/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/10/bagri-759-inline-1.jpg)
বাগরির দোকানের নয়া ঠিকানার হোর্ডিং। ছবি: সৌরদীপ সামন্ত।
পুজোর আর বাকি টেনেটুনে দু’সপ্তাহ। গত বছর এ সময়টায় ওঁদের হাতে ছিল মোটা অঙ্কের টাকা। আর এবছর পুজোর আগে হাতখরচটুকু জোগাড় করতেও কালঘাম ছুটছে। ১৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতের বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছে সব। ওঁরা সেই বাগরি মার্কেটের সামনে বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসতেন। কিন্তু আগুন ওঁদের সবটুকু কেড়ে নিয়েছে। প্রায় চারদিন ধরে জ্বলেছিল বাগরি মার্কেট। তারপর কেটে গেছে প্রায় ২০ দিন। বাগরি মার্কেটের পোড়ো বাড়ি এখন প্রায় পরিত্যক্ত। পুলিশি ব্যারিকেড নেই আর। সামনের রাস্তায় ব্যবসায়ী-ক্রেতাদের চেনা ভিড়। তিনচাকার ভ্যান ছুটছে, অটো ছুটছে ভিড় ঠেলে, মুটিয়ারা মাল বইছেন। অনেকটাই ছন্দে ফিরেছে বাগরি মার্কেটের আশপাশ। কিন্তু মার্কেটের সামনে যে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে অস্থায়ী দোকান খাটিয়ে ব্যবসা করতেন, তাঁদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর উপায় হয় নি আজও।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/10/bagri-new-759.jpg)
"বহত নুকসান হুয়া," বললেন বাগরির সামনের এক ব্যবসায়ী। অগ্নিকাণ্ডের জেরে রকমারি জিনিসের পসরা সাজিয়ে প্রায় ১০-১২ দিন বসতে পারেননি ওই ব্যবসায়ী। আজ ফের মার্কেটের উল্টোদিকে, মেহতা বিল্ডিংয়ের সামনে, পসরা নিয়ে বসেছেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যবসায়ী বললেন, "আগুন লাগার ফলে তো এতদিন দোকান খুলতে পারিনি। অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। গত বছর এ সময় যে টাকা উঠেছিল, এবার অনেক কম।" বাগরি মার্কেটের নীচে সফট টয়ের অস্থায়ী দোকান নিয়ে বসতেন মহম্মদ ইদ্রিস। তিনি বললেন, "টেডি বিয়ার নিয়ে বসতাম। সব জ্বলে পুড়ে গিয়েছে। বরবাদ হয়ে গেছে সব। এখন আর কোথাও দোকান খাটিয়ে বসছি না। হাতে একদম পয়সা নেই। খাওয়ার পয়সাটুকুও নেই। কী করব!"
‘‘অনেক ক্ষতি হয়েছে’’, বললেন বাগরি মার্কেটের সামনের এই অস্থায়ী দোকানদার।#bagrimarket #ieBangla pic.twitter.com/qy30bJpwIz
— IE Bangla (@ieBangla) October 4, 2018
’’বরবাদ হো গয়া’’#bagrimarket #ieBangla pic.twitter.com/ksMrxLFWv5
— IE Bangla (@ieBangla) October 4, 2018
আগুন তারপর দমকল বাহিনীর উদ্ধারকার্যের সময় জল পড়ে দোকানের বহু সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে জানালেন আরেক ব্যবসায়ী, বড়কা ভাই। অগ্নিকাণ্ডের পর আজই ফের দোকান সাজিয়ে বসেছেন ওই ব্যবসায়ী। তিনি বললেন, "অনেক লোকসান হয়ে গিয়েছে। সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ২০ দিন ধরে তো মাল নিয়ে বসতে পারিনি। এটাই তো আমাদের রুজিরুটি।" বিভিন্ন ব্যাগ নিয়ে বাগরির নীচে অস্থায়ী দোকান খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসতেন ব্যবসায়ী জাভেদ। তিনিও বললেন, "অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে গিয়েছে।"
অগ্নিকাণ্ডের ফাঁড়া কাটিয়ে আবার ছন্দে ফিরতে মরিয়া ওই ব্যবসায়ীরা। কেউ দিন সাতেক আগে দোকান খুলেছেন তো কেউবা আজ বসেছেন, কেউ আবার দু’দিন আগে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে কি? জবাবে তরুণ ব্যবসায়ী রিজওয়ানুর বললেন, "টেডি বিয়ার নিয়ে বসেছি আবার। অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমার মতো আরও যাঁরা এখানে বসতেন, তাঁদেরও ক্ষতি হয়েছে। বিক্রি সেভাবে হচ্ছে না।" আরেক অস্থায়ী দোকানদার মহম্মদ জাভেদ অবশ্য বললেন, "১০ দিন দোকান বন্ধ রেখেছিলাম। গত সোমবার খুলেছি আবার। লোকসান হয়েছে, তবে এখন আবার বিক্রি হচ্ছে ভাল।" এবারে তাঁরও পুজোর বাজার মন্দা বলে জানালেন আরেক ব্যবসায়ী উমর ফারুক। বললেন, "গত বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম ব্যবসা হয়েছে এবছর পুজোর আগে।" বিভিন্ন ধরনের বেল্ট নিয়ে বাগরির উল্টোদিকে মেহতা বিল্ডিংয়ের নীচে বসেছেন কামার ইলাহি। তিনি বললেন, "জিরো পার্সেন্ট বিজনেস চল রহা হ্যায়।" মার্কেটের পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত এক পুলিশকর্মী পর্যন্ত আফশোসের সুরে বললেন, "কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পুজোর আগে ব্যবসায়ীদের প্রচুর ক্ষতি হল।"
পুজোর বাজার মন্দা, মানলেন এই ব্যবসায়ীও।#bagrimarket #ieBangla pic.twitter.com/IVm2mGlvzA
— IE Bangla (@ieBangla) October 4, 2018
অন্যদিকে, মার্কেটের ভিতরে যাঁদের দোকান ছিল, তাঁরা অন্য মার্কেটে দোকান স্থানান্তরিত করেছেন। কেউ গিয়েছেন ক্যানিং স্ট্রিটে, তো কেউ ব্রেবোর্ন রোডে, আবার কেউ গিয়েছেন অমরতলা স্ট্রিট। কেউ আবার দোকানের নতুন ঠিকানা হিসেবে ব্যানারে লিখেছেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের নাম। হ্যাঁ, বন্ধ মার্কেটের পোড়া দেওয়ালে সারিবদ্ধ ভাবে ঝুলছে বিভিন্ন দোকানের ব্যানার। যে ব্যানারে দোকানের নামের সঙ্গে নতুন ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। সেসব দোকানের ক্রেতাদের উদ্দেশে নতুন ঠিকানায় আসার কথাও লেখা রয়েছে।
দোকানের নয়া ঠিকানা জানাতে হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়ালেন বাগরির এই ব্যবসায়ী।#bagrimarket #ieBangla pic.twitter.com/kqUlUk5Ew4
— IE Bangla (@ieBangla) October 4, 2018
বাগরির মধ্যে ছিল জয় মাতাদি জুয়েলার্সের দোকান। এই দোকানের নতুন ঠিকানা ৫৪/১ ক্যানিং স্ট্রিট। দোকানের যাঁরা ক্রেতা, তাঁরা যাতে নতুন ঠিকানা জানতে পারেন, সেজন্য অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন মালিক সুব্রত মান্না। হাতে একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে বাগরির সামনে চড়া রোদ মাথায় নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে তিনি। তাতে লেখা নতুন দোকানের ঠিকানা। মাঝেমধ্যেই জনতার উদ্দেশে হকারদের মতো হাঁক পাড়ছেন তিনি। সুব্রতবাবু বললেন, "২১ সেপ্টেম্বর থেকে শিফট করেছি। এভাবেই করতে হবে আমাদের। দীর্ঘ লড়াই করতে হবে।" জয় মাতাদি জুয়েলার্সের মতো দোকান সরেছে কৃষ্ণা অপটিক্যালেরও। ওই দোকানের সুধীর নামের এক কর্মী বললেন, "আগুনের সময় জিনিসপত্র সরাতে গিয়ে পায়ে চোট লেগেছিল। হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এখন তো দোকান শিফট করা হয়েছে। তবে লোকসান হচ্ছে।"
প্রায় ২৫ বছর ধরে বাগরি মার্কেটের ক্রেতা দুর্গাপুরের বাসিন্দা শংকর দাস। তিনি পাইকারি ক্রেতা। বাগরি মানেই তো বহু ব্যবসায়ীর কাছে পাইকারি বাজার ছিল। দুর্গাপুর থেকে আসতেন বাগরি থেকে জিনিস কিনতে। মার্কেট বন্ধ, যে দোকান থেকে সামগ্রী কিনতেন, সেই দোকান হন্যে হয়ে খুঁজছেন। শেষমেশ পোস্টারে দেখেন, দোকানের নতুন ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে। বললেন, "প্রায় ২৫ বছর ধরে কেনাকাটি করি এখান থেকে। কিনে আবার বিক্রি করি। পোস্টার দেখে দোকান খুঁজছি। পুজোর আগে আমাদেরও খুব সমস্যা হচ্ছে।" শংকরবাবুর মতো অনেক ক্রেতাই বাগরি চত্বরে হন্যে হয়ে পরিচিত দোকান খুঁজছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা বাগরির একটা দোকানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, "এখানে যে দোকানটা ছিল, ওখান থেকে পারফিউম কিনতাম। জানি না দোকানটা কোথায় এখন।"
অন্যদিকে, অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই বেপাত্তা বাগরি মার্কেটের মালিকপক্ষ। আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি, যে প্রযুক্তি প্রহরার এই যুগেও, এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া সত্ত্বেও, রাধা এবং বরুণ বাগরির আজও কোনও হদিশ নেই পুলিশের কাছে। কোন পথে চলছে তদন্ত? জবাবে বড়বাজার থানার এক শীর্ষ আধিকারিক শুধু এটুকুই বললেন, "তদন্ত চলছে।" রাধা বাগরিরা কোথায়, কেন তাঁদের পাকড়াও করা হচ্ছে না, এ নিয়ে প্রথম থেকেই ক্ষোভ ছিল বাগরি মার্কেটের ব্যবসায়ীদের একাংশের। আজও এই অস্থায়ী দোকানদাররা বললেন, "ওদের বড় বড় ব্যাপার, আমরা কী আর বলব!"
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/10/bagri-inline-2.jpg)
আগুন নিভে গেছে, ছন্দে ফিরছে বাগরি মার্কেট চত্বর। কিন্তু যে ক্ষতি হয়েছে তা কবে পূরণ করা যাবে সে নিয়েই মাথাব্যথা ওই ব্যবসায়ীদের। সরকারি সাহায্য চান এঁরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ওঁরা বললেন, "দিদি খুব ভাল, উনি গরিবের পাশে থাকেন। আশা করছি, উনি আমাদের সাহায্য করবেন।" যদিও অগ্নিকাণ্ডের পর মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে না আসায় খানিকটা অভিমান জমেছে। এদিকে বাগরি দর্শন কিন্তু এখনও অব্যাহত। আজও ওই বাড়ির সামনে এসে অনেকেই থমকে দাঁড়াচ্ছেন। বাগরি মার্কেটের দিকে অবাক পানে তাকাচ্ছেন।