Advertisment

বেআইনি অটোর রমরমা মহানগরে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়

বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করে সরকার, কিন্তু অটোর ভাড়া বাড়ায় ইউনিয়ন। আর ইউনিয়নকে কাঁচকলা দেখিয়ে যেমন খুশি ভাড়া নেয় অটোচালকরা। সরকার বা ইউনিয়নের তোয়াক্কা না করে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
auto cover photo

অটোর দৌরাত্ম্য় নিয়ন্ত্রন করা কত কঠিন তা শাসকদলের ইউনিয়ন নেতাদের কথাতে পরিস্কার। ছবি - শশী ঘোষ

শহরজুড়ে অটোর দৌরাত্ম্যে নাজেহাল সাধারন মানুষ। সরকার 'অটো নীতির' খসড়া প্রস্তুত করেই ক্ষান্ত। এদিকে মহানগরের উত্তর বা দক্ষিণ, সর্বত্র একই চিত্র। এদের অত্যাচার থেকে বাদ নেই শহরতলিও। অটোচালকদের নিয়ন্ত্রনে আনতে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ বা কাউন্সিলররাও অপারগ। বৃষ্টি বা রাত বাড়লে অটোচালকদের দাপটও বাড়তে থাকে। না বন্ধ হয়েছে কাটা রুট, না হয়েছে ভাড়া নিয়ন্ত্রন। বরং দুটোই বেড়ে গিয়েছে সমান তালে।

Advertisment

শহরে ও শহরতলির অটোর হালহকিকত কী? সে সম্পর্কে অটো ইউনিয়ন অবগত নয়, তা কিন্তু একেবারেই ভাবার কারণ নেই। তবু যাত্রী হয়রানির কোনও প্রতিকার হয় না। যত অপরাধই করুক, শাস্তি জোটে না অটোচালকদের। তার একটা কারণ এটা হতে পারে, যে প্রকৃতই কোটি কোটি টাকার আমদানি হয় এই পরিবহণের কারবারে।

আরও পড়ুন: আয় বাড়াতে মেট্রো স্টেশনে খাবারের স্টল, ওষুধের দোকান?

উল্টোডাঙ্গা থেকে সল্টলেকের রুটে অটোর অত্যাচার ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছে যায়। শহরের যে কোনও রুটের তুলনায় এখানে যাত্রীভাড়া বেশি। কারও কিছু বলার নেই। সোমবার অটোচালকদের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধও করেছেন অফিসযাত্রীরা। এখানে অটোচালকরা যে ভাবে দর হাঁকেন তাতে বোঝা দায়, অটো না লাক্সারী ট্যাক্সি। ভাড়ার দরে কখনও অবশ্য লাক্সারী ট্যাক্সিকেও হার মানিয়ে দেয় এখানকার অটোচালকরা। উল্টোডাঙ্গা থেকে করুণাময়ী বা সেক্টর ফাইভ যাওয়ার জন্য যেমন খুশি ভাড়া নেওয়া হয়। সেক্টর ফাইভ এলাকা অল্প বৃষ্টিতেই যেহেতু ভেসে যায়, অটোর ভাড়াও আকাশ ছুঁয়ে যায়। এমনকি অন্য যাত্রী না থাকলে শুনতে হয়, "চলুন, রিজার্ভ ছাড়া যাবে না। ৪০০ টাকা দেবেন।" এমনই অভিযোগ করেছেন এক যাত্রী। উল্টোডাঙ্গা থেকে সল্টলেক পিএনবিতে গেলেও ১৫ টাকা। এত কম দূরত্বে এত বেশি ভাড়া শহরে কোথাও নেই, তা হলফ করে বলা যায়।

inline image rain বৃষ্টি বাড়লে অটোর ভাড়াও যথেচ্ছ বাড়ে। ফাইল ছবি

আর উল্টোডাঙ্গা থেকে শোভাবাজারের দিকে যে অটো আসে, পুজোর দুমাস আগে থেকে দ্বিগুন ভাড়া নিতে শুরু করে। কোনও প্রতিবাদ করলে তৎক্ষণাৎ জুটবে দুর্ব্যবহার। সঙ্গে তেমন হলে ফ্রি চড় থাপ্পড়। আর উল্টোডাঙ্গা থেকে বাগুইআটির অটোরও একই দশা। এখানে বিকেল গড়াতেই কাটা রুট শুরু হয়ে যায়। বছর দুয়েক আগে দুর্ঘটনার জেরে একটি অটো ধরা পড়েছিল এই রুটে। পরে দেখা যায় ওই অটোর রুট পারমিট নেই। নেতার দৌলতে ওই অটো দাপিয়ে বেড়িয়েছে। উল্টোডাঙ্গায় অনেক অটো ওই তালিকায় রয়েছে বলে অভিযোগ।

অন্যদিকে দক্ষিণ কলকাতায়ও একই হাল। দুদিন আগেই এক যাত্রীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছিল এক অটোচালকের বিরুদ্ধে। যাত্রীদের অভিযোগ, এখানকার রুটগুলোতে এখনও বেআইনি কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন অটোচালকরা।

বিধাননগরের কাউন্সিলর নির্মল দত্ত বলেন, "উল্টোডাঙ্গা থেকে সল্টলেকের অটোতে কোনওরকম যাত্রী হয়রানি হলে তাঁরা ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে আমার মোবাইলে জানাতে পারেন। অভিযোগ প্রমানিত হলে ওই চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থানীয় বিধায়ক, কাউন্সিলরদের নিয়ে মিটিং হবে ১০ অগাস্ট। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি অটোর ভাড়ার চার্ট অটো স্ট্যান্ডে বড় ফ্লেক্সে লিখে টাঙিয়ে দেব। সেখানে দুটো মোবাইল নাম্বার থাকবে। ডিজি ট্রাফিকের, আর আমার। যাত্রীরা ওই ভাড়ার চার্ট দেখলে প্রতিবাদ করার জায়গা পাবেন। জোর করে রিজার্ভ যেতে চাইলে সরাসরি অভিযোগ করুন।"

রাসবিহারী-বেহালা ১৮ টাকা বা ২০ টাকা হলেও কখনও চেতলার পর চালকরা যেতে চায় না। গড়িয়াহাট-বেহালা ২২ টাকা ভাড়া নেয়। তবুও কাটা রুট বন্ধ হয়নি। একই দশা তারাতলা-ঠাকুরপুকুর রুটে। সেখানে রাত আটটার পরেই খেল দেখানো শুরু করে দেয় অটোচালকরা। অটো কোনও ভাবেই ঠাকুরপুকুর যায় না, তখন তাদের গন্তব্য শুধু চৌরাস্তা। যাত্রীদের দাবি, সেই সময় ১০ টাকার ভাড়া হয়ে যায় ২০ টাকা। প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হয় না। রাত হলেই টালিগঞ্জ থেকে বেহালা চৌরাস্তা বা সখেরবাজার পর্যন্ত অটো পাওয়া আর সম্ভব নয়। বেহালা চৌরাস্তা থেকে যে কোনও দিকে রাত ১১টা হলেই ভাড়া বাড়তে থাকে।

আরও পড়ুন: এয়ারপোর্ট এলাকায় যানজটে জেরবার জনসাধারণ

চাঁদনি চক থেকে পার্কসার্কাস তো অটো না মিউজিক হল, তা বোঝা যায় না। এখানেও ভাড়া বেশি নেওয়া বা গন্তব্যের আগে নামিয়ে দেওয়া রোজকার মামুলি ব্যাপার।

দক্ষিণ কলকাতার আইএনটিটিইউসি নেতা এবং সাংসদ শুভাশিষ চক্রবর্তী স্বীকার করেছেন, "ট্রেড ইউনিয়ন করি, কিন্তু অটো নিয়ে পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়।" তিনি বলেন, "দক্ষিণ কলকতায় অটোচালকদের মধ্যে একদিনে শৃঙ্খলা আনতে পারব না। এরা সিস্টেম মেনে চলেও না। তবে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব। দু-একটি ক্ষেত্রে নিয়েওছি। কসবা-বেহালা কাটা রুট অনেকটা বন্ধ করেছি। সবটা পারিনি।"

কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম মেনেও অটো চলে, যেমন দমদম এক নম্বর থেকে যে অটোগুলো ছাড়ে। দমদম এয়ারপোর্ট এলাকায় ১ টাকা বা ২ টাকা ভাড়া বাড়লেও রাত বাড়লে ভাড়ার খুব একটা হেরফের হয় না। কৈখালির ক্ষেত্রেও অটোযাত্রীদের তেমন অভিযোগ নেই।

কিন্তু আবার সোদপুরে অটোচালকদের অত্যাচার সীমাহীন। একটু রাত হলেই আট টাকার ভাড়া কত টাকায় থামাতে হয় তা জানেন না কোনও অটোচালক। দেখা গিয়েছে, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে কোনও অটো সেখানে থাকে না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাঁকতে থাকবে ২৫ টাকা। বাড়ি যেতে হলে এছাড়া কোনও উপায় নেই। নিত্যযাত্রী সুভাষ করের অভিযোগ, "কারও কিছু বলার নেই। না প্রশাসন, না ইউনিয়ন, কেউ চোখেও দেখে না, কানেও শোনে না।" তাঁর কথায়, "অনেক অভিযোগ করেছি, কিন্তু কর্তৃপক্ষ অন্ধ ও বধির। এভাবেই চলবে।"

আরও পড়ুন: দুর্ঘটনা রুখতে প্রশাসনের নজরে মোটর ট্রেনিং স্কুল

খসড়া 'অটো নীতি' প্রস্তুত করেছে রাজ্য সরকার, যা চালু করা অসম্ভব বলেই মনে করছেন অটোযাত্রীরা। কী আছে ওই খসড়ায়যাত্রীদের স্বার্থে কাটা রুটে অটোরিক্সার অনুমোদন দেওয়া যাবে না। অতিরিক্ত যাত্রীবহন করা যাবে না। উচ্চৈস্বরে অডিও সিস্টেম বাজানো যাবে না। ইচ্ছামত ভাড়া বাড়ানো যাবে না। উৎসবেও না। যাত্রীদের সঙ্গে আচরণ ঠিক করতে হবে। গাড়ি চলার সময় চালক মোবাইল ব্যবহার করবেন না। অফার লেটার ছাড়া অটোরিক্সা চালানো নিষেধ। এই ধরনের আরও নানাবিধ নিয়ম রয়েছে ওই খসড়ায়।

storm, kolkata রাত বাড়লে শহরের বহু এলাকায় অটোর ভাড়ার কোনো সীমা থাকে না বললেই চলে। ফাইল ছবি

বস্তুত, যে যে বিষয় খসড়ায় লেখা রয়েছে তার একটাও শহর বা শহরতলির কোনও অটো রুটে মেনে চলা হয় না। প্রথমত, কাটা রুট শহরে অবাধে চলছে। চালু থাকা বহু অটোর কোনও রুট পারমিট নেই। পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের বক্তব্য, মধ্যমগ্রাম হোক বা উল্টোডাঙ্গা, পার্কসার্কাস হোক বা গড়িয়াহাট, সোদপুর বা বেহালা, কোনও রুটেই বেআই অটো নেই, এমনটা জোর দিয়ে বলার ক্ষমতা নেই পরিবহণ দপ্তরের। মহানগরে যে ভাবে বেআইনি অটো চলে, তার ফলে কয়েকশো কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অভিযোগ, তার ওপর টাকার দরকার পড়লেই মুখের কথায় নতুন অটো রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া মামুলি ব্যাপার। এর ফলে সরকারের পরিবর্তে কাদের পেট ভরছে? উঠছে সেই প্রশ্ন।

ইচ্ছামত যাত্রী বহন করে না, শহরে এমন কোনও অটো রুট আছে কি? কবে আর সাবালক হবে প্রশাসন, নিয়ন্ত্রন করবে বেপরোয়া অটো? বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করে সরকার, কিন্তু অটোর ভাড়া বাড়ায় ইউনিয়ন। আর ইউনিয়নকে কাঁচকলা দেখিয়ে যেমন খুশি ভাড়া নেয় অটোচালকরা। সরকার বা ইউনিয়নের তোয়াক্কা না করে। ইউনিয়ন কখনও কি যাত্রীস্বার্থ রক্ষা করবে? পরিবহণ দপ্তরের ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকা ছাড়া কি সত্যি উপায় নেই?

west bengal transport minister kolkata public transport
Advertisment