কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, তাঁর দেশের তদন্তকারীরা ভারত এবং জুন মাসে খালিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার মধ্যে একটি ‘সম্ভাব্য যোগসূত্র’ খুঁজে পেয়েছেন। পালটা ভারত সরকার কানাডার বিরুদ্ধে ‘খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী এবং চরমপন্থীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করেছে।’
ভারত বলেছে যে, ‘এই ব্যাপারে কানাডা সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। আর, তার জেরে ভারত উদ্বিগ্ন।’ বিদেশ মন্ত্রকের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কানাডার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এই ধরনের জঙ্গি সংগঠনের জন্য প্রকাশ্যে সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। কানাডায় খুন, মানব পাচার এবং সংগঠিত অপরাধ-সহ বিভিন্ন ধরনের বেআইনি কার্যকলাপের যে স্থান তৈরি হয়েছে, তা নতুন নয়।’
বছরের পর বছর ধরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। একটি ঘটেছে গত ৪ জুন। অন্টারিওর ব্রাম্পটনে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে অপারেশন ব্লুস্টারের ৩৯তম বার্ষিকীর আগে একটি কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়েছিল। ৫ কিমি দীর্ঘ পদযাত্রায় একটি ট্যাবলোয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড দেখানো হয়েছে। যেখানে একজন মহিলার পুতুলকে একটি রক্তমাখা সাদা শাড়িতে দেখানো হয়েছে। যাঁর হাত ছিল ওপরে। পাগড়িধারী সশস্ত্র উর্দিপরা লোকজন ওই মহিলার দিকে বন্দুক ধরে রেখেছিলেন। ওই মহিলার পুতুলের পিছনে একটি পোস্টারে লেখা ছিল, ‘দরবার সাহেবে হামলার প্রতিশোধ।’
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর এই ঘটনায় তাঁর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ভারতের বক্তব্য, ভোট ব্যাংকের রাজনীতির প্রয়োজন থাকলেও কানাডাকে বুঝতে হবে যে ভারত কীভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী, চরমপন্থী, হিংসার শিকার হয়েছে। আর, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জায়গা দিয়ে কানাডা বিরাট সমস্যা তৈরি করছে। কানাডায় খালিস্তান আন্দোলনের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে জাস্টিন ট্রুডোর কাছে নরেন্দ্র মোদীও অভিযোগ জানিয়েছেন।
ভারত এবং কানাডার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৮২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল জাস্টিন ট্রুডোর বাবা পিয়েরে ট্রুডোর। তিনি সেই সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ট্রুডো নিজে বর্তমানে কানাডার প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু, তারপরও যে খালিস্তানিরা ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেছে, তাদের হয়ে ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন কানাডার সরকার সাফাই গাইছে বলেও অভিযোগ ভারতের।
ভারত-কানাডা সম্পর্কের সাম্প্রতিক অবনতির পর, ভয় এবং উদ্বেগ আঁকড়ে ধরেছে সেদেশে পঠনপাঠনরত এবং স্থায়ীভাবে (পিআর) থাকতে ইচ্ছুক ভারতীয়দেরকে। পাশাপাশি, কানাডার সঙ্গে কাজ করা শিক্ষাগত পরামর্শদাতারাও রীতিমতো শঙ্কায়। কারণ, তাঁরা আর ভারত থেকে নিয়ে গিয়ে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পড়ুয়াদের ভর্তি করাতে পারবেন না।
কানাডার সংসদে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, জুন মাসে নিহত কানাডার বাসিন্দা খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যায় ভারত সরকারের ‘সম্ভবত যোগ’ রয়েছে। এরপরেই কানাডা সোমবার একজন উচ্চপদস্থ ভারতীয় কূটনীতিককে সেদেশ থেকে বহিষ্কার করেছে। আর, তারপরই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারেতে এক গুরুদ্বারের বাইরে নিজ্জারকে গুলি করে খুন করা হয়েছে। কানাডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় ১৬ লাখ মানুষ বসবাস করেন। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিখ সম্প্রদায়ের।
খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার জন্য ভারতকে দায়ী করে এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে কানাডা। অন্যদিকে কানাডার অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। বিদেশ মন্ত্রক বলেছে, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগ অযৌক্তিক। খালিস্তান সমর্থকদের আশ্রয় দেওয়ার ইস্যুতে কানাডা ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন নতুন কিছু নয়, তবে G-20 সম্মেলনের পর এই উত্তেজনা আরও বেড়েছে।
চলতি মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত G-20 সম্মেলনে অংশ নিতে এসেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ট্রুডোর কাছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সুরক্ষা এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের ওপর হামলার বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন এবং তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। ট্রুডো দেশে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে কানাডা অক্টোবরে ভারতের সঙ্গে একটি প্রস্তাবিত বাণিজ্য মিশন স্থগিত করে। কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজি বাণিজ্য মিশন স্থগিত করার কোনও কারণ দেননি তবে জি -20 শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর তীব্র অসন্তোষকেই ভারতের সঙ্গে একটি প্রস্তাবিত বাণিজ্য মিশন স্থগিতের কারণ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কানাডা ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বেশ পুরনো। কানাডা এমন একটি দেশ যেখানে ভারতীয় সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ বসবাস করেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশ। সিএনবিসির একটি প্রতিবেদন অনুসারে, কানাডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় ১৬ লাখ মানুষ রয়েছেন। যদি কানাডার ২০২১ সালের আদমশুমারি দেখি, সেখানে প্রায় ৭৭০,০০০ শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন। ২০১৫ সালে, যখন জাস্টিন ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী হন, ৩ জন শিখ তাঁর মন্ত্রিসভায়ও স্থান পান।
২০২২-২৩ সালে, ভারত কানাডায় ৪.১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল। এর আগে ২০২১-২০২২ সালে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। অন্যদিকে, কানাডা ২০২২-২৩ সালে ভারতে ৪.০৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে, ২০২১-২২ সালে ৩.১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল।
ভারত কানাডায় ওষুধ, ফার্মা পণ্য, তৈরি পোশাক, জৈব রাসায়নিক, লোহা, ইস্পাত, গহনা, শোভাময় পাথর এবং কিছু প্রকৌশল সরঞ্জাম রপ্তানি করে। অন্যদিকে, ভারত কানাডা থেকে মূলত ডাল, লোহার স্ক্র্যাপ, খনিজ, নিউজ প্রিন্ট, কাঠের সজ্জা, পটাশ এবং শিল্প রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করে। বিশ্বমঞ্চে ভারত সুনামের কথা মাথায় রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, কানাডা তার প্রমাণের কোনো বিশদ বিবরণ ভারতের সঙ্গে ভাগ করেনি। যা ইঙ্গিত করে যে সেই কাজ "যথাযথ সময়ে" করবে কানাডা।ন য়াদিল্লি তার জন্য অপেক্ষা করছে। কানাডা - G7 দেশগুলির মধ্যে একটি - ফাইভ আইস অ্যালায়েন্সের অংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে।
ওয়াশিংটনে, হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়েন ওয়াটসন সংবাদ সংস্থা এপিকে বলেছেন, “ কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কানাডার তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে ব্রিটেন সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা এই গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে ঘনিষ্ঠ নজর রেখে চলছি। কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের চলমান তদন্তের সময় আরও মন্তব্য করা অনুচিত হবে।” ঋষি সুনাকের মুখপাত্র রয়টার্সকে জানিয়েছেন, 'ট্রুডোর মন্তব্য ভারত-ব্রিটেন বাণিজ্য আলোচনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না"।
অস্ট্রেলিয়ার বিদেশমন্ত্রী পেনি ওং-এর এক মুখপাত্র বলেছেন, "অস্ট্রেলিয়া এই অভিযোগের বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং আমরা উর্ধ্বতন পর্যায়ে আমাদের উদ্বেগ ভারতের কাছে জানিয়েছি।”