'ঘোমটা তুলুন', একটি অনুষ্ঠানে গ্রামে গিয়ে স্থানীয় মহিলা পঞ্চায়েত সদস্যকে এমনই বলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। খোদ মন্ত্রীর মুখ থেকে এমন কথা যে বেরোতে পারে তা বোধ হয় আঁচ করতেই পারেননি এ গ্রামের বাসিন্দারা। বিশেষ করে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর এই মন্তব্যে কিছুক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন গাঁয়ের প্রবীণরা।
উত্তর গুজরাতের মেহসানার রান্তেজ গ্রাম। ইন্টারনেটের যুগে ভিন গ্রহও যখন হাতের মুঠোয়, তখন এগাঁয়ের একটি বড় অংশের বাসিন্দা পুরনো ধ্যান-ধারণাকে আগলেই বেঁচে রয়েছেন। গ্রাম থেকে এই প্রথম মহিলা হিসেবে পঞ্চায়েত সদস্য বা সরপঞ্চ হয়েছেন মীনাবা ঝালা। সম্প্রতি এই গ্রামেই একটি অনুষ্ঠানে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যা মীনাবাকে সংবর্ধনা জানানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী জিতু ভাঘানি।
জানা গিয়েছে, অনুষ্ঠান মঞ্চে পঞ্চায়েত সদস্যা মীনাবার সঙ্গেই ছিলেন গ্রামেরই বেশ কয়েকজন মহিলা। তাঁদের প্রত্যেকের মুখই ঘোমটায় ঢাকা দেওয়া ছিল। উল্টোদিকে, গ্রামের পুরুষরা বসেছিলেন স্টেজের নীচে চেয়ারে। মীনাবাকে সংবর্ধনা জানাতে গিয়ে 'বিরাট' এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন খোদ মন্ত্রীমশাই। পঞ্চায়েত সদস্যা মীনাবা ঝালাকে মুখ থেকে ঘোমটা সরাতে বলেন মন্ত্রী। এই ঘটনা ঘিরে মুহূর্তে হুলস্থূল পড়ে যায় অনুষ্ঠানস্থলে।
শিক্ষামন্ত্রী ভাঘানিকে বলতে শোনা যায়, ''যদি প্রবীণরা অনুমতি দেন, আমি মীনাবাকে এই রেয়াজ (ঐতিহ্য) থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করব।'' ভরা মঞ্চে মহিলাকে ঘোমটা তোলার পরামর্শ প্রথমটায় বিশেষ ভালোভাবে নেননি উপস্থিত অনেকেই। ভিড়ের মধ্যে থেকেই এক ব্যক্তি বলতে শুরু করেন, ''স্যার, আমরা রাজপুত।'' তবে মন্ত্রীমশাইও কম যান না, জাতপাতের অঙ্কে না গিয়ে মানবিক হওয়ার বার্তা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর। ওই ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে এরপরই মন্ত্রী বলেন, ''এর সঙ্গে জাতপাতের কী সম্পর্ক? দরবার, প্যাটেল, ভানিয়া বা ব্রাহ্মণ… দেখুন মহিলারা কত খুশি। এবার এঁরাও আপনাকে আশীর্বাদ করবেন।''
জাতপাত এড়ানোর বার্তা দিয়ে মন্ত্রী আরও বলেন, ''মান মর্যাদা ঠিকই আছে। তবে আপনি যখন একজন সরপঞ্চ বা পঞ্চায়েত সদস্য হবেন, তখন আপনাকে এই ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গ্রামকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। আশেপাশে তাকান। পৃথিবী কোথায় পৌঁছেছে। এটা করে (ঘোমটা সরিয়ে) আমরা আমাদের মান মর্যাদা হারাব না। বাড়িতে সব কিছুই মানুন। আমি এই ঐতিহ্যকে খারাপ বলছি না। তবে আমাদেরও সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে মানসিকতায় বদল আনতে হবে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যাতে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।'' অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া প্রত্যেক মহিলাদেরই এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখার অনুরোধ জানান মন্ত্রী।
আরও পড়ুন- দুয়ারেই চতুর্থ ঢেউ? সংক্রমণের বিদ্যুৎ গতিতে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়
মন্ত্রীর এই বার্তায় যে এলাকায় বেশ সাড়া পড়েছে তা অবশ্য বলা যাবে না। অন্তত রান্তেজ গ্রামের বয়স্কদের অধিকাংশই মহিলাদের ঘোমটা রেওয়াজ তুলে দিতে নারাজ। তবে মন্ত্রীর একটানা এই বার্তায় গ্রামের এক প্রবীণ অবশ্য সহমত পোষণ করেছেন। ওই ব্যক্তিও শিক্ষামন্ত্রী জিতু ভাঘানির সঙ্গে একই মঞ্চে চিলেন। তাঁরও ঘোমটা সরানোয় সায় রয়েছে বুঝে এরপর সরপঞ্চ মীনাবাও হালকা করে ঘোমটা তোলেন। তবে এতে যে উপস্তিত প্রত্যেকের সায় ছিল তা বলা যাবে না। কারণ ওই মঞ্চেই এরপর মীনাবার জন্য একেবারে কোণের দিকে একটি চেয়ারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন- গুজরাট দাঙ্গায় ফের ক্লিনচিট মোদীকে, সুপ্রিম কোর্টে খারিজ জাকিয়া জাফরির আবেদন
তবে খোদ সেই পঞ্চায়েত সদস্যা মীনাবা কিন্তু রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে একমত হয়েছেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে মীনাবা বলেন, ''মন্ত্রীমশাই ঠিক কথাই তো বলেছেন। আমাদের ঘোমটা ঘরে রাখা উচিত। এই (ঐতিহ্য) থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আমরা বাড়িতে পর্দার পিছনে রয়েছি। তবে আমাদেরও এবার সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।'' মাত্র ৬ মাস আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী চারজন পুরুষ প্রার্থীকে হারিয়ে গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মীনাবা জালা।
উল্লেখ্য, দুই সন্তানের মা মীনাবা আদতে আহমেদাবাদের বাসিন্দা। পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়া তাঁর স্বপ্ন ছিল। যদিও পরিবারের চাপেই সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য এগোতে পারেননি তিনি। বিশেষ করে ভাইয়ের চাপে নিজের ইচ্ছাকে কর্যত গলা টিপে শেষ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মীনাবা। এমনকী কলেজের পাঠও শেষ করা হয়নি তাঁর। বি.কম-এর প্রথম বর্ষে পড়ার সময়েই কলেজ থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন- ‘প্রয়োজনে কর্মীরা পথে নামবেন’, সংকট আরও বাড়ছে বুঝেই ঢোক গিললেন রাউত?
শুধু মেয়েদের ঘোমটা পরানোই নয়, এখনও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রামে-গ্রামে অনেক প্রবীণই পুরনো ধ্যান-ধারণা আগলে পড়ে রয়েছেন। মেহসেনার রান্তেজ গ্রামও তাদেরই একটি। এক্ষেত্রে শিক্ষার অভাবকেই দায়ী করেছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যা মীনাবা ঝালা। তাঁর কথায়, ''প্রবীণদের অনেক কিছুতেই আপত্তি রয়েছে। কারণ, তাঁদের শিক্ষার অভাব রয়েছে। তবে ধীরে-ধীরে সব বদলাচ্ছে। এখন মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে। আমার ভাইকেই দেখুন…ওঁর মেয়ে এখন পুলিশ ফোর্সে রয়েছে।"