/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/03/hs-doreswamy.jpg)
১০২ বছরের দোরেস্বামী (ছবি- অমৃতা দত্ত)
একগুচ্ছ কাগজের উপর লিখছিলেন। খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে। "আমি আমার বায়ো ডেটা লিখছি।" দক্ষিণ বেঙ্গালুরর এক তলা বাসস্থানে বসে নিজের জীবনকাহিনি সংক্ষেপে বলছিলেন এইচ এস দোরেস্বামী। এ শহরে ১৯১৮ সালে তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে, ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলনে তাঁর যোগদানের কথা। বলছিলেন সাম্প্রতিক কথাও, যার জেরে বেঙ্গালুরু জুড়ে ঝড় উঠেছে। "পড়ে দেখুন এতে কোথায় দেশদ্রোহী কিছু রয়েছে কিনা।"
কয়েক দশক ধরে বেঙ্গালুরুর সামাজিক আন্দোলনে দোরেস্বামী পরিচিত এক নাম। এখন তিনি রাজনৈতিক ঝঞ্ঝার মাঝে। সৌজন্য বিজাপুরের বিজেপি বিধায়ক বসনগৌড়া পাটিল, যিনি দোরেস্বামীকে গত মাসে জাল স্বাধীনতা সংগ্রামী ও পাকিস্তানের দালাল আখ্যা দিয়েছেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর যুক্ত থাকার প্রমাণপত্র দাবি করেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশি সহ বেশ কয়েকজন বরিষ্ঠ বিজেপি নেতা এ ব্যাপারে বসগৌড়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন।
গত মঙ্গলবার কংগ্রেস ১৯৭১ সালের এক নথি প্রকাশ করেছে। ১৯৭১ সালের সেই নথিতে বেঙ্গালুরু কেন্দ্রীয় জেলের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ড্যান্টের স্বাক্ষর রয়েছে। সেখানে বলা রয়েছে, "২৫ বছরের এক অবিবাহিত যুবক দোরেস্বামীকে ১৯৪২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বন্দি করা হয়, এবং ১৯৪৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ছেড়ে দেওয়া হয়।"
বিজেপি নেতাদের দোরেস্বামীর বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ। তার অন্যতম গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেশদ্রোহী স্লোগান দিয়ে গ্রেফতার হওয়া ১৯ বছরের তরুণী অমূল্যা লিওনা নোরোনহার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘিরে। একটি ফোটোগ্রাফে দেখা হিয়েছে কোপ্পায় অমূল্যার বাড়িতে গিয়েছেন দোরেস্বামী।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/03/doreswamy-letter.jpg)
ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের কথায়, "উনি আমাদের রাজ্যের বিবেক। উনি সুভদ্র, সৎ মানুষ, বেশ কিছু সামাজিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কথা বলেছেন কৃষক ও ভূমিহীনদের পক্ষে। তিনি কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করেছেন জমি নিয়ে অস্বচ্ছ ব্যবসার ব্যাপারে... কিন্তু আমার অবাক লাগছে মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পার নীরবতা দেখে, যিনি কৃষকদের নাম করে শপথগ্রহণ করেছিলেন।"
দোরেস্বামী বিস্মিত। "আমি ৬০ বছর ধরে প্রকাশ্য জীবন কাটাচ্ছি। মতাদর্শগত ফারাক থাকলেও বিজেপি ও আরএসএসেও আমার বন্ধুরা রয়েছেন। আমি আশা করিনি পুরো বিজেপি এরকমভাবে আমাকে আক্রমণ করবে।"
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করেছেন এ কথা মেনে নিয়ে তিনি বলছেন, "আমি সব সরকারকেই সমালোচনা করি। সেটাই একজন নাগরিকের দায়িত্ব। জরুরি অবস্থার সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা এক চিঠিতে আমি লিখেছিলাম, "আপনি গণতন্ত্রের নামে শাসন করছেন, কিন্তু একনায়কের মত ব্যবহার করছেন... এরকম চালাতে থাকলে আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলতে থাকব আপনি একনায়ক।" দোরেস্বামীকে চার মাস বন্দি রাখা হয়। এরপর এক ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ওঁর প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনা করার সমস্ত অধিকার রয়েছে, এবং তাঁর কারাবাস শেষ হয়।
বেঙ্গালুরুর এক স্কুলের পদার্থবিদ্যা ও গণিতের শিক্ষক দোরেস্বামী স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৪২ সালের জুন মাসে, গান্ধীর আহ্বানে। "আমরা সরকারি অফিসের কাছের পোস্ট বক্সগুলোতে ছোট ছোট টাইম বোম রাখতাম। সেগুলো মানুষ খুন করবার জন্য ছিল না। ওগুলোতে নথি পুড়ে যেত, সরকারের যোগাযোগে ক্ষতি হত। কখনও কখনও আমরা ওই বোমগুলো ইঁদুরের লেজে বেঁধে দিয়ে রেকর্ড রুমে ছেড়ে দিতাম।"
৬ মাসের মধ্যে দোরেস্বামী গ্রেফতার হন। ৪৩ সালে তিনি যখন ছাড়া পান, পুরোদমে যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে।
পরের দশকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে যোগ দেবেন দোরেস্বামী। তার মধ্যে রয়েছে কাইগা পারমাণবিক প্ল্যান্ট বসানো থেকে উত্তর কর্নাটকে ভূমিহীন কৃষকদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলনও। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের কর্মী এস আর হিরেমতের কথায় "ওঁর মত একজন গান্ধীবাদী চরিত্রকে পাকিস্তানের দালাল বলা বা হিংসায় উস্কানি দেবার অভিযোগ করা হাস্যকর।"
২০১৪ সালে দোরেস্বামী এবং নিহত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ একটি নাগরিক সমাজ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হন, যাদের কাজ ছিল নকশালপন্থীদের অস্ত্র ছেড়ে মূলস্রোতে ফেরার ব্যাপারে সাহায্য করা। "আমরা চাই নকশালরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যুক্ত হন। আর এরা আমাকে বলছে নকশাল।" বললেন তিনি।
অমূল্যার বাবা দুজন প্রাক্তন নকশালের জামিনদার ছিলেন। দোরেস্বামী বললেন, "৫ থেকে ৭ বছর আগে আমি কোপ্পায় গিয়েছিলাম, যেথানে ৫০০ জনজাতির বাড়ি উচ্ছেদ করা হচ্ছিল। আমার মনে নেই, আমার বন্ধুরা বলছে রাত্রের খাওয়ার জন্য একটি পরিবার আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। ও তো তখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ে, একেবারেই বাচ্চা। নাকি ও নকশাল হিসেবেই জন্মেছে!"
আরএসএসের কোনও স্বাধীনতা আন্দোলনকারী না থাকায় তারা কতটা দুর্বল শক্তি ছিল, সে কথা মনে পড়ে দোরেস্বামীর। তাঁর বিশ্বাস সরকারের ব্যর্থতাই বিজেপির উত্থানের কারণ। "গান্ধী চেয়েছিলেন অগ্রাধিকার দিয়ে দারিদ্র্যমোচন হোক। কিন্তু রাজনীতিবিদরা সে ছাড়া সব করেছেন, চাঁদে গিয়েছেন, টাকাপয়সা নয়ছয় করেছেন।"
তিন মাস আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেয়ের বাড়ির কাছে একটা বাড়িতে চলে এসেছেন ১০২ বছরের এই মানুষটি। তাঁর অভিযোগ আরএসএস টার্গেট করছে অল্পবয়সীদের। "ওরা খেলার নাম করে শাখায় ডেকে নিয়ে গিয়ে মনের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ভরে দিচ্ছে।"
৩ মার্চ, ইয়েদুরাপ্পা মন্ত্রিসভার এক মন্ত্রীকে খোলা চিঠি লেখেন লেখক ও বুদ্ধিজীবী দেবানুর মহাদেব। "অন্য এক যুগের এক মানুষ আমাদের মধ্যে বাস করছেন। যে মানুষ ১০০র বেশি বছর ধরে অহিংসার মাধ্যমে বেঁচে রয়েছেন, তিনি যে সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, তার দিকে তাকানোর সাহসহীনতা আমাদের লিলিপুটে পরিণত করে। "
দোরেস্বামী অবশ্য চিন্তা করছেন না। "আমার বন্ধুরা বলছে এসব করা হচ্ছে কারণ ওরা আমার কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চায়। কিন্তু নিয়ম কানুন রয়েছে, আমাদের রক্ষা করার জন্য সংবিধান রয়েছে। মানুষ রয়েছেন। তাঁরা আমাকে সম্পূর্ণ জানেন। আমার জীবন আয়নার মত। নিশ্চিতভাবেই মানুষ আমার পাশে দাঁড়াবেন... গরিব মানুষের খাবার, রোজগার শিক্ষা প্রয়োজন। সে কারণেই আমি এখনও লড়ে যাচ্ছি।"