Advertisment

'ভারত আমাদের গ্রহণ না করলে গুলি করে দিক', বললেন আসামের সাবিত্রী দাস

আসামে নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে একাধিক 'ডাউটফুল' অর্থাৎ 'ডি'-ভোটার নোটিশ পেয়েছেন তালিকা থেকে বাদ যাওয়া অনেকেই। এই প্রতিবেদনে রইল তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
nrc assam

ফাইল ছবি

আসামের কাটিরাইল গ্রামের বাসিন্দা, ৬০ বছর বয়সী মালতীবালা দাসের দৈনন্দিন জীবনে লড়াই ছাড়া কিছু নেই। দুটি কিডনিই ক্ষতিগ্রস্ত, প্রতিস্থাপনের আশু প্রয়োজন, এই অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ছোটাছুটি করে চলেছেন তিনি। কারণ? আসাম সরকারের তরফে তিন তিনটি নোটিশ এসেছে তাঁর নামে, অভিযোগ, তিনি 'ডাউটফুল', অর্থাৎ 'ডি' ভোটার। আসামে ডি ভোটার তাঁরাই, যাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা বা বিতর্ক রয়েছে।

Advertisment

মালতীবালার উকিল কাজল চন্দ জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে প্রথম নোটিশ পান তিনি, এবং ২০১৯ সালে দু'টি। তাঁর উকিলের আরও বক্তব্য, ট্রাইব্যুনাল আদালতে সরকারি কৌঁসুলির অভাব থাকার ফলে আটকে রয়েছে আইনি প্রক্রিয়া।

"ওঁর কাছে সমস্ত নথি আছে, ১৯৬৪ সালে ওঁর বাবার পাওয়া উদ্বাস্তু সার্টিফিকেট সমেত, যা থেকে ওঁর ভারতীয় পরিচয় প্রমাণিত হয়। ১৯৯৭ থেকে নিয়মিত ভোট দিয়েছেন উনি, কিন্তু সরকারি কৌঁসুলির অভাবে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়ে চলেছে। আমরা আদালতের কাছে মালতীবালার জন্য যৌথ বিচার প্রক্রিয়ার আবেদন জানিয়েছি," বলেন চন্দ।

আরও পড়ুন: নাগরিকপঞ্জি: হিন্দু না ওরা মুসলিম…

বর্তমানে ১০০টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে আসামে, এবং আরও ২০০টি চালু করার প্রক্রিয়া চলছে। নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই ট্রাইব্যুনালগুলিই শেষ কথা, এবং এদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে ভারতীয় নাগরিকত্ব যাঁরা প্রমাণ করতে পারবেন না, তাঁদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর। কিন্তু এই আদালতগুলির বিরুদ্ধে ভ্রান্ত বিচার প্রক্রিয়ার অভিযোগ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তাঁর লড়াইয়ে মালতীবালা পাশে পেয়েছেন শিলচরের সাংসদ তথা মহিলা কংগ্রেস নেত্রী সুস্মিতা দেবকে, যিনি সোমবার দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকায় বিভিন্ন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শন করেন।

"রাজনীতি ছাড়ুন, জনগণের জন্য, এবং জনগণের দ্বারা, গঠিত সরকারের মানবিকতার কথাটা তো ভাবা উচিত। ওঁর (মালতীবালার) পক্ষে দুটো ক্ষতিগ্রস্ত কিডনি নিয়ে চলাফেরা করাই কঠিন, কিন্তু বাড়ি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে হয় তাঁকে," সরকারের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করে বলেছেন সুস্মিতা।

পরিকাঠামোর অভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া সমস্ত মানুষের আবেদনের শুনানি নির্ধারিত ১২০ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ করা অত্যন্ত কঠিন হবে। উল্লেখ্য, গত ৩১ অগাস্ট প্রকাশিত চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়েছেন ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন, যেখানে মোট আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৩.৩ কোটি। "বাস্তব হলো এই যে, বর্তমানে যেসব ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, সেগুলির একটি বড় অংশ চলছে কোনোরকম সরকারি কৌঁসুলি, বেঞ্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, টাইপিস্ট, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কর্মী ছাড়াই," বলছেন সুস্মিতা।

আরও পড়ুন: আসামের ডিটেনশন ক্যাম্পেই প্রাণ হারালেন ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ বৃদ্ধ

এছাড়াও তাঁর বক্তব্য, এনআরসি প্রক্রিয়া চলাকালীনই অনেকে দারিদ্র এবং আত্মহত্যার পথে চলতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু এনআরসি-পরবর্তী সময়কাল আরও দুঃসহ হতে চলেছে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর কথায়, "আমি শিলচরের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে কেমন কাজ হচ্ছে, তা নিজের চোখে দেখব বলে গিয়েছিলাম। যে ১৯ লক্ষ মানুষ এনআরসি থেকে বাদ গেছেন, তাঁরা কিন্তু গভীর সঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছেন।"

অন্যদিকে, ট্রাইব্যুনালের আধিকারিকরা বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব এবং অভিযুক্তদের হয়রানির দায় চাপাচ্ছেন উকিলদের ওপর। এক আধিকারিক বলেন, "বহু ক্ষেত্রেই উকিলরা অভিযুক্তদের পক্ষে অত্যন্ত দুর্বল যুক্তি দিচ্ছেন। যেহেতু আমরা কোনও পক্ষের হয়ে মামলা সাজিয়ে দিতে পারব না, আমরা তাঁদের তারিখ দিতে থাকি।"

বলা বাহুল্য, মালতীবালা একা নন। রিকশাচালক ভক্ত দাস (৬০) প্রথমবার সরকারি নোটিশ পান ২০০৯ সালে, কিন্তু ২০১১-য় তাঁকে ভারতীয় নাগরিক ঘোষিত করে এক ট্রাইব্যুনাল আদালত। কিন্তু ফের তাঁর নামে ডি-ভোটার নোটিশ আসে ২০১৭ সালে। অতএব একবার নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সত্ত্বেও ফের কোর্টে কোর্টে ঘুরতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর স্ত্রী সুমিতা দাস (৫৫) নোটিশ পান ২০১৭ সালে, এবং তাঁর বিচারপর্ব চলছে শিলচরের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল কোর্ট-৪ এ। তিতিবিরক্ত ভক্ত দাস স্থির করেছেন, গৌহাটি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন তিনি, তাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত পুঁজি এতে নিঃশেষ হয়ে যাবে জেনেও।

আরও পড়ুন: পদ্ম মোকাবিলায় এনআরসিছুট হিন্দুরাই ‘অস্ত্র’ জোড়াফুলের!

"ওঁর যা আর্থিক অবস্থা, তাতে ওঁর পক্ষে হাইকোর্টে যাওয়া একটা অসম্ভব কঠিন ব্যাপার। ওঁদের কাছে সমস্তরকম পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনাল কোর্ট এভাবে ওঁদের হেনস্থা করছে," বলছেন ভক্তের উকিল তন্ময় পুরকায়স্থ।

সাত বছর আগে ডি-ভোটার নোটিশ পেয়ে আত্মহত্যা করেন কাছাড় জেলার অর্জুন নমশূদ্র। কিন্তু সেই বিপদের ছায়া ফিরে এসেছে তাঁর পরিবারের কাছে। চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি তালিকায় তাঁর মা, স্ত্রী, এবং সন্তানদের নাম থাকলেও, নাম নেই তাঁর শাশুড়ি সাবিত্রী বিশ্বাসের, যাঁর কাছে ডি-ভোটার নোটিশ আসে ২০১৭ সালে। "যদি সরকার আমাদের বিশ্বাস না করে, এই দেশ যদি আমাদের গ্রহণ না করে, তবে আমাদের গুলি করে দিক, এই ক্রমাগত অপমানের হাত থেকে রেহাই দিক। মনে হয় ওরা যেন চায় না যে আমরা আমাদের পরিচয়ের প্রমাণ দিই," বলেন সাবিত্রী।

Assam nrc
Advertisment