"এখন আর আমাদের মতামত জানতে চেয়ে কী হবে? সব শেষ।" বলছিলেন ৪৫ বছরের সঈদ খান। শ্রীনগরের লাল চকে থাকেন তিনি, পেশায় ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়র।
এতদিন নয়া দিল্লি কোন দিকে যাচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে কাশ্মীরিদের মুখে হয় রাগ ফুটে উঠত নয়ত আশার আলো। কিন্তু বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার ও রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর মঙ্গলবার তাঁদের মুখে কেবল হতাশার প্রতিচ্ছবি।
আরও পড়ুন, এমন বন্দিদশা কাশ্মীর আগে কখনও দেখেনি
কাশ্মীরের রাজধানী এখন ভুতুড়ে শহরে পরিণত, সঈদ খান মুখে যা বললেন, তা বহু কাশ্মীরিরই মনের কথাও বটে। তার মধ্যে রয়েছেন বাটমালুর এক ফলবিক্রেতা, রয়েছেন ছেলের হাত ধরে ঈদগাহের পাশের গলি দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক বাবা, এমনকি রামবাঘের ব্যারিকেডের পাশে প্রহরারত এক পুলিশকর্মীও।
রবিবার থেকে কার্যত বন্ধ শ্রীনগর। দেখে মনে হচ্ছে অবরুদ্ধ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, ইন্টারনেট সংযোগ প্রত্যাহৃত, ১৪৪ ধারা জারি, আচমকা বহু সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মীর বৃদ্ধি, শহরের বর্তমান চেহারা বলতে এই।
দোকান বাজার বন্ধ, স্কুল কলেজ কবে খুলবে কেউ জানেনা, রাস্তায় ব্যারিকেড, পাহারাররত বন্দুকধারী নিরাপত্তাকর্মী এবং গাড়ির যাতায়াত সীমাবদ্ধ আপৎকালীন হাসপাতাল পরিষেবার জন্য।
আরও পড়ুন, কাশ্মীরের ফরসা মেয়েদের বিয়ে করার সুযোগে উত্তেজিত বিজেপি বিধায়ক
"২০১৬-র বাড়াবাড়ির পর গত বছর পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছিল", বলছিলেন খান। "বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জেলে গিয়েছিল। কোনও ধর্মঘট ছিল না, পাথর ছোড়া ছিল না, স্কুল চলছিল, দোকান খোলা ছিল, পর্যটক বেড়েছিল। সবাই খুশি ছিল। এবার এক আঁচড়ে ওরা যেসব কাশ্মীরিরা সঙ্গে ছিল তাদেরও শত্রু বানিয়ে ফেলল। আমি জানি না কখন আর কবে এ সিদ্ধান্তের রেশ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব।"
তাঁর এক বন্ধু ও প্রতিবেশী, যিনি পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন, তিনি এসবের জন্য দায়ী করলেন ঔদ্ধত্যকে। "এরা ক্ষমতার মদে এতই মত্ত যে আমাদেরকে মানুষ হিসেবেই দেখতে পাচ্ছে না। এর ফল ওদের ভুগতে হবে না, আমাদের ভুগতে হবে।"
এক কিলোমিটার দূরে সরাইবল। বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র ইমতিয়াজ উনওয়ানির বাড়ি দক্ষিণ কাশ্মীরের লাঙ্গাটে এলাকায়। ইমতিয়াজ চিন্তিত, ক্রুদ্ধ। "কাশ্মীর এক আগ্নেয়গিরি, রাজনীতি যার ঢাকনা। ওরা ওমর আর মুফতিকে বন্দি করেছে। এবার ওরা পরিকল্পনা করেছে আমাদের বিধায়ক ইঞ্জিনয়ার রশিদকে গ্রেফতার করার, যিনি আমাদের সব সময়ে পাথর ছুড়তে নিষেধ করে এসেছেন। আর এবার এই। ওরা ঢাকনা খুলে দিল।"
আরও পড়ুন, “এ ভারত আমি দেখিনি। এ ভারত আমি কখনও দেখিনি।”
একই উদ্বেগের কথা শোনা গেল জম্মু কাশ্মীর পুলিশের এক কনস্টেবলের কথাতেও। "আমি একজন সরকারি চাকুরে। আমি নির্দেশ পালন করি। কিন্তু ছেলের কাছে কী বলব! আমি ওকে কী করে বোঝাব যে ভারত রাষ্ট্র ওর কথা ভাবছে, ও যেন পাথর ছোড়া দলে যোগ না দেয়। ছোটরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছে, মৃত্যুই যদি আমাদের নিয়তি হয় তাহলে স্কুলে গিয়ে কী হবে!"
সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের অবস্থাও তথৈবচ। "এরকমটা আগে কখনও ঘটেনি। আমাদেরকে এ নিয়ে কিছু বলেনি। আমরা টিভি দেখে জেনেছি। আমরা এখন শুধু নির্দেশ পালন করছি।"
উদ্বেগের পরিমাণ বোঝা যায় দিল্লি থেকে শ্রীনগরের বিমান দেখলে। প্রায় খালি বিমানে সাকুল্যে ৩০ জন যাত্রী ছিলেন। শ্রীনগর থেকে দিল্লিগামী বিমান ছিল ভরা।
শ্রীনগরগামী বিমানের যে সব যাত্রীরা ছিলেন তাঁরা মূলত ফিরছিলেন উৎকণ্ঠা নিয়ে- জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র, এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী যিনি মালয়েশিয়া থেকে মেয়েকে দেখতে আসছেন, এবং এক ব্যবসায়ী যিনি পরিবারকে কাশ্মীরের বাইরে নিয়ে যেতে চান- এঁরা কেউই পরিচয় প্রকাশ করতে চান না।
আরও পড়ুন, ছেঁড়া-খোঁড়া ইতিহাস, তালি দেওয়ার ভবিষ্যৎ
জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র এম টেক করছেন। তাঁর কাছে টিভির একটি স্ক্রিনশট রয়েছে, যাতে ৩৭০ বাতিলের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বললেন, "আমি পুলওয়ামায় থাকি। আমি জানি না বাবা-মা একথা জানেন কিনা আদৌ। কেবল লাইনও নেই। আমার ওঁদের জন্য চিন্তা হচ্ছে। শ্রীনগর থেকে যদি কোনও গাড়ি না পাই, আমি তাহলে হেঁটে পুলওয়ামা যাব।"
নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও তিনি শঙ্কিত।
শ্রীনগরের ইদগাহর ব্যলসায়ী ডায়াপার প্রস্তুতকারক। গত ১২ দিন তিনি দিল্লি কলকাতা করে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি পরিবারকে শ্রীনগর থেকে নিয়ে আসতে চান। বললেন, "এক আঁচড়ে ওরা সব শেষ করে দিল। কাশ্মীর ভারতের হাত থেকে বেরিয়ে গেল। পাকিস্তানের জন্য দরজা খুলে দিল ওরা। গত কয়েক বছর ধরে যা অর্জন করা হয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেল। ওরা ওমর আর মেহবুবার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল, যারা আসলে ওদেরই লোক ছিল। কাশ্মীরিদের সঙ্গে যে সেতু ছিল, সেই সেতু পুড়িয়ে দিল ওরা।"
Read the Full Story in English