ইতিহাসের বহু ঘটনা, বহু বিবাদের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে বুধবার অর্থাৎ ৫ অগাস্ট। সুপ্রিম নির্দেশের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে বুধবার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন রামমন্দিরের। আর সেই উপলক্ষেই সেজে উঠছে অযোধ্যা। থাকছে না ধর্মীয় ভেদাভেদের কোনও চিত্র। বরং ইকবাল আনসারি এবং গায়ত্রী দেবীদের একসঙ্গে নিয়েই শুরু করতে চলেছে বহু প্রতীক্ষিত এই আনন্দোৎসব।
এ যেন এক ভিন্ন ভূমি। চতুর্দিকে সাজসাজ রব। রাস্তার দু'ধারে রঙিন ফেস্টুন, বাড়ির ছাদে গেরুয়া রঙের পতাকা, পথের ধারে পাঁচিলে আঁকা রাম-রামায়ণের গল্প। ভেঙে পড়া পাঁচিলে পড়েছে উৎসবের প্রলেপ। এই উৎসবের মূল কেন্দ্রবিন্দু অবশ্যই নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে তৈরি রামজন্মভূমি। জানা গিয়েছে মোদীর যাত্রাপথ জুড়ে বাজান হবে রাম-নাম সংকীর্তন।
ধর্ম থেকে রাজনীতি, ইতিহাস জানায় এক সময় বিরোধের আরেক নামই ছিল অযোধ্যা। বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে রামলালার মন্দির তৈরির সময় পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দেখেছে ভারত। কিন্তু সেই সময় আর আজ কিন্তু এক নয়।যদিও অযোধ্যার অন্দরে তা কোনওদিন ছিলই না। সুপ্রিম কোর্টে যখন এই বিতর্কিত জমি নিয়ে মামলা চলছিল, তখন চোখ আটকেছিল অযোধ্যারই একটি পাড়ায়। দুই পড়শি, নাসিফা এবং কমলেশদেবী। নাসিফার বাড়িতে রান্নার গ্যাসের খোঁজ নিতে আসা কমলেশদেবীর চেহারায় নেই বিতর্কের ছিটেফোঁটা রেশ। নাসিফা বললেন, “এঁরা আমাদের কাছে আত্মীয়তুল্য। আমরা একে ওপরের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাই, এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়াও করি। ভয়ের যদি কোনও কারণ থাকে তবে তা বাইরে থেকে যারা আসবে তাঁরাই তৈরি করবে।”
সেটাই তো হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। অযোধ্যার কালো ইতিহাস। বাবরি মসজিদ ভাঙছেন করসেবকরা। চতুর্দিকে অশান্তির আগুন। সেই সময় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন রমেশ পান্ডে। রাস্তার এক পাশ থেকে উদ্ধার হয়েছিল সেই দেহ। গুলিবিদ্ধ স্বামীর দেহ দেখে শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে ছিলেন গায়ত্রী দেবী। পাশে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট চার সন্তান। আজ ভূমিপুজোর আমন্ত্রণ পত্র এসেছে তাঁর কাছে। ঠিক করলেন তিনি যাবেন। গায়ত্রী দেবী বলেন, "আমার মনে হয় আমার যাওয়া উচিত। আমি সেখানে উপস্থিত থাকলে আমার স্বামীর আত্মা শান্তি পাবে। কী কঠিন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছিলাম তখন। হাতে একদম টাকা ছিল না। কোনওরকমে সংসার চালিয়েছিলাম ওঁর মৃত্যুর পর। একটাই দুঃখ যেটার জন্য এত লড়াই করেছিল সেই দিন, আজ তা দেখে যেতে পারলেন না উনি।"
এদিকে, সম্প্রতি দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশের পরও মুসলিমদের কবরস্থানের উপর কেন মন্দির নির্মাণ হবে তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল ঠিকই কিন্তু নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতির এই ছবি কিন্তু বদলাইনি আজও। তাই ৫৩ বছরের ইকবাল আনসারির কাছে যখন রামমন্দির ট্রাস্টের তরফে ভূমিপুজোয় উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ পত্র আসল, উজ্জ্বল হয়ে উঠল দুটি চোখ। আজ আর পুরোনো স্মৃতি মনে রাখতে চান না ইকবাল। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে জানালেন তিনি যাবেন এই উৎসবে। সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন ধর্মের আসল তত্ত্ব। ইকবাল বলেন, "আমি কেন যাব না? প্রধানমন্ত্রী আসবেন সেখানে। অবশ্যই যাব। অতীত ভুলে যেতে চাই। যা হয়ে গিয়েছে তাকে মনে রাখতে চাই না। সুপ্রিম কোর্ট যা নির্দেশ দিয়েছে আমরা সবাই সেটা মেনে নিয়েছি। এখন এগিয়ে চলার সময়। হিন্দু মুসলিম এখানে কেউ আলাদা নয়, কোনওদিন ছিলও না। আমরা সবাই এক। আমরা আগেও একসঙ্গে ছিলাম। তাই যতই ভেদাভেদের পাঁচিল তোলার চেষ্টা হোক, আমরা তা সফল হতে দেব না।"
অতীত ক্ষত ভুলতে চান ইকবাল-গায়ত্রী দেবীরা। বাবা হারানো, স্বামী হারানো যন্ত্রণা ভুলেই এক অপরের পাশে দাঁড়াতে চায় অযোধ্যা। মহোৎসবের এই মরসুমে রাম জন্মভূমির ভাঙা পাঁচিলে আজ তাই পড়ছে ঐক্যের প্রলেপ।
Read the story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন