লেখক, কোভিড হিরো, উদ্যোক্তা….! জালিয়াত সঞ্জয় রাইয়ের কাহিনী চমকে দেবে। ইতিমধ্যেই পিএমও অথবা প্রধানমন্ত্রী দফতরের পরিচয় দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের STF-এর হাতে ধরা পড়েন জালিয়াত সঞ্জয় রাই।
এর মাঝেই সামনে এসেছে এক বিস্ফোরক তথ্য, তদন্তে উঠে এসেছে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহাকে ভোটপ্রচারের জন্য ২৫ লক্ষ টাকা ‘ধার’ দিয়েছিলেন তিনি। এর পাশাপাশি গত বছরের ডিসেম্বরে, কেন্দ্রীয় মৎস্য, পশুপালন ও দুগ্ধজাত মন্ত্রক সঞ্জয় রাইয়ের সংস্থা যুব গ্রামীণ উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশনকে (YREF) ২ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। সেই সঙ্গে ডালমিয়া ফ্যামিলি ট্রাস্ট সহ আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সঞ্জয় রাইয়ের ফাউন্ডেশনে বিপূল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে।
জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের গাজিপুর লোকসভা আসনে নির্বাচিত হন, তিনি ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) প্রার্থী আফজাল আনসারির কাছে পরাজিত হন। এরপর জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর তাঁকে ২০২০ সালের আগস্টে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।
মনোজ সিনহা, ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ সালে গাজিপুর থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরেও তিনি তার লোকসভা এলাকায় রাজনৈতিকভাবে বেশ সক্রিয় ছিলেন। ২৫ লক্ষ টাকা ভোটের কাজে ‘ধার’ প্রসঙ্গে মনোজ সিনহার এক ঘনিষ্ঠ সূত্র দাবি করেছে যে ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে রাইয়ের সঙ্গে মনোজ সিনহার কোন যোগাযোগ নেই।
গাজিপুর জেলা বিজেপির সভাপতি ভানুপ্রতাপ সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ ধৃত সঞ্জয় রাইয়ের সঙ্গে দলের কোন যোগ নেই, তিনি বিজেপির সদস্যও ছিলেন না”। বারাণসীর এক বিশিষ্ট বিজেপি নেতা, যিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন, ” সঞ্জয় রাই দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। যখনই তিনি এখানে আসতেন, দলের নেতারা নিয়মিত তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন।”
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতের সঙ্গে একাধিক ছবি রয়েছে তার সোশ্যাল মিডিয়ায়। ‘দিব্যদর্শী মোদী’ নামের একটি বইও লিখেছেন। বিভিন্ন ধর্মগুরুদের সঙ্গেও দেখা যাচ্ছে তাকে। বিজেপি প্রধান জেপি নাড্ডা, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর সহ বহু বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে সঞ্জয় রাইয়ের ছবি প্রকাশ পেতেই আসরে নেমেছে বিরোধী দলগুলি।
পুলিশ সূত্রে খবর ২৫ এপ্রিল গাজিপুরের বাসিন্দা সঞ্জয় রাই ওরফে সঞ্জয় শেরপুরিয়াকে কানপুর স্টেশন থেকে গ্রেফতার করে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের টাস্ক ফোর্স। STF-এর ডিজি শচীন কুমার জানিয়েছেন রাইয়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির 420, 467, 468 এবং 471 ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে এবং তথ্য প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, 2008-এর 66D-এর অধীনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সূত্রের খবর কেবল উত্তরপ্রদেশ নয় দিল্লি ও গুজরাট সহ একাধিক রাজ্য থেকে পিএমও নাম ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকা আদায় করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপির মামলাও রয়েছে। পুলিশি জেরায় রাই শিল্পপতি গৌরব ডালমিয়ার নাম সামনে এনেছেন বলেই খবর। রাইয়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা এফআইআর অনুসারে, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি আর্থিক অনিয়মের একটি মামলায় ডালমিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত করছিল। মামলা তুলে নিতে রাইকে এই বিপূল পরিমাণ টাকা দিয়েছিলেন তিনি।
এছাড়াও রাইয়ের কাছ থেকে দুটি ভিন্ন ঠিকানা সহ আধার কার্ড এবং অন্যান্য আইডি কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। যার একটির ঠিকানা মধ্য দিল্লিতে এবং অন্যটি গুরগাঁওয়ের। এসটিএফ বলেছে যে অভিযুক্ত দাবি করেছেন যে তিনি লোকেদের বিভিন্ন আইডি কার্ড দিয়ে প্রতারণা করতেন যাতে তার আসল পরিচয় সামনে না আসে।
তার সোশ্যাল মিডিয়া পেজগুলিতে তিনি নিজেকে একজন সামাজিক উদ্যোক্তা বলে দাবি করেছেন। এর পাশাপাশি গত কয়েক বছরে হাফ ডজন বইও তিনি প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি জানা গিয়েছে এই সব বই প্রকাশ করেছে দিল্লির প্রভাত প্রকাশনী। তিনি দিব্যদর্শী মোদি নামে একটি বইও লিখেছেন। যা ইতিমধ্যেই আলোচনায় এসেছে। প্রভাত প্রকাশনী থেকে ইতিমধ্যেই আরএসএস নেতাদের লেখা বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছে। প্রকাশনীর কর্ণধার প্রভাত কুমার জানিয়েছেন, এক বিশ্বস্ত সূত্রে তিনি সেখানে বইগুলি প্রকাশ করতে আসেন। সঞ্জয় তাদের জানিয়েছিলেন, তিনি উদ্বাস্তু হিন্দু কল্যানে কাজ করছেন। এর মধ্যে দুটি বই RSS প্রধান মোহন ভাগবত প্রকাশ করেছিলেন। গুজরাটে, যেখানে তিনি বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছেন, তিনি ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে একটি ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন।
গাজীপুরে, করোনা অতিমারী চলাকালীন তিনি 'লাকদি ব্যাংক' নামে এক সংস্থা খোলেন, যা কোভিডে মৃতদের দাহ করার সুবিধার্থে কোভিড আক্রান্তদের পরিবারকে কাঠ সরবরাহের কাজে যুক্ত ছিল। মহামারী চলাকালীন তিনি অক্সিজেন সিলিন্ডার, মাস্ক এবং ওষুধও বিতরণ করেছিলেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও জানা গিয়েছে তিনি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (SBI), ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্র, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ হায়দ্রাবাদ এবং IDBI ব্যাঙ্ক থেকে সংস্থার নামে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেন। সেই পরিমান প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপির মামলাও সামনে এসেছে।