এবার ঢাকও বাজাবে না, ধুনুচি নাচেও মাতবে না রাজেশ। এখনও ইসলামপুর আইটিআইয়ের ছাত্রের দেহ শায়িত রয়েছে দোলনচা নদীর তিরে। পিতৃপক্ষ অবসান, দেবীপক্ষের সূত্রপাত। ইসলামপুরে শুকনোভিটা গ্রামে বিষাদের সুর যেন আরও বেড়ে গিয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর দাড়িভিট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের সময় গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল তাপস বর্মণ ও রাজেশ সরকারের। ঘরের ছেলের হত্যাকারীদের শাস্তি চান রাজেশের পরিবারও। মা দুর্গাকে এবার আর আহ্বান করার মত মানসিক অবস্থা নেই শুকনোভিটার সরকার পরিবারের।
গতবছর দুর্গাপুজোয় রাজেশ।
রাজেশের ভাই সুজিত সরকার বলেন, "পাশে জ্যেঠুর বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। ঠাকুমার মানসিক ছিল দুর্গাপুজোর। সেই শুরু হয়েছিল বছর দশেক আগে। গ্রামের মানুষও এই পুজোতে অল্পবিস্তর সাহায্য করতেন। তাঁরাও নিজেদের পুজো মনে করে পুজোর চারদিন আমাদের মন্ডপেই সময় কাটাতেন। সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম এই পুজোর জন্য।" ভাইয়ের আপশোষ, "দুর্গাপুজোয় দাদার উৎসাহ ছিল সবথেকে বেশি। পুজোর যোগাড় করা, ঢাক বাজানো, ধুনুচি নাচ, পুষ্পাঞ্জলি, সবেতেই দাদা সবার আগে। পুরোহিতের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করত। সব শেষ। কী আর হবে। সেই যখন নেই তখন আর পুজো!"
দাড়িভিট থেকে ২ কিলোমিটার দূরে শুকনোভিটায় রাজেশদের বাড়ি
দাড়িভিটের ঘটনার পেরিয়ে গিয়েছে ১৮ দিন। কিন্তু রাজেশের পরিবার সিবিআই তদন্তের দাবি থেকে এক চুলও নড়েননি। তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন স্থানীয় বিধায়ক কানাইয়ালাল আগরওয়াল। রাজ্য সরকার চাকরি ও অর্থের ঘোষণা করেছে। কিন্তু সুজিত জানিয়ে দিলেন, "যে সরকার গুলি করেছে তাদের চাকরি বা অর্থ কিছুই চাই না। আমরা চাই দাদার হত্যাকারীদের শাস্তি। আমরা সাধারণ মানুষ, সরকারের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা আমাদের নেই।"
এক গুলিতেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গিয়েছে ইসলামপুরের শুকনোভিটে গ্রামের নীলকমল সরকারের পরিবারের। দিনমজুর বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে সংসারের হাল ধরবে। তাই আইটিআই-তে পড়ার পাশাপাশি চাকরির কোনও পরীক্ষা বাদ দিত না রাজেশ। ঘটনার দিন ভাইকে নিয়ে দাড়িভিট স্কুলে ছুটে গিয়েছিল বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করতে। কিন্তু স্কুলের সামনেই গুলিতে লুটিয়ে পড়ে বছর একুশের যুবক। ছলছল চোখে নীলকমলবাবু বলেন, "এমন অকালে চলে গেল ছেলেটা। ওর ওপরই ভরসা করেছিল পুরো পরিবার। যারা গুলি করে ছেলেকে খুন করেছে তাদের শাস্তি চাই। আমাদের চাকরিও চাই না, টাকাও চাই না।"
গত বছর দুর্গাপুজোর পুরোহিত ও জ্যাঠতুতো দাদার সঙ্গে রাজেশ
দাড়িভিটের ২ কিলোমিটার দূরেই শুকনোভিটা গ্রাম। সেই গ্রামে বাড়ি দাড়িভিট স্কুলের ছাত্রী মৌ সরকারের। মৌয়ের খুড়তুতো দাদা রাজেশ ও সুজিত। ঘটনার দিন মৌ ফোন করে বাড়িতে জানায়, সে বিপদে পড়েছে স্কুলে। পুলিশ শুধু লাঠিপেটা করছে না, স্কুলের ছাাত্রীদের সম্মানহানিও করছে। সুজিত বলে, "বোন ফোন করে জানায়, পুলিশ তার জামা ছিঁড়ে দিয়েছে। তাকে বলেছে এবার কাবাডি খেলবো। এই শুনেই দুই ভাই মিলে তড়িঘড়ি সাইকেলে করে স্কুলে যাই। গিয়ে দেখি ধুন্ধুমার কাণ্ড। আমরা স্কুলে গিয়েছিলাম বোনের সম্মান বাঁচাতে।"
নীলকমলবাবু ছেলের খুনের বিচার চেয়ে দ্বারস্থ হয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের। অভিযোগ জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে। বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতৃত্বের সঙ্গেও দেখা করেছেন। মহালয়াতে শুকনোভিটার যে বাড়িতে আগমনীর সুর বাজতো, সেই বাড়িতে দিনভর বিষাদের ছায়া।