হর্ষ শ্রীবাস্তব এবং সরফরাজ আলি। দুজনের মধ্যে মিল অনেক। দুজনেই উত্তরপ্রদেশের আওয়াধ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, দুজনেই টেলিকম সেক্টরে কাজ করছেন চার বছর ধরে, দুজনেই অযোধ্যার হনুমানগড়ি এলাকার নতুন শাওমি স্টোরে কর্মরত। হনুমান গড়ি বিতর্কিত রাম জন্মভূমি এলাকা থেকে বড়জোর এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
১৭ অক্টোবর, উৎসব কালের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে শেষ হচ্ছে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার শুনানি। সে নিয়ে বহু কথা হচ্ছে বটে, কিন্তু খাস অযোধ্যায় নতুন মল আর স্টোর নিয়েই গুঞ্জন বেশি চলছে।
২৪ বছরের শ্রীবাস্তব আর ২১ বছরের সরফরাজ দুজনেই বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী প্রজন্ম। শাওমির নতুন স্টোরটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, নিওন আলোয় ঝলকানো, তার দেওয়াল ঝকঝকে। এসবের সামনে চাপা পড়ে গিয়েছে পুরনো দোকানগুলো, যেখানে শাঁখ, কলসি, ধূপদানি, নারকোল এবং সরযূ নদীর জল ভরার পাত্র বিক্রি হত। শ্রীবাস্তব বলছিলেন, "অযোধ্যার যুবসম্প্রদায় দেশের অন্য যে কোনও জায়গার মতই, তাদের চোখ থাকে ফোনে, তারা ভালো সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।"
অযোধ্যার অন্যদের মতই শ্রীবাস্তব ও সরফরাজ বিশ্বাস করেন, এ শহর থেকে তাঁদের বেরিয়ে পড়া প্রয়োজন।
কাছেই বিশাল দেওয়ালি উৎসবের আয়োজন চলছে। যোগী আদিত্যনাথ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবার আগের দুবারের তুলনায় বেশি ঘটা হবে। গত বছর এ উৎসবের প্রধান অতিথি ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার ফার্স্ট লেডি কিম জুং সুক। গতবারই মুখ্যমন্ত্রী ফৈজাবাদ জেলার নাম পাল্টে দিয়েছিলেন।
বাবরি ধ্বংসের পরবর্তী ঘটনার ভুক্তভোগীরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আশা করছেন এবারের রায়ে তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন। আশা করছেন সেসব দিনের হিংসাকে পিছনে ফেলে আসা যাবে।
এ শহরের সকলেই এবার এগিয়ে চলতে চান। ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ হলেও নিত্যদিনের জীবনে তার গুরুত্ব নেই বললেন শ্রীবাস্তব। মন্দিরের সপক্ষে রায় হলে তিনি যারপরনাই খুশি হবেন, "যাই হোক না কেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিষয়টা শেষ হওয়া উচিত। আমরা মেনে নেব। হিন্দু-মুসলিম, মন্দির মসজিদের বাইরে হিয়ে তাকাতেই হবে অযোধ্যাকে। এ আমরা জন্ম থেকে শুনে আসছি।"
সরফরাজ ফোনে স্টোর করা গান স্ক্রোল করতে করতে বললেন, "মুসলিম হিসেবে বিতর্কিত স্থানে আমি মসজিদ চাই। কিন্তু মন্দির হলে অযোধ্যায় বেশি পর্যটন হবে, তাতে কাজের সুযোগ বাড়বে। ফলে মন্দির হলেও আমি খুশি।"
***
৬০ হাজারের বেশি মানুষের বাস অযোধ্যা শহরে। যোগী আদিত্যনাথ একাধিক প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন এখানকার জন্য। এর মধ্যে রয়েছে অযোধ্যাকে স্মার্ট সিটি বানানোর পরিকল্পনা, ১৭৪ কোটি টাকায় একটি মেডিক্যাল কলেজ, ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে একটি বিমানবন্দর, বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি- ২২১ মিটারের রামমূর্তি, এবং সরজু তীরবর্তী এলাকা ঢেলে সাজাতে ৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির কাজ প্রায় শেষ।
অযোধ্যার জেলাশাসক অনুজ কুমার ঝা জানিয়েছেন, "আমরা রামমূর্তি বানানোর জায়গা খুঁজছি। বিমানবন্দর বানানোর জন্য দুটি গ্রাম জমি দিতে রাজি হয়েছে। আরও দুটি গ্রামের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।"
১৮ বছর বয়সী বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র শিবম যাদবের বাব শিক্ষক। তিন ভাইবোনের মধ্যে শিবমই সবচেয়ে বড়। কলেজে পুজোর ছুটিতে সে এসেছিল স্কলারশিপের ফর্ম তুলতে। হেসে সে বলে, "ফেসবুক দেখে বোঝা যায় দেশে আমাদের জায়গা কোথায়। আমাদের কিছু নেই... মল নেই, হোটেল নেই, আমিষ খাবার নেই, শুধু ঝগড়া আছে... রাজনীতিবিদরা অবিশ্বাসের বীজ পুঁতে দিয়েছে।"
কলেজের দেওযাল থেকে রং খসে পড়ছে, আগের দিনের বৃষ্টিতে বাস্কেটবল কোর্ট দলে ভরা। সে দিকে দেখিয়ে ১৭ বছরের রজত শ্রীবাস্তব বলে, তার আশা নিটের মেডিক্যাল এন্ট্রান্স পাশ করে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ায়। সে নিশ্চিত, হিন্দু বা মুসলিম যেই হোক না কেন, নয়া প্রজন্ম শিক্ষা চায়।
নিটের প্রস্তুতি নিচ্ছে ১৮ বছরের আব্দুল রাজাকও। আসল ইস্যু থেকে নজর ঘোরানোর জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে রাজনীতিবিদরা, অভিযোগ তার। "কেউ যদি শিক্ষা বা উন্নয়নের কথা বলে, তাহলে ওরা শুধু বলে, মন্দির ইয়েহিঁ বনায়েঙ্গে।"
২২ বছরের অমৃতা ভার্মা ডি ফার্মার প্রথম বর্ষের ছাত্রী। "আমরা বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও প্রকল্পের কথা শুনি, কিন্তু বাস্তবে মহিলারা নিরাপদ বোধ করে না। আমরা সবাই কলেজের পর চাকরি করতে চাই, কিন্তু আমাদের মতামতে কী এসে যায়! মহিলারা তো আলোচ্য বস্তু নয়।"
অমৃতার বান্ধবী ১৭ বছরের কান্তি যাদবের কাছ থেকেই জানা গেল তার বন্ধুদের অধিকাংশেরই ফোন ব্যবহারের অনুমতি নেই। অন্যদের হাসির মাঝেই কান্তি বলে, "আদালতের উচিত বিতর্কিত জমিতে কলেজ তৈরির নির্দেশ দেওয়া, যেখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই পড়বে।"
বেলা চারটে নাগাদ, হনুমান গড়ি থেকে সান্ধ্য আরতির আওয়াজ যখন ভেসে আসছে, সে সময়েই তিন কিলোমিটার দূরে বাজারের কোচিং সেন্টারে ভিড় জমে ওঠে। এখানে আইএএস, সেনাবাহিনী, শিক্ষক শিক্ষণ সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ট্রেনিং দেওয়া হয়। গত বছরের পরীক্ষায় শীর্ষস্থানাধিকারীদের ফোটো সারা শহর জুড়ে ছড়ানো।
সংকল্প অ্যাকাডেমিতে জেনারেল স্টাডিজ পড়ান ২৫ বছরের অজয় চৌধরী। "বড়রাস্তার পাশের গলিগুলো দিয়ে যদি হেঁটে যান, তাহলে দেখবেন ধর্মে কিছু এসে যায় না। অযোধ্যার সমস্যাও দেখতে পারেন। খোলা নর্দমা, ভাঙা রাস্তা, ভঙ্গুর বাড়ি।"
তিনি জানালেন সেন্টারের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকশিক্ষিকারা যারা ১৯৯২ সালের পর জন্মেছে, তারা রাম মন্দির চায়, কিন্তু সে নিয়ে উৎসাহ খুবই সীমিত। "তাতে কী সুবিধে হবে আমাদের! সব ছাত্রছাত্রীরাই খুব পরিশ্রম করছে যাতে বাইরে চাকরি পাওয়া যায়।"
শিবমের এই মুহূর্তের দুশ্চিন্তা অন্য। "আমরা শুনেছি রায়ের আগে বিশাল সংখ্যক বাহিনী আসছে, তারা কলেজে থাকবে। তার মানে আরও দু মাস নষ্ট।"
***
গায়ত্রী পাণ্ডের বয়স ৫০। ১৯৯০ সালে করসেবকরা বাবরি মসজিদে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি চালায়। সেই গুলিতেই মারা যান গায়ত্রীর স্বামী রমেশ পাণ্ডে। রানি বাজারের ছোট্ট বাড়িতে তাঁর কোলে বসা ৫ বছরের ছোট নাতি আতহার যখন আধোআধো গলায় বলে, "মন্দির কা নির্মাণ হোগা", তিনি হাসেন।
রমেশের চার সন্তান। তাঁর মৃত্যুর পর পরিবার ২ লক্ষ টাকা পেয়েছিল। "আমি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি... সবাই আমাদের ভুলে গিয়েছে। রায় বেরোলে আমার স্বামীর বলিদান সবাই মনে করবে আশা করি। অন্তত আমার ছেলেদের সরকারি চাকরি পাওয়া উচিত।" তাঁদের বড় ছেলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রাম মন্দির কার্যশালায় কাজ করেন।
১৯৯০ এর গুলিচালনায় মারা গিয়েছেন সন্দীপকুমার গুপ্তা (৩০), ও সীমা গুপ্তা (৩৫)-র বাবা। ছোট কাপড়ের দোকান থেকে তাঁদের কোনও রকমে দিন গুজরান হয়। রাম মন্দির বানানোর পক্ষে সন্দীপ। বললেন, "রাম আমাদের পরিচিতি। মুসলমানদের কাছে যেমন মক্কা, তেমনই আমাদের রামজন্মভূমি।"
শহরের অন্য প্রান্তে মহম্মদ নাইমের আশা তাঁর ষোল বছরের ভাইপো সাদিকের মৃত্যু বৃথা যাবেন। বাবরি ধ্বংসের পর হিংসায় মারা গিয়েছিল সাদিক। মোট ১৫ জন মুসলিমের মৃত্যুর কথা ছিল রিপোর্টে। ৫১ বছরের নাইম ড্রাইভার, তাঁর পাঁচ সন্তান। "আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাদিককে বাড়ি থেকে টেনে বার করে পিটিয়ে মারা হয়েছিল।"
১৮ বছরের ছেলে তাঁকে চুপ করাতে চাইলে হাত ঠেলে সরিয়ে দেন নাইম। "কেন বলবনা! আজকালকার ছেলেমেয়েরা সে সময়ের কথা জানে না, এরা খালি পড়াশোনো করে চাকরি করতে চায়। আমরা কিন্তু রায়ের জন্য অপেক্ষা করে আছি। আমাদের কথা কেউ শোনেনি। আশা করি এবার আমরা ন্যায়বিচার পাব।"
বাবরি পরবর্তী হিংসায় মারা গিয়েছিলেন শওকতউল্লা। তাঁর ৩০ বছরের মেয়ে তারান্নুম মুখ খুলতে চাইলেন না। দরজার আড়াল থেকে বললেন, "এবার সমস্যার সমাধান হোক। বড্ড বেশিদিন ধরে চলছে।"
অযোধ্যা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র শরদ শর্মা। মন্দির আন্দোলনে সংঘ পরিবারের এই সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। মন্দির নিয়ে প্যাশন কমলেও প্রযুক্তির সহায়তা পাচ্ছেন বলে স্বীকার করে নিলেন তিনি। "এর আগে বজরং দলের ২৫ লাখ সদস্য ছিল, এখন আমাদের ৭০ লাখ সদস্য। ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে এই প্রজন্ম আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এখন ছোটরাও দুর্গাপূজা, গণেশ পূজা করছে। ওরা আমাদের ইতিহাস জানে।"
২৫ বছরের দীপক কুমার সাহনি বছরের এ সময়ে আরও অনেকের মতই চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে করসেবকপুরমে আসেন। দশের ভাণ্ডারে খাদ্য বিতরণ করতে করতে তিনি বললেন, "মন্দির আর বিকাশ একসঙ্গে আসবে। ইতিমধ্যেই রাস্তা চওড়া হয়ে গিয়েছে, খোলা তার মাটির তলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে... অযোধ্যার আর কোনও সমস্যা নেই এখন।"
কয়েক মিটার দূরেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পরিচালিত স্কুলে ছাত্রসংখ্যা ৩৫। বয়স ১২ থেকে ১৭-র মধ্যে। তারা যজুর্বেদের শ্লোক আবৃত্তি করছিল। তাদের শিক্ষক নারদ ভট্টরাই (৩০)- যখন প্রশ্ন করেন তারা মন্দির চায় কিনা, সমস্বরে জবাব আসে - "হ্যাঁ।"
ভোর চারটে থেকে দিন শুরু হয় ছাত্রদের। বেদ, ইংরেজি, অঙ্ক, সোশাল সায়েন্স পড়তে হয় তাজের। ক্লাস ফাইভ থেকে পড়ানো হয় এখানে। ভর্তির পরীক্ষাও নেওয়া হয়। এর পর ওপেন বোর্ডের পরীক্ষা দিয়ে তারা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে। পাঁচজন শিক্ষক স্কুলে। ভট্টরাই জানালেন, এখান থেকে পাশ করে, অধিকাংশই বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর শিক্ষায় যায়।
ক্লাস টেনের ছাত্র ১৫ বছরের জ্ঞানেন্দ্র মিশ্র। সে "রাম কথাবাচক" (গল্প বলিয়ে) হতে চায়। অন্যরা তার পিছনে লাগলে, সে সপাটে বলে, "না সাধু না। কথাবাচক।"
১০ কিলোমিটার দূরে অযোধ্যা-ফৈজাবাদ সীমান্তে মুসলিম ইয়াতিম খানা মাদ্রাসা। এলাকার বৃহত্তম এই মাদ্রাসায় ৫০ জন ছাত্র। শিক্ষক মহম্মদ হাসিব জানালেন এখানো কোরাণের সঙ্গে অঙ্ক, ইংরেজি ও উর্দু পড়ানো হয়। "এ মাদ্রাসায় শিক্ষার সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগাযোগ নেই। রায় যাই হোক, আমরা মেনে নেব। শুধু যেন ধোঁকা না দেওয়া হয়।"
হাসিব মনে করেন, মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব কমে আসায় এবং নিজেদের মত প্রকাশের জায়গা সীমিত হয়ে আসায় মুসলিমরা এখন সব কিছু নিজেদের মধ্যে রাখতে শিখেছেন। "আমাদের পক্ষে রায় এলে এ অবস্থা কাটবে।
কাছে জড়ো হওয়া জনা কুড়ি ছাত্র মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলে, "এই ইস্যু এবার শেষ হওয়া উচিত। আমরা মসজিদ চাই।"
স্থানীয় মাংস বিক্রেতা মহম্ম শেহজাদ ওই মাদ্রাসায় যাতায়াত করেন। তিনিও দাবি করলেন, "বিতর্কিত জমি আমাদের। তবে রায়ের পর কী হবে সে নিয়ে আশঙ্কায় আছেন তিনি। যেভাবে মিডিয়া আমাদের সম্প্রদায়কে দেখাচ্ছে। আমি ১৯৯২ সালে কী হয়েছিল দেখেছি, আবার সে জিনিস হোক চাইব না।"
নবরাত্রির ৯ দিন কাটার পর দোকান খুলেছেন শেহজাদ। "এখন আমরা শুনি শহরের বাইরে মাংসের দোকানও বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ আমার একমাত্র রোজগার।"
নিজের ছেলেমেয়েদের তিনি মাংস কাটার পথে আসতে দেননি। "ওরা পড়াশোনা করছে, আশা করি বাইরে কাজ পেয়ে যাবে।"
***
এদিকের শাওমি স্টোরের শ্রীবাস্তব জানালেন, তাঁরা মাসে ১৮০টির মত হ্যান্ডসেট বিক্রি করেন। অল্পবয়সীরাই মূল খরিদ্দার, বেশিরবাগ সেটের দামই ৮ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। এখন স্টোর থেকে হাজার কুড়ি টাকা রোজগায় করে চলে তাঁর, তাঁর আশা তিনি উত্তর প্রদেশ পুলিশে চাকরি পেয়ে যাবেন। "এখানে সকাল ১১টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত কাজ করার পর আমি রাত দুটো অবধি পড়াশোনা করি, সকালে কোচিংয়ে যাই। আমি একটা সরকারি চাকরি চাই, তাতে আমার সুস্থিতি আসবে, শহর ছাড়ার আগে দু বার ভাবব না।" কৃষক পরিবারের তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রীবাস্তব জানালেন।
সরফরাজের বাবার কাছেই সেলুন চালান। সরফরাজ অভিজ্ঞতা অর্জনের পর নিজে ব্যবসা করতে চান। "আমি ১৭ বছর বয়স থেকে কাজ করা শুরু করেছি। আমি চাকরির সাইট দেখি, কিন্তু অযোধ্যায় পোস্টিংয়ের কোনও চাকরি নেই। শহর ছাড়ার পক্ষে আমার বয়স কম। যদি কিছু আসে, চলে যাব।" তাঁর রোজগার মাসে ১৫ হাজার টাকা।
দিন মজুরের মেয়ে ১৮ বছরের শিবাঙ্গী কানোজিয়া বিগ বাজারের আউটলেটে কাজ করা শুরু করেছেন। শিবাঙ্গীর কথায়, "আমার তিন ভাই আছে, কিন্তু তারা কোনও কাজের নয়। আমি যেহেতু ১২ ক্লাস পাশ করেছি, কাজ পাবার চিন্তায় থাকতাম সারাক্ষণ।"
বিগ বাজারের চাকরির ব্যাপারে শুধু তিনি জানতেন, "একটা এয়ার কন্ডিশন্ড অফিস আর ভাল মাইনে।" হাসপাতালের নার্সিংয়ের চাকরির থেকে ভাল কাজ ভেবে তিনি এ কাজ লুফে নেন। এখন তিনি বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আসেন। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ডিউটি। একদিন ছুটি সপ্তাহে। তিনতলা স্টোরের সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে কাজ পেয়েছেন তিনি।
দশেরার একমাস আগে দোকান খোলে। খদ্দেরদের মধ্যে রয়েছেন গেরুয়া পরা সাধুরাও। ৭০ জনের বেশি কর্মচারী এখানে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ফেসওয়াশ, আমন্ড আর মেয়েদের কুর্তা।
বটল গ্রিন ইউনিফর্ম পরিহিত শিবাঙ্গী জানালেন তাঁর রোজগার মাসে ৮০০০ টাকা। "আমি বিল আর ব্যাগ চেক করি, অফিস পাহারা দিই। আমার পরিবারের পক্ষে এ চাকরি খুব উপকারের হয়েছে।" রামমন্দির আন্দোলন নিয়ে বাবার সময় নেই তাঁর, জানালেন এই অষ্টাদশী। "যদি তাতে ভাল চাকরি হয়, আমি আছি।"
ফৈজাবাদের রিলায়েন্স ট্রেন্ডজ মল খুলেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০ বছরের আদিত্য যাদব এখানকার স্টোর ম্যানেজার। বিক্রি দারুন বলে জানালেন তিনি। "অযোধ্যার বাইরের লোকের ধারণা এ শহর বুঝি শুধু রাম মন্দিরের। কিন্তু অযোধ্যা এগিয়ে গিয়েছে। বললেন স্থানীয় বাসিন্দা আদিত্য। আগে ভোডাফোনে কাজ করতেন তিনি।
স্টোর ম্যানেজার শ্যাম সিং বললেন, অযোধ্যায় পোস্টিং তাঁর চোখ খুলে দিয়েছে। "গত বছর আমি যখন এখানে আউটলেট খোলার আগে মার্কেট রিসার্চ করছিলাম, দেখেছিলাম প্রায় সব বাড়ির জানালায় গ্রিল। আমার মনে হয়েছিল লোকজন কারফিউ কিংবা সংঘর্ষের জন্য সাবধান থাকে... পরে দেখলাম বাঁদরের উৎপাত থেকে রেহাই পাবার জন্য।" হাসতে হাসতে বললেন তিনি। "আমরা শুনেছি এখানে খুব শিগগিরই ওলা সার্ভিস চালু হবে।"
***
ধর্মীয় ফ্রন্টেও বদল স্পষ্ট- যেমন রামলীলা। দশেরার দিন সন্ধের দিকে হাতে গোনা কয়েকজন রাজেন্দ্র নিবাসে অযোধ্যা রামলীলা মহোৎসব সমিতির রামলীলা দেখতে যাচ্ছিলেন। অল্পবয়সীরা সারাদিন উচ্ছল ভোজপুরী গানের সঙ্গে নাচার পর দুর্গা প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের পথে।
লোক কমে আসার জন্য ফোনকে দায়ী করেন রাজেন্দ্র নিবাসের রামলীলার মালিক আওয়াধি কিশোর পাঠক। "আজকালকার ছেলেরা ফোনে সব দেখতে পায়, রামায়ণও। এখন আর কে এসব দেখতে আসবে?"
রামলীলায় রাম, লক্ষণ ও সীতার ভূমিকায় অভিনয় করেন দুই সন্তানের পিতা ২৬ বছরের রত্নেশ শুক্লা। ১০ দিনের পারফরম্যান্সের জন্য ২০ হাজার টাকা পান তিনি। বললেন, "শিগগিরই সব পাল্টে যাবে। সামনের বছর আপনি রামলীলায় আসুন। জায়গা পুরো ভরা থাকবে। আমরা শুধু অপেক্ষা করছি।"
অযোধ্যা পিকচার আভি বাকি হ্যায়
অযোধ্যার বাইরে আসিফ বাগে, রাজু প্রজাপতি কুমোরের চাকায় কাজ করছিলেন। ১০০০০ প্রদীপ বানাবেন তিনি দিওয়ালির জন্য। রাজ্য সরকারের নির্দেশ ৭০ প্রদীপের জন্য ১০০ টাকা। "রাম সীতা যেমন হনুমানের হৃদয়ে বাস করেন, তেমনই নরেন্দ্র মোদী আর যোগীজির হৃদয়ে বাস করে অযোধ্যা", বললেন ২৫ বছর বয়সী গ্র্যাজুয়েট রাজু। বহুরকম কাজ করার অসফল চেষ্টার পর পারিবারিক পেশায় যোগ দিয়েছেন তিনি। "এবার আমাদের চার লক্ষ প্রদীপ বানাতে হবে। যোগীজি সে ডাইরেক্ট বাত হুয়ি হামারি।" চকচক করে ওঠে তাঁর চোখ।
২৭ বছর এবং
৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২- বাবরি মসজিদ ধ্বংস।
২০০২ এপ্রিল- বিতর্কিত জমির অধিকার নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টে শুনানি শুরু
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০- হাই কোর্টে ২-১ মেজরিটিতে সিদ্ধান্ত, বিতর্কিত এলাকা সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রাম লালা বিরাজমনের মধ্যে সমবণ্টিত করা হোক।
৯ মে, ২০১১- সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬- বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির বানানোর অনুমতি চেয়ে আবেদন
২১ মার্চ, ২০১৭- তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের আদালতের বাইরে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব সব পক্ষের কাছে
১ ডিসেম্বর, ২০১৭- ৩২ জন নাগরিক অধিকার কর্মী ২০১০ সালের এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করলেন।
৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮- সুপ্রিম কোর্টে সমস্ত দেওয়ানি আবেদনের শুনানি শুরু
২৫ জানুয়ারি, ২০১৯- এ মামলার শুনানির জন্য পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ পুনর্গঠন করল সুপ্রিম কোর্ট। নতুন বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, এবং বিচারপতি এস এ বোবডে, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এসএ নাজির।
জুলাই ২০১৯- তিন সদস্যের প্যানেলকে মধ্যস্থতার জন্য ৮ মাসের সময় দিল সুপ্রিম কোর্ট
২০১৯ অগাস্ট- প্রধান বিচারপতি গগৈ জানালেন মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ, ৬ অগাস্ট থেকে মামলার দৈনন্দিন শুনানি শুরু।
Read the Full Story in English