"দিন দুই-তিন আগেই নাম রেজিস্টার করিয়েছিলাম (বাড়ি ফেরার বিশেষ ট্রেনের জন্য), কিন্তু ডাক পড়ল না। 'ঘর পর ভি কাম থা, তো কেয়া করতে, নিকল গয়ে (বাড়িতেও কাজ ছিল, কী করব, তাই বেরিয়ে পড়লাম)'," বলছেন ২৫ বছরের শিবভান সিং।
এই কারণেই দেশব্যাপী লকডাউনের আবহে দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করার পর, ২০ জনের একটি দল সিদ্ধান্ত নেন, মহারাষ্ট্রের জালনায় ইস্পাত কারখানায় তাঁদের কর্মক্ষেত্র থেকে ৮৫০ কিমি দূরে মধ্যপ্রদেশের উমরিয়া এবং শাহদোল জেলার বাড়িতে হেঁটেই ফিরবেন। সেই দলের যে চারজন বেঁচে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন শিবভান। বাকি ১৬ জনকে ঔরঙ্গাবাদ জেলায় শুক্রবার ভোররাতে পিষে দিয়ে চলে যায় একটি খালি মালগাড়ি।
দেশের আরও হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের মতোই বাড়ি ফিরতে মরিয়া ছিলেন এই দলের সদস্যরাও। শিবভান বলছেন, "ঠিকাদার আমাদের আটকে রাখার চেষ্টা করছিল, বলছিল কিছুদিনের মধ্যেই কারখানা খুলবে, কিন্তু আমার গ্রামের কাঁচা বাড়ি মেরামত করা খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। আমাকে ফিরতেই হতো।"
ঠিকাদারকে বুঝিয়েশুনিয়ে ছাড়পত্র আদায় করে, ঝুলিতে কিছু রুটি আর চাটনি বেঁধে নিয়ে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ রওনা দেন শিবভান এবং তাঁর দল। ভেতর ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে প্রায় ৪০ কিমি হাঁটার পর বদনাপুর নামে এক জায়গায় তাঁরা রেললাইন দেখতে পেয়ে ঠিক করেন, তার ওপরেই ঘুমোবেন, যেহেতু তাঁরা নিশ্চিত জানতেন, কোনও ট্রেন চলাচল করছে না।
ঘটনায় জীবিত রয়েছেন যাঁরা, এবং আধিকারিকরাও, বলছেন যে দলটির লক্ষ্য ছিল দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৩৫০ কিমি দূরের গঞ্জ শহর ভুসাবল, যেখানে মধ্যপ্রদেশের বাস পেয়ে যাবেন বলে বিশ্বাস ছিল তাঁদের। যেখানে মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটে, সেখান থেকে মাত্র ২৫ কিমি দূরেই ঔরঙ্গাবাদ শহর, যে শহর থেকে শুক্রবার সন্ধ্যায় মধ্যপ্রদেশগামী একটি ট্রেন ছাড়ারও কথা ছিল, কিন্তু দলের সদস্যরা তা জানতেন না।
রাত বাড়তে থাকায় ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে তাঁরা ঠিক করেন, বাকি রাতটা একটু ঘুমিয়ে নেবেন। তাঁর দুই সঙ্গী বীরেন্দ্র সিং এবং ইন্দালালের সঙ্গে মূল দলের চেয়ে ২০০ মিটার মতো পিছিয়ে ছিলেন শিবভান। এই তিনজন ঘুমোচ্ছিলেন লাইনের ঠিক পাশের খোলা জায়গায়। বাকি ১৭ জন শুয়েছিলেন লাইনের ওপরেই।
রেল আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, লাইনে মাথা রেখে স্লিপার-এর ওপরেই সম্ভবত ঘুমিয়ে ছিলেন ১৪ জন, এবং আরও তিনজন ছিলেন লাইনের খুব কাছে। তাঁদের ধারণা, দলের সবাই এই বিশ্বাসে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে লাইনে শুয়ে থাকলেও কোনও বিপদ নেই, যেহেতু লকডাউনে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ বলেই জানতেন তাঁরা। "আমরা সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু যে যার মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল কোথায় শুয়েছে," বলছেন শিবভান।
অন্যদিকে হায়দরাবাদের চেরালাপল্লী থেকে মহারাষ্ট্রের মনমড়ে পানিওয়াড়া গামী ট্রেনের চালক রামাশিস কুমার বদনাপুর এবং করমাড় স্টেশনের মাঝামাঝি টের পান, লাইনের ওপর কোনোরকম বিঘ্ন রয়েছে, জানাচ্ছেন রেল আধিকারিকরা। কিন্তু কী সেই "বিঘ্ন", তা রামাশিস যতক্ষণে বুঝতে পারেন, ততক্ষণে লাইনে শোয়া শিবভানের সঙ্গীসাথীদের থেকে আর মাত্র ১৬০ মিটার দূরে ট্রেন।
নান্দেড়ের ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার উপেন্দ্র সিং বলেন, রেললাইনের ওপর মানুষ শুয়ে রয়েছে বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে ইমারজেন্সি ব্রেক কষেন রামাশিস, এবং সজোরে ট্রেনের হুটার বাজিয়ে সতর্ক করতে চান নিদ্রিতদের। সিং আরও বলেন, "৭০ কিমি গতিতে ছুটছিল ট্রেন।" যতক্ষণে অবশেষে থামল, ততক্ষণে সব শেষ।
দল থেকে কিছুটা দূরে থাকা ইন্দালাল, শিবভান, এবং বীরেন্দ্রর ঘুম ভাঙে রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করা ট্রেনের বাঁশিতে। "ভালো করে ঘুম ভাঙার আগেই সব শেষ হয়ে গেল," বলেন ইন্দালাল।
লাইনের ওপর শুয়ে থাকা ১৪ জনকে পিষে দিয়ে যায় ট্রেনটি। মারাত্মক জখম হন লাইনের ঠিক পাশে শুয়ে থাকা দুজন, পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁদের। লাইনের পাশে শুয়ে থাকা তৃতীয় ব্যক্তি সজন সিং কোনোমতে লাফ দিয়ে সরে গিয়ে প্রাণ বাঁচান, তবে ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে যায় তাঁর মালপত্র বোঝাই ব্যাগ। আপাতত হাঁটুতে এবং পিঠে চোট লেগেছে তাঁর।
ট্রেনের মরিয়া হুটার শুনে ঘুম ভেঙে যায় নিকটবর্তী সাতনা গ্রামের বাসিন্দাদের, যাঁরা মুহূর্তের মধ্যে ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। ওদিকে রেলওয়ে কন্ট্রোল রুমে খবর দেন রামাশিস।
মৃত এবং আহতদের ঔরঙ্গাবাদের সিভিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় যত দ্রুত সম্ভব। মৃতদের ময়নাতদন্তের পাশাপাশি করমাড় থানায় দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর রিপোর্ট দায়ের করা হয়। কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি দ্বারা এই ঘটনার তদন্ত হবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় রেল।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গণেশ গাওড়ে বলেছেন ১৬ জন মৃতের দেহ সমেত ঘটনায় জীবিত দুজনকে মধ্যপ্রদেশ ফেরত পাঠানো হবে। "বাকি দুজনের মধ্যে সজন সিং এখনও হাসপাতালে, ওঁর সঙ্গে বীরেন্দ্র থেকে যাচ্ছেন," বলেন তিনি।
এদিকে শিবভান যদিও বলেছেন যে বিশেষ ট্রেনে সফর করার জন্য নিজেদের নাম নথিভুক্ত করিয়েছিলেন তাঁরা, মধ্যপ্রদেশের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব আইসিপি কেশরি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান যে মধ্যপ্রদেশ অথবা মহারাষ্ট্র, কোনও রাজ্যেই বিশেষ ট্রেনের জন্য নাম লেখান নি ওই শ্রমিকরা। তাঁর বক্তব্য, ঠিকাদারের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের পর বাড়িমুখো রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দলের সদস্যরা। কেশরি আরও জানান, কর্তৃপক্ষের কাছে ওই শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করতে দেন নি সেই ঠিকাদার।
শুক্রবার জালনা থেকে ১৭০ জন শ্রমিককে নিয়ে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালে পৌঁছয় একটি ট্রেন, এবং শুক্রবার রাতে জালনা থেকে ৭০ জন শ্রমিককে নিয়ে ছাড়ে আরও একটি ট্রেন। তবে এই দুটির কোনোটির কথাই সম্ভবত জানতেন না শিবভান ও তাঁর সঙ্গীরা। এখন ট্রেনের সিল করা কামরায় ১৬টি দেহ ফিরবে জবলপুর, যেখান থেকে দেহগুলি নিয়ে যাওয়া হবে শাহদোল এবং উমরিয়া জেলায়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন