১৯৭৯ সালে শুরু হয়েছিল আসামের বিদেশি খেদা আন্দোলন। চলেছিল ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। সে আন্দোলনে গোড়া থেকেই ছিলেন প্রদীপ বরদলৈ। ৪০ বছর পর, এনআরসি তালিকায় তাঁর নাম নেই। এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হবে ৩১ জুলাই। গত বছর এনআরসি-র যে চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল তাতে বাদ পড়েছিল ৪০ লক্ষ নাম। এই জুনে আরেকটি যে তালিকা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আরও ১ লক্ষ ২ হাজার ৪৬২ জনের নাম বাদ পড়েছে।
বরদলৈয়ের পরিবার অবশ্য বাদ পড়েছে প্রথম খসড়া থেকেই। সে খসড়া তালিকা প্রকাশ পেয়েছিল গত বছর ৩১ ডিসেম্বরের মাঝরাতে।
৬২ বছর বয়সী প্রদীপ বরদলৈ মরিগাঁও জেলার চারাইবাহিতে তাঁর নিজের বাড়িতে বসে বলছিলেন, "আমি গোটা জীবন আসাম আন্দোলনের জন্য উৎসর্গ করেছি। আমাকে এমনকী এক সপ্তাহের জন্য জেলা কারাগারেও রাখা হয়েছিল। আমরা স্বচ্ছ এনআরসি-র জন্য লড়ে গেছি- দুর্ভাগ্যজনক যে আমি একাই ভুগছি!"
৬ বছরের আসাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল অল আসাম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আসু)। সে আন্দোলনেরই ফসল ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি। সেই চুক্তি অনুসারে আইনিভাবে আসামের ভারতীয় নাগরিকদের জন্য কাট অফ তারিখ হল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। এনআরসি তালিকায় কোনও ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি এই তারিখটির উপরেই নির্ভরশীল।
বরদলৈ এবং তাঁর স্ত্রী পিঙ্কুমণি (৪৬) ও ২২ এবং ২৪ বছরের দুই সন্তান, সকলেই প্রথম খসড়ায় নিদের নাম না দেখে হতভম্ব। প্রদীপ বরদলৈ বলছিলেন, "আমি যখন এনআরসি সেবা কেন্দ্রে গিয়েছিলাম, ওঁরা আমাকে বলেছিলেন আমাদের সব নথি ঠিকঠাক রয়েছে, চিন্তার কোনও কারণ নেই। এই নিশ্চয়তাটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট ছিল।"
আরও পড়ুন, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কী ভাবে কাজ করে
এনআরসি-র খসড়া প্রকাশিত হয় ৩০ জুলাই ২০১৮য়। সে তালিকায় নামহীন প্রদীপ বরদলৈ তার পর থেকেই সপরিবারে সর্বত্র ছুটে বেড়াচ্ছেন, জানতে চাইছেন তাঁদের বাদ পড়ার কারণটা ঠিক কী! অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী প্রদীপকে সকলেই বলেছেন, সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ঠিকঠাক কাগজপত্র পেলেই। গোটা ব্যাপারটাই তাঁর পক্ষে বড্ড বেশি টেকনিক্যাল বলে অভিযোগ তাঁর।
আমি এনআরসি-র জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলাম- নিজে করতে পারি না, এলাকার সাইবার কাফে থেকে করিয়েছিলাম। সম্ভবত সেখানেই কিছু গড়বড় হয়েছে।
প্রদীপের স্ত্রী পিঙ্কুমণি ভয় পাচ্ছেন তাঁদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। "ও বলছে, যদি একদন সেনা অফিসারকে ডিটেনশনে পাঠানো হয়, তাহলে যে কাউকেই পাঠানো হতে পারে। সবাই- আমি নিজেও একটা স্বচ্ছ এনআরসি চাই, কিন্ত এ যে ভাবে চলছে তা একেবারে চূড়ান্ত গাফিলতি।"
২০১৮ সালের জুলাই মাসে চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর, যাঁদের নাম বাদ পড়েছিল তাঁদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়। বরদলৈয়ের ছেলে ও মেয়ে থাকেন দিল্লি ও বেঙ্গালুরুতে। ফর্ম ফিলআপ করার পর দুবার তাঁদের গুয়াহাটি আসতে হয়। প্রথমবার শুনানির জন্য, দ্বিতীয়বার বায়োমেট্রিকসের জন্য। প্রদীপ বরদলৈ চাকরি করতেন নগাঁও পেপার মিলে। ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে মিল বন্ধ। তিনি বলছিলেন, "৪০ হাজার টাকা খরচ করেছি আমি টিকিটের পিছনে।"
প্রদীপ বরদলৈেয়ের বাবা কামেশ্বর বরদলৈ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে আসাম সরকারের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রদীপ বলছিলেন, "সমাজসেবা আর দেশপ্রেম আমাদের রক্তে বইছে। সত্যি বলতে কী, আমার বাব চরাইবাহির একমাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।" তাঁর এখন আশা ৩১ জুলাইয়ের তালিকায় তাঁর পরিবারের নাম থাকবে।
কিন্তু যদি চূড়ান্ত এনআরসিতেও আমাদের নাম না থাকে? "আমি, যে মানুষটা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিস বিদেশি হঠানোর আন্দোলনে শামিল হয়েছি, সেই আমাকে কি বিদেশিদের ট্রাইবুনাল বিচারকের সামনে আমার ভারতীয়ত্ব প্রমাণের জন্য আবেদন করতে হবে?" প্রশ্ন করছেন প্রদীপ বরদলৈ।
Read the Full Story in English