যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ইউক্রেন। নিহত বহু। পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন একাধিক। এখনও জারি রুশ আগ্রাসন। প্রতিনিয়ত জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে জীবন, আশ্রয় ও হাজার হাজার ইউক্রেনীয়র স্বপ্ন। কিন্তু, এই যুদ্ধই যেন কিয়েভের বাসিন্দা আনা হোরোডেটস্কার প্রেম থেকে পরিণয়ে অনুঘটকের কাজ করল।
ইউক্রেনের আনা হোরোডেটস্কা ও দিল্লির আইনজীবী অনুভব ভাসিনের প্রথম দেখা বছর তিনেক আগে। ২০১৯ সালে কিয়েভের বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত আনা ভারতে এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। সেই সময়ই তাঁদের দু'জনের দেখা হয়। হয়েছিল মোবাইল নম্বর বিনিময়। এরপর মাঝে মধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপে কথা হত দু'জনের। এর এক বছরের মধ্যেই আনা আবারও ইউক্রেনে আসেন। রোড ট্রিপে যান রাজস্থানে। এরপরই ভারতে লকডাউনের ঘোষণা হয়। সেই পুরো সময়টাই ইউক্রেনীয় ওই যুবতীকে সহায়তা করেছিলেন অনুভব। এরপর ২০২১-য়ের ফেব্রুয়ারিতে দুবাইতে ফের দেখা হয় এই দুই যবক, যুবতীর। গতবার ডিসেম্বরে আবার ভারতে এসেছিলেন আনা হোরোডেটস্কা। গিয়েছিলেন অনুভবের বাড়িতেও।
ক্রমেই বেড়েছে অনুভব-আনার ঘনিষ্ঠতা। যা অনুভব করেছিলেন তরুণ আইনজীবীর মা। তাই কাল বিলম্ব করেননি তিনি। সেই সময়ই বিদেশিনী আনাকে ঘরের লক্ষ্ণী হয়ে আসার প্রস্তাব দেন অনুভবের মা। যদিও সেই অর্থে ওই সময়ে এই প্রস্তাবে কেউই সাড়া দেয়নি। তবে, এই দোস্তী যে নিছক বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি তা উভয়ই উপলব্ধি করছিলেন।
তবে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনে আনা-অনুভবের প্রেম কাহিনী অন্য মোড় নেয়। সেই সময় কিয়েভে ছিলেন আনা। আগ্রাসন বাড়তেই বাড়ি ছাড়তে হয় তাঁর পরিবারকে। বাড়ি ছাড়েন বছর ৩০-র আনা হোরোডেটস্কারও। বিদেশে জীবন-যুদ্ধে যখন ব্যস্ত আনা, তখন বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছিলেন দিল্লির অনুভব। পুতিনের দেশের আগ্রাসন যত বেড়েছে, বান্ধবীর কথা ভেবে ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল অনুভবের চিন্তা। শেষ পর্যন্ত আনাকে বাঙ্কারে যেতে জোড়াজুড়ি করেন তরুণ আইনজীবী।
প্রথমে আনা বাঙ্কারে আশ্রয় গ্রহণে রাজি ছিলেন না। তবে, অনুভবের কথায় রাজি হয়ে যান। সঙ্গে তাঁকে আনা জানান, 'তুমি অপেক্ষা কর, আমি ভারতে আসছি খুব তাড়াতাড়ি।' কথা মতই কাজ করেছেন ইউক্রেনীয় এই তরুণী। তবে, অনুভবই আনার এ দেশে আসার ভিসা জোগাড়ে সাহায্য করেছিলেন। গত ১৭ মার্চ দিল্লিতে পৌঁছেছেন আনা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ থেকে ভারতে আসায় কিছুটা বিস্মিতই ছিলেন অনুভব। যদিও আনাকেও পাল্টা চমকে দিয়েছিলেন তিনি।
ইন্দিরা গান্ধী বিমান বন্দরেই আনাকে স্বাগত রীতিমত ঢাক বাজিয়ে স্বাগত জানানো হয়। এরপরের ছবিটা রীতিমত তাক লাগানো। আনা নিজেই দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেনযে, 'দীর্ঘ যাত্রায় আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম এবং আশা করিনি যে সে এমন করবে। হঠাৎ দেখি অনুভব হাঁটু মুড়ে বসে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আমি ভাবতেও পারিনি। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরতেই হ্যাঁ বলেছি। আমি ওকে বলেছিলাম যে, ওর সঙ্গে থাকার জন্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ থেকে পালিয়ে এসেছি।' আনা অনুভবের মায়ের সঙ্গেও দেখা করেছে। ভাবী পুত্রবধূকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি। যা মন ছুঁয়েছে ইউক্রেনীয় তরুণীর।
এই প্রেম কাহিনী অবশ্য শুধু অনুভবের মা-ই নন, বুঝেছিলেন আনার ঠাকুমাও। তাই আগেভাগেই নাতনিকে বিয়ের উপহারস্বরূপ একটি কফি মেকার দিয়েছেন বৃদ্ধা। সেটা এ দেশে আসার সময় এনেছেন আনা। যা দেখে অবাক অনুভব।
স্থির হয়েছে, আগামী ২৭ এপ্রিল আনা-অনুভবের চার হাত রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী এক হবে। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে হবে বিয়ে।
এতকিছুর মধ্যেও অবশ্য মন খারপ ইউক্রেনীয় তরুণীর। না, দেশের জন্য নয়। মন খারাপের কারণ তাঁর প্রিয় পোষ্যের জন্য। যুদ্ধ কবে শেষ হবে তার প্রহর গুনছে সে। সব স্বাভাবিকের পথে গেলেই কিয়েভ ফিরবেন আনা। বর্তমানে ঠাকুমার কাছে থাকা কুকুর বায়োকে ভারতে নিয়ে আসবেন।
আনা যুদ্ধ দেখেছেন। হারে হারে উপলব্ধি করেছেন স্বপ্নভঙ্গের। একাধিকবার এসেছেন এ দেশে। অুনুভব করেছেন আথিথেওতা। যা তাঁর হৃদয়স্পর্শ করেছে। খুঁজে পেয়েছেন মনের মানুষ। তাই আর ভারত ছেড়ে ফিরতে চান না আনা হোরোডেটস্কা। এ দেশকে আপন করেই থাকতে চান সারা জীবন।
Read in English