Advertisment

নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিক্ষোভস্থলে তৈরি হয়ে উঠছে অতি জরুরি অস্থায়ী লাইব্রেরি

কলকাতার মূল বিক্ষোভ মঞ্চ পার্ক সার্কাস ময়দানে গত দু সপ্তাহ ধরে এ ধরনের লাইব্রেরি কাম রিডিং রুম চলছে। খিদিরপুরের নবাব আলি পার্কে এক সপ্তাহ আগে এ ধরনের লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Protest Library

ছবি সূত্র- সুশান্ত সিং

আট সপ্তাহ হয়ে গেল দেশের নয়া নাগরিকত্ব আইন ও প্রস্তাবিত এনআরসি নিয়ে অজস্র জায়গায় বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। এই আন্দোলনগুলির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এই আন্দোলনগুলি যেখানেই ঘটেছে, সেখানে প্রায় সর্বত্রই পাবলিক লাইব্রেরি ও রিডিং রুম বিস্তার লাভ করছে। ভারতে এ ধরনের ঘটনা প্রথম হলেও, দুনিয়ার যেখানেই অকুপাই আন্দোলন হচ্ছে, সেখানে পাবলিক লাইব্রেরি অন্যতম ভূমিকা নিচ্ছে।

Advertisment

২০১১ সালে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট বিক্ষোভের সময়ে নিউ ইয়র্কের জুকোটি পার্কে একটি লাইব্রেরি তৈরি হয়, যেমনটা তৈরি হয়েছে বিশ্বের  অন্য জায়গার অকুপাই আন্দোলনেও। হংকংয়ের গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের বিক্ষোভকারীরা গ্রন্থাগার তৈরি করেছেন, মাদ্রিদের প্লাজা ডেল সোল বিক্ষোভে এবং তুর্কির গেজি পার্ক বিক্ষোভেও তেমনটা দেখা গিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে এ ধরনের আন্দোলনে গ্রন্থাগার তৈরি হয়ে উঠেছে দিল্লি, নাগপুর, কলকাতা, সিরার, আরারিয়া এবং কানপুরে।

গত ১৫ ডিসেম্বর দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর জাকির হুসেন লাইব্রেরিতে পুলিশের হানার পর প্রথম এ ধরনের পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ফুটপাথে দুই বর্তমান ছাত্র আনজার রাহি ও জিশান রামিজ রিড ফর রেভলিউশন (বিপ্লবের জন্য পড়াশোনা) নামের লাইব্রেরি শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন প্রাক্তনী মহম্মদ সাহিল। রাহির কথায়, "আইডিয়াটা এল যখন লাইব্রেরি পুলিশ তছনছ করে দিল। দেশভাগের সময়ে গণ্ডগোল যখন হচ্ছিল, তাখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ও শুরু হয়েছিল। আমরা তত বড় কিছু না করতে পারলেও একটা লাইব্রেরি তো শুরু করতেই পারি।"

লাইব্রেরি তো হেঁসেল বা হাসপাতাল নয়, যে বিক্ষোভের সময়ে অতীব জরুরি পুলিশের টার্গেট হয়ে উঠবে, কিন্তু বিক্ষোভকারীরা লাইব্রেরি শুরু করার দিকেই জোর দিচ্ছেন। কেন এমনটা ঘটছে! এর উত্তর দিয়েছেন নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিক জিনিপ টুফেকি, তাঁর ২০১৭ সালের বই Twitter and Tear Gas: The Power and Fragility of Networked Protest-এ। "জনগণ যখন পুরনো প্রতিষ্ঠান ও ভোটের রাজনীতির প্রতি তীব্র অনাস্থা থেকে বিক্ষোভ করেন, যেমনটা আজকাল প্রায়শই ঘটছে, তখন অংশগ্রহণকারী ও কর্তৃত্ববিরোধী উপায়গুলিকে সংগঠিত করা কোনও পরবর্তী ভাবনার বিষয় থাকে না। তার বদলে, বিক্ষোভকারীরা যে পরিবেশ প্রায় সর্বত্র সৃষ্টি করছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ মূল্যবান হয়ে উঠছে। এই দিক থেকে দেখলে কাঁদানে গ্যাসের মধ্যে লাইব্রেরি তৈরি করার গুরুত্ব যথেষ্ট। লাইব্রেরি মানে এক ধরনের মূল্যবোধ যার সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের মূল্যবোধের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।"

লেখক নীলাঞ্জনা রায়ের কথায়, "বিক্ষোভের মূল কথা হল সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ভালো থাকা, আর গ্রন্থাগারের মূল কথা হল বইয়ের দেওয়া ক্ষমতায়ন। এর শুরু সাংবিধানিক বিক্ষোভ থেকে, সাধারণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে, বই বা বিক্ষোভ-গ্রন্থাগার মানুষের কাছে কিছু ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়।"

সুরেখা পিল্লাই, জনসংযোগ পেশাদার। তিনি বেসরকারি ভাবে লাইব্রেরিকে নিয়মিত সাহায্য দিচ্ছেন। তিনি বলেন, "যদি পুলিশের চোখে পাঠরত ছাত্রছাত্রীরা শঙ্কার বিষয় হয়ে ওঠে, বিক্ষোভের এলাকা যদি জ্ঞানবুভুক্ষু মানুষে ভরে ওঠে, যাদের হাতিয়ার বই, তাহলে তা হবে যথার্থ প্রত্যুত্তর। আমি দেখেছি লোকজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে।" রাহি বলছিলেন, "অরুন্ধতী রায় এসে আমাদের ২১টি নিজের লেখা বই উপহার দিয়ে গিয়েছেন। অন্য স্কলার ও লেখকরাও এসেছেন, ফোন করেছেন, বই পাঠিয়েছেন।" জামিয়ার রাস্তার উপরের লাইব্রেরি ২০০০-এর বেশি বই পেয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ এই লাইব্রেরিতে রাখা হয়েছে এবং বাকি বই দেশের এ ধরনের অন্য লাইব্রেরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাহির কথায় এই লাইব্রেরি থেকে প্রেরণা পেয়ে সারা দেশে ১৮টি এ ধরনের লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে।

কলকাতার মূল বিক্ষোভ মঞ্চ পার্ক সার্কাস ময়দানে গত দু সপ্তাহ ধরে এ ধরনের লাইব্রেরি কাম রিডিং রুম চলছে। খিদিরপুরের নবাব আলি পার্কে এক সপ্তাহ আগে এ ধরনের লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে। পার্ক সার্কাসে এ ধরনের লাইব্রেরির কথা প্রথম ভেবেছিলেন পিয়াজ মহম্মদ, তিনি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, "এক মাসের বেশি হয়ে গেল বিক্ষোভ চলছে, আমাদের মতন লোকেরা প্রান্তিকই রয়ে গিয়েছেন। রিডিং রুমের মত কিছু হলে আমরা বৌদ্ধিক স্তরে মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারব।"

দিল্লিতে শাহিন বাগের কাছে বাস স্টপেজের লাইব্রেরি সব চেয়ে বিখ্যাত হলেও গান্ধী পার্কের হউজ রানিতে যে লাইব্রেরি, তাতে ছোট-বড় সবার আকর্ষণ। রবিবার দুপুরে ছোটরা জড়ো হয়, ছোটদের বই পড়ে। ডেটা অ্যানালিস্ট প্রিয়াঙ্কা এখানে স্বেচ্ছাসেবক। "আমরা শাহিনবাগের বিক্ষোভ শুরুর তিনদিন পর লাইব্রেরি শুরু করি। বাচ্চা-বড় সকলেই লাইব্রেররি ব্যবহার করেন। দুটো থেকে তিনটের মধ্যে ড্রয়িং হয়, ৩টে থেকে পাঁচটা রিডিং সেশন। বাচ্চাদের পরীক্ষা এসে গেছে, আমরা টিউশন দেবার কথাও ভাবছি।"

শাহিন বাগের লাইব্রেরিতে কেবলমাত্র মহিলারাই বই নিতে পারেন, পুরুষেরা রিডিং রুনে বসে পড়তে পারেন। রিডিং রুম সর্বদাই ভরা থাকে, কখনও মানুষ দিনের তীব্র আলোয় পড়েন, কখনও ঝোলানো বিদ্যুতের বাতিতে। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় সংবিধান পাঠ করেন তাঁরা, অথবা পড়েন ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়াজের কবিতা, বা রামচন্দ্র গুহের গান্ধী উত্তর ভারত (২০০৭)। তবে এখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে, সাংবাদিক রবীশ কুমারের লেখা বোলনা হি হ্যায় (২০১৯)।

বিক্ষোভ শেষ হয়ে গেলে এ লাইব্রেরিগুলির কী হবে! অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটে ৫০০০-এর বেশি বই, সংবাদপত্র, পত্রপত্রিকা ছিল। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উচ্ছেদের সময়ে সব নষ্ট করে দেয়। রাহির আশা তাঁর লাইব্রেরির ভবিষ্যৎ কিছুটা উজ্জ্বল হবে। নীলাঞ্জনা রায় বলেন, "যাঁরা তৎক্ষণিক ভাবে লাইব্রেরি বানিয়েছিলেন, তাঁরা এখন বিক্ষোভস্থলের বাইরে স্থায়ী গ্রন্থাগারের কথা ভাবছেন, এটা খুবই ভাল লক্ষণ।"

protest caa
Advertisment