাধারণ গাছ চারজনকে অক্সিজেন দেয়। একটি পিপল গাছ ২৪ ঘণ্টায় ৬০০ কেজি অক্সিজেন দেয়। আর এই বনেই রয়েছে সেই বিরল প্রজাতির পিপল গাছ।